করোনার কড়া শাসানিতে পুরো পৃথিবী প্রায় অবরুদ্ধ হয়ে আছে ২১ মাসের বেশি সময়। বিধিনিষেধের মারপ্যাঁচে বেশির ভাগ সময় দরজা বন্ধ রাখতে হয়েছে বইয়ের দোকানগুলোর। বন্ধ হয়ে আছে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়। তালা ঝুলছে লাইব্রেরি-পাঠাগারগুলোতে। এমন অবস্থায় বই বিক্রির পরিমাণ কমে যাওয়াই তো স্বাভাবিক, তাই নয় কি? অথচ এমন স্বাভাবিক ভাবনার গোড়ায় স্রেফ কুঠার চালিয়ে দিল বিশ্বের কিছু জরিপ ও গবেষণা। বড় বিস্ময় নিয়ে দেখা গেল, জরিপগুলো বলছে, এই ভয়াবহ করোনাকালেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছাপা বইয়ের বিক্রি বেড়েছে আশ্চর্যজনকভাবে।

যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্ট্যাটিসটা সম্প্রতি ‘অ্যাডভার্টাইজিং অ্যান্ড মিডিয়া আউটলুক’ নামে যে জরিপের ফল প্রকাশ করেছে, তা চোখ কপালে তোলার জন্য যথেষ্ট। এ জরিপ বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে গত এক বছরে ৪৫ শতাংশ মানুষ ছাপা বই কিনেছেন, যেখানে ই-বুক কিনেছেন মাত্র ২৩ শতাংশ মানুষ। বিষয়টি আশ্চর্যজনক এই কারণে যে যুক্তরাষ্ট্রে ই-বুক খুব জনপ্রিয়—এমন ধারণাই প্রচলিত। সেই প্রচলিত ধারণায় পানি ঢেলে দিয়েছে এই জরিপ। বিশেষ করে করোনাকালে বিধিনিষেধের মধ্যে ছাপা বই বিক্রির পরিমাণ বেড়ে যাওয়া নিঃসন্দেহে অবাক করার মতো ঘটনা। কারণ, ধারণা করা হচ্ছিল, বিধিনিষেধের মধ্যে মানুষের ভার্চ্যুয়াল–নির্ভরতা বাড়বে, যার ফলে ই-বকু, অডিও বুক, পিডিএফ বই—এসবের ব্যবহার ও বিক্রি বাড়বে। কিন্তু বাস্তবে এমন ঘটেনি। বরং ছাপা বইয়ের বিক্রিই বেড়েছে।

স্ট্যাটিসটা যে শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই জরিপ চালিয়েছে, এমন নয়। বিশ্বের আরও অনেক দেশে জরিপ চালিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। সমস্ত ফলাফল বলছে, সারা বিশ্বে ছাপা বইয়ের ক্রেতা বেড়েছে। ই-বুক ও ছাপা বইয়ের তুলনামূলক ওই জরিপচিত্রে দেখা যায়, গত বছর চীনে ৩২ শতাংশ মানুষ ছাপা বই কিনেছেন, যেখানে ই-বুক কিনেছেন ২৪ দশমিক ৪ শতাংশ মানুষ। যুক্তরাজ্যে ৪৮ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ ছাপা বই কিনেছেন, আর ই-বকু কিনেছেন ২০ শতাংশ মানুষ। জাপানে ৪০ দশমিক ১ শতাংশ মানুষ ছাপা বই কিনেছেন, ই-বুক কিনেছেন মাত্র ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ। দক্ষিণ কোরিয়ায় এই চিত্র ৩৪ দশমিক ৬ বনাম ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ। অস্ট্রেলিয়ায় করোনার মধ্যে গত এক বছরে ৪১ দশমিক ২ শতাংশ মানুষ বই কেনার জন্য ছাপা বইকে বেছে নিয়েছেন, যেখানে ই-বুক কেনার তালিকায় রয়েছেন মাত্র ১৫ দশমিক ৯ শতাংশ মানুষ। তো স্পেনের কী অবস্থা? সেখানে ৪৯ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ ছাপা বইকেই ভালোবেসে খরিদ করেছেন আর মাত্র ১৪ দশমিক ৩ শতাংশ কিনেছেন ই-বুক। জার্মানিতে ছাপা বইয়ের ক্রেতা সবচেয়ে বেশি। সেখানে গত বছর ৫৮ শতাংশ মানুষ ছাপা বই কিনেছেন, ই-বকু কিনেছেন মাত্র ১০ দশমিক ৪ শতাংশ। ‘ছবির দেশ কবিতার দেশ’ বলে পরিচিত ফ্রান্সে এই হার ৫৩ শতাংশ ও ৮ শতাংশ। সবশেষে পাশের দেশ ভারতের দিকে তাকানো যাক। সেখানেও গত বছর প্রায় ২৫ শতাংশ মানুষ ছাপা বই কিনেছেন আর ই-বুক কিনেছেন মাত্র ৬ শতাংশ মানুষ।

