ইটের বদলে পাটকেল

কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন তুমুল আড্ডাবাজ আর রসিক মানুষ। নিজে যেমন হো হো করে হাসতে জানতেন, অন্যকে হাসাতেনও ঢের। আড্ডা-তর্কে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। একবার তাঁর এক অবাঙালি ভক্ত ও বন্ধুর সঙ্গে কবির তুমুল বাকবিতণ্ডা চলছে। দুজনই নিজেদের ভাষার শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে কথা বলছেন। কবির অবাঙালি বন্ধুটি ছিলেন হিন্দিভাষী। তাঁকে ঘায়েল করতে কাজী দারুণ এক তির ছুড়লেন। হাসতে হাসতে বললেন, ‘যাও যাও! তোমাদের হিন্দি ভাষা তো কুকুর–বেড়ালের ভাষা!’ এ কথা শুনে বন্ধুটি খানিকটা ঘায়েল হয়ে নিচুস্বরে বলে উঠলেন, ‘কিঁউ?’ অমনি কবি বলে উঠলেন, ‘ওই দেখো কুকুরের ডাক ডাকলে!’ ভদ্রলোক কবির কথায় রাগ না করে হেসে দিলেন। মজলিশের সবাইও হাসলেন। হাসি থামতেই হিন্দিভাষী ভদ্রলোক নজরুলের কথায় সায় দিয়ে বললেন, ‘হুয়া হুয়া!’ কবি বললেন, ‘ওই দেখো শিয়ালের ডাক ডাকলে, আমি ঠিক বলিনি?’ এতে কবির বন্ধুটিসহ উপস্থিত সবাই–ই বেশ মজা পেলেন।

নজরুলের এ রকম রসিকতায় মজলিশ জমে উঠতে সময় লাগত না। একবার গ্রামোফোন কোম্পানিতে গান রেকর্ডের জন্য এলেন এক ভদ্রলোক। তাঁকে নজরুলের কাছে পাঠানো হলো একটু পরীক্ষা করে দেখার জন্য। লোকটা কেমন গান গাইতে পারেন, শুনতে চাইলেন কবি। এরপর হারমোনিয়াম নিয়ে নজরুল ইসলামের সামনে বসে দীর্ঘ বকওয়াস শুরু করলেন লোকটি। নিজেই নিজের গুণকীর্তন গাইতে লাগলেন। গান শুরু না করে কথা বাড়িয়েই চলেছেন—কার কাছে গান শিখেছেন, তাঁর গান শুনে কবে কে প্রশংসা করেছে, তিনি কতটা পাণ্ডিত্যের অধিকারী ইত্যাদি ইত্যাদি। শুধু তা–ই নয়, নিজের গরিমা জাহির করতে কবিকে এবার জ্ঞান দিতে শুরু করলেন ভদ্রলোক, ‘আপনি কি ধানশ্রী ভৈরবী রাগের গান শুনেছেন? শোনেননি বোধহয়। খুব রেয়ার।’ নজরুল তখন বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘আপনি তো দেখছি একটি জানোয়ার লোক।’

‘কী বললেন?’ কবির এমন কথায় একেবারে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলেন লোকটি। নজরুল তখন বললেন, ‘না না অন্য কিছু মনে করবেন না। দেখলাম আপনি অনেক কিছু জানেন, তাই আপনার সম্বন্ধে “জানোয়ার” শব্দটি প্রয়োগ করেছি! জানতে জানতে জানোয়ার আরকি।’

লোকটি এবার হাঁ হয়ে বসে রইলেন।

রসিক নজরুল ইটের বদলে পাটকেল এভাবেই ছুড়তেন।

সূত্র: তাপস রায়ের রসিক নজরুল আনন্দবাজার পত্রিকা

গ্রন্থনা: বাশিরুল আমিন