এই সময় এমডির রুমে ঢুকলেন পারচেজ ডিপার্টমেন্টের মাহমুদ। ছগীর উদ্দীনের কথায় তিনিও সায় দিলেন, ‘স্যার, কথা সত্যি। উনি একজন এলিয়েন। এই পৃথিবীর কেউ না!’
: এটা কীভাবে সম্ভব? আপনারা কীভাবে বুঝলেন?
: স্যার, উনি ফেসবুকে কোনো পোস্ট দেন না, কারও কোনো পোস্টে লাইকও দেন না। স্যার, সেদিন আপনি যে আমাদের নতুন পলিসি নিয়ে একটা কমেন্ট পোস্ট করলেন, আমরা অফিসের সবাই লাইক দিয়েছি, কমেন্ট করেছি, শেয়ারও করেছি। উনি কিছুই করেননি। আপনি চেক করে দেখুন।
এমডি সাহেব চেক করে দেখেন ঘটনা সত্যি। সবার লাইক আছে, শেয়ারও আছে; কেবল আফজাল সাহেবের কোনো লাইক–কমেন্ট নেই। এমডির কোনো পোস্টেই সে লাইক পর্যন্ত দেয় না।
: ওকে আমি ব্লক করব। ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বললেন এমডি সাহেব।
: সে নাহয় করলেন, কিন্তু সে যে এলিয়েন, এর কী করবেন?
: ফেবুতে লাইক দেয় না, কমেন্ট করে না, শেয়ার করে না—এলিয়েন হওয়ার এটাই কি একমাত্র কারণ?
: না স্যার, আরও কারণ আছে। ওনাকে আমরা কেউ কখনো কিছু খেতে দেখিনি। অফিসের চা–নাশতাও না।
: বলেন কী!
: আরেকটা ব্যাপার আছে, স্যার। এবার মাহমুদ সাহেব গলা নামিয়ে ফেললেন আরেক ধাপ।
: কী কারণ?
: স্যার, আমাদের সবার জ্যামে পড়ে পাঁচ–দশ মিনিট লেট হয়। ওনার কখনো হয় না। আমাদের ধারণা, জ্যাম উনাকে পায় না।
: কেন পাবে না?
: উনি স্যার নিজস্ব স্পেসশিপে করে আসেন।
: বলেন কী?
: জি স্যার, অফিসের ছাদে পিয়ন আবদুল একটা গোল চাকতির মতো জিনিস দেখে এসেছে। এই জিনিস স্যার আগে ছাদে ছিল না। ইউএফও স্যার!
: সর্বনাশ! এখন উপায় কী? এবার এমডি সাহেব সত্যি সত্যি শিহরিত হলেন। ‘কিন্তু উনি যদি এলিয়েনই হয়ে থাকেন, উনি আমাদের অফিসে কী করছেন?’
: এখানেই তো প্রশ্ন, স্যার। উনি কম্পিউটার সেকশন বেছে নিয়েছেন। কারণ, আমাদের অফিসে বসে পৃথিবীর সব তথ্য উনি পাচার করছেন ইন্টারনেটে। এককথায় পৃথিবীর সর্বনাশ করছেন।
এমডির রুমে অঘোষিত এই গোপন মিটিংয়ের পর সিদ্ধান্ত হলো, যেকোনো মূল্যে অতিসত্বর কম্পিউটার সেকশনের আফজাল সাহেবকে অফিস থেকে বহিষ্কার করতে হবে। কিন্তু কী কারণ দেখিয়ে বহিষ্কার করা হবে, সেটা পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ, কাজে–কামে এই লোক, থুড়ি, এলিয়েন নিখুঁত। তার কাজে ভুল ধরার সত্যিই কোনো বুদ্ধি নেই। তবে প্রথম দফায় চিফ অ্যাকাউন্ট্যান্ট ছগীর উদ্দীনের বুদ্ধিতে তাঁর ঈদের বোনাস বন্ধ করে দেওয়া হলো। কারণ হিসেবে বলা হলো, ‘অনিবার্য কারণে এবার তার বোনাস স্থগিত।’ তাতেও এই লোকের কোনো বিকার নেই। নিয়মিত টাইমলি অফিসে আসছে–যাচ্ছে। আর অফিসে যে সে স্পেসশিপে করে আসে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ, অনেকেই তাকে ছাদ থেকে নামতে দেখেছে।
এবং অফিস শেষে সিঁড়ি বেয়ে উঠতেও দেখেছে।
ফের এমডি সাহেবের রুমে গোপন মিটিং বসল। আজকের মিটিংয়ে সদস্যসংখ্যা চার।
: কী ছগীর সাহেব, ঈদের বোনাস বন্ধ করেও তো কোনো লাভ হলো না।
: স্যার, আসলে ও তো এলিয়েন, বোনাস দিয়ে ও কী করবে! ওর কাজ হচ্ছে পৃথিবীর যাবতীয় তথ্য পাচার করা, সে তা–ই করে যাচ্ছে...