শুধু এই স্ট্যাটিসটাই নয়, যুক্তরাজ্যের পাবলিশার্স অ্যাসোসিয়েশনও বলেছে, করোনা মহামারিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সে দেশে ছাপা বইয়ের বিক্রি বেড়েছে ৪ শতাংশ। ফলে আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২ বিলিয়ন পাউন্ডে। ‘পাবলিশিং ইন ২০২০: রেজিলিয়েন্ট ইন দ্য ফেস অব কোভিড’ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ছাপা হওয়া উপন্যাসের বই বিক্রি থেকে আয় আগের বছরের তুলনায় গত বছর বেড়েছে ১৬ শতাংশ, প্রবন্ধের বই বিক্রি থেকে আয় বেড়েছে ৪ শতাংশ আর শিশুতোষ বই বিক্রি থেকে আয় বেড়েছে ২ শতাংশ। তবে পাঠ্যবই বিক্রি থেকে আয় কমেছে বলে জানা যাচ্ছে। কারণ, এর মধ্যে বেশির ভাগ সময় বিলেতের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ ছিল।

এসব জরিপ প্রতিবেদনের বাইরেও ছাপা বইয়ের পক্ষে তথ্য মিলছে বিভিন্ন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের তরফে। যেমন যুক্তরাজ্যের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান নেইলসন বুকস্ক্যান বলছে, গত আট বছরের মধ্যে যুক্তরাজ্যে সর্বোচ্চ বই বিক্রি হয়েছে গত বছর। এক বছরে সেখানে বই বিক্রির পরিমাণ ২০০ মিলিয়নের বেশি হয়েছে বলে জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। অপর দিকে এশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকায় বই নিয়ে কাজ করা এনপিডি বুকসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ক্রিস্টেন ম্যাকলিন সম্প্রতি এক ওয়েবিনারে বলেছেন, গত বছর তাঁদের ছাপা বই বিক্রি বেড়েছে ৭৪ শতাংশ।

ছাপা বই ‘নাই হয়ে যাবে’ বলে কয়েক বছর ধরে যে হর্ষধ্বনি শোনা যাচ্ছিল, সেই ধ্বনির গালে তীব্র চপেটাঘাত এনে দিয়েছে এই করোনাকাল। মানুষ ফিরছেন ফের ছাপা বইয়ের গন্ধের কাছে। চীনের পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ঝ্যাং ওয়াইআইউ বলেন, করোনাকাল মানুষকে বইয়ের কাছে ফিরিয়ে এনেছে। ইউলিসিস-এর মতো ধ্রুপদি সাহিত্যের বই বিক্রি বেড়ে গেছে। কী বিস্ময়!

ছাপা বইয়ের এই উত্থানে খানিক বিস্ময় প্রকাশ করেছেন যুক্তরাজ্যের কনজ্যুমার পাবলিশার্স কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ও বনিয়ার বুকসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পারমিন্ডার মান। তিনি বলেন, ‘২০২০ সাল আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জিং ছিল। কী ঘটবে না ঘটবে, কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। কোনো কিছুই অনুমান করা যাচ্ছিল না। আমরা কস্মিনকালেও ভাবিনি, এই ঘরবন্দী সময়ে মানুষ ছাপা বইয়ের কাছে নতজানু হবে। অথচ তা-ই ঘটেছে। এত মানুষ ছাপা বই কিনেছে যে বিস্ময়কর! অভাবনীয়। এটাই প্রমাণ করে, ছাপা বইয়ের আবেদন কখনো ফুরোবে না।’

উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন খোদ যুক্তরাজ্যের পাবলিশার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান নির্বাহী স্টিফেন লটিংগাও। তিনি বলেছেন, ‘বইয়ের প্রতি ভালোবাসা ফিরিয়ে এনেছে মহামারি করোনা। মানুষ ভুলতে বসেছিল নতুন বইয়ের গন্ধ। কিন্তু করোনা সেই গন্ধের কাছে মানুষকে আবার ফিরিয়ে এনেছে।’