: আমার মনে হয় বিষয়টা নাসাকে জানানো দরকার।
: নাসা পরে, আগে পুলিশ বা র্যাবকে জানানো যাক।
: না না, অফিসে পুলিশ-র্যাব আসুক চাই না, অন্য বুদ্ধি বের করুন।
: স্যার ওনার সঙ্গে সরাসরি কথা বললে কেমন হয়? মার্কেটিংয়ের এক জুনিয়র অফিসার বলল।
: কী রকম?
: যেমন উনি সত্যি এলিয়েন কি না, এখানে কেন এসেছেন? কী তথ্য পাচার করছেন? এই অফিসে কত দিন থাকবেন?
: আরে বাবা, উনি যে এলিয়েন, এতে কোনো সন্দেহ আছে নাকি?
: তা নেই। তারপরও সরাসরি প্রশ্ন করে নিশ্চিত হওয়া আরকি...
: আইডিয়াটা খুব খারাপ না কিন্তু। চিন্তিত মুখে বলেন এমডি সাহেব।
অবশেষে সত্যিই একদিন অফিস শেষে এমডির রুমে আফজালের ডাক পড়ল। রুমে আর কেউ নেই। তিনি আর কম্পিউটার বিভাগের আফজাল।
: আফজাল সাহেব!
: জি স্যার।
: আপনি তো একজন এলিয়েন।
: জি স্যার, আপনি যখন বলছেন...বস ইজ অলওয়েজ রাইট। বসের গল্পটা জানেন নিশ্চয়ই, স্যার!
: বসের কোন গল্প?
: তাহলে একটু বলি স্যার, এক দোকানে তিনটা তোতা পাখি। প্রথমটার দাম ৫ হাজার টাকা। দ্বিতীয়টার দাম ১০ হাজার টাকা আর তৃতীয়টার দাম ২০ হাজার টাকা। এক ক্রেতা জানতে চাইল, ‘প্রথমটা ৫ হাজার কেন?’ কারণ সে বাংলা–ইংরেজি–উর্দু তিনটি ভাষায় কথা বলতে পারে, বিক্রেতার উত্তর। ‘আর দ্বিতীয়টাই–বা ১০ হাজার কেন?’ কারণ এটাও বাংলা–ইংরেজি–উর্দু তিনটি ভাষায় কথা বলতে পারে এবং লিখতেও পারে।’ ‘তৃতীয়টার দাম ২০ হাজার কেন? সে কী জানে?’ ক্রেতা জানতে চাইল। ‘সে আসলে এসব কিছুই জানে না। তারপরও সবাই তাকে বস ডাকে।’ বিক্রেতার উত্তর।
ওদিকে বসের রুমের বাইরে কান পেতে থাকা মিটিংয়ের চারজনের একজন বলে উঠল, ‘দেখলেন দেখলেন, বসকে কী রকম ডেলিবারেটলি অপমান করল? এলিয়েন বলেই এটা সম্ভব হয়েছে!’
বসের গল্প শুনে হাসবেন কি না, এমডি সাহেব ঠিক বুঝতে পারছেন না। তখন আফজাল সাহেবই কথা বললেন, ‘স্যার, আসলে আমরা সবাই এলিয়েন। আমি যেমন এলিয়েন, আপনিও এলিয়েন, বাইরে যারা দরজায় কান পেতে ঘাপটি মেরে আমাদের কথা শুনছে, তারাও এলিয়েন... সত্যি কথা বলতে, স্যার আমরা এখন আর কেউ মানুষের মতো আচরণ করি না। তাই আমরা একজন আরেকজনের কাছে এলিয়েন!’
বলে লোকটা এমডিকে সালাম দিয়ে উঠে পড়ল। সিঁড়ি দিয়ে ছাদের দিকে রওনা দিল।
একটু আগে দরজায় ঘাপটি মারা চারজন তখন সিঁড়ির গোড়ায় ঘাপটি মেরেছে। লোকটা নিশ্চয়ই এখন স্পেসশিপ নিয়ে পালাবে। ছাদে যাচ্ছে। ওরা এলিয়েনকে হাতেনাতে ধরার জন্য পিছু নিল নিঃশব্দে। ওমা! ছাদে উঠে লোকটা সিগারেট ধরাল, লোকটা কি এখানে সিগারেট খেতে আসে। অফিস ধূমপানমুক্ত এলাকা বলে! ছাদের এককোনায় উল্টে পড়ে আছে বিশাল একটা ডিশ অ্যানটেনা! নিশ্চয়ই কালবৈশাখীতে উল্টে পড়ে আছে; হঠাৎ করে দেখলে ইউএফওর মতোই লাগে।
ওরা চারজন একজন আরেকজনের দিকে তাকায়। নিজেদেরই এখন এলিয়েন এলিয়েন লাগছে!