কোন বই পড়া হলো বেশি

সন্দেহ নেই, মানুষ ছাপা বই কিনছে এবং পড়ছে। তবে কোন ধরনের বই তাঁরা বেশি পড়লেন এই ২১ মাসের করোনাকালে? জানা গেল তা-ও। গত বছর যুক্তরাজ্যে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে শার্লি মাকেসির লেখা গ্রাফিক নোবেল দ্য বয়, দ্য মোল, দ্য ফক্স অ্যান্ড দ্য হর্স। টানা ৯৩ সপ্তাহ ধরে বইটি নিউইয়র্ক টাইমস বেস্টসেলার বইয়ের তালিকায় আছে।

তবে যুক্তরাষ্ট্রের চিত্র একটু ভিন্ন। সেখানে শিশুতোষ বই নয়, বরং গত বছর যে বইটি সবচেয়ে বেশি পড়েছে মার্কিনরা, সে বইটির লেখক সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। ওবামার আত্মস্মৃতি আ প্রমিজড ল্যান্ড সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে। বইটি শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই বেস্টসেলার হয়নি, বরং অস্ট্রেলিয়াতেও সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া বইয়ের তালিকার এক নম্বরে ছিল। অনলাইন বুকশপ আমাজন যে ২০২০ সালের বেস্টসেলার বইয়ের তালিকা প্রকাশ করেছে, সেখানেও শীর্ষে রয়েছে ওবামার এই আত্মস্মৃতি গ্রন্থ।

গত বছর আরও একটি বই প্রায় প্রতি সপ্তাহেই নিউইয়র্ক টাইমস বেস্টসেলার তালিকায় ছিল। বইটির নাম হয়্যার দ্য ক্রোড্যাডস সিং। লিখেছেন ডেলিয়া ওনস। বইটি নেইলসেনের টপ টেন বেস্টসেলার তালিকাতেও ছিল।

এদিকে নিউজিল্যান্ডে ঘটেছে আরেক কাণ্ড। সেখানে গত বছর হুট করেই জনপ্রিয় হয়েছে কোড নেম ব্যানানাস নামের এক শিশুতোষ বই। ব্যাপক বিক্রি হয়েছে বইটি এবং নিউজিল্যান্ড ক্রিসমাস নাম্বার ওয়ান তালিকায় উঠে এসেছে বইটি। ব্রিটিশ কৌতুক অভিনেতা ডেভিড উইলয়ামস যখন শখের বশে বইটি লেখেন, তখন কি ঘুণাক্ষরেও টের পেয়েছিলেন যে বইটি বেস্টসেলার হবে এই করোনাকালে?

কখন কোথায় কোন বই বেস্টসেলার হয়ে যায়, বোঝা দায়। যেমন বার্নারডাইন এভারিস্তো কখনো ভাবেনইনি, তাঁর লেখা গার্ল, উইমেন অ্যান্ড আদার বইটি এত মানুষ কিনবে ও পড়বে। বইটি যুক্তরাজ্যের নেইলসেন বেস্টসেলার তালিকা-২০২০-এ স্থান করে নিয়েছে। অবশ্য বইটি এত পরিমাণ বিক্রি হওয়ার পেছনে বুকার পুরস্কারও খানিকটা অবদান আছে। কারণ, ঠিক তার আগের বছর, অর্থাৎ ২০১৯ সালে বইটি বুকার পুরস্কার লাভ করে। বুকারজয়ী বইয়ের প্রতি মানুষের আগ্রহ জন্মাবে, এটাই স্বাভাবিক।

এই সব প্রচলিত বেস্টসেলার তালিকার বাইরে গিয়ে গত বছর থেকে শীর্ষ বিক্রি হওয়া বইয়ের তালিকা প্রকাশ করতে শুরু করেছে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম। সেই তালিকায় প্রথম কাতারে ছিল ব্রিট বেনেটের বই দ্য ভ্যানিশিং হাফ, রবিন ডিঅ্যানজেলোর হোয়াইট ফ্রাগিলটি ও ইসাবেল উইলকারসনের কাস্ট: দ্য অিজিন্স অব আওয়ার ডিসকনটেন্টস। এই তিনটি বই সবচেয়ে বেশি মানুষ কিনেছে বলে দাবি করেছে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম বুক ক্লাব।

বেস্টসেলার তালিকা দেখে বোঝো যাচ্ছে ক্রাইম থ্রিলার কিংবা শিশুতোষ বইগুলো একটু বেশি জনপ্রিয় হচ্ছে। এ নিয়েও নাখোশ কেউ কেউ। আদতে এখন সামাজিক গল্প-উপন্যাস বাদ দিয়ে রহস্য–রোমাঞ্চ ঘরানার দিকে ঝুঁকছে মানুষ! তবে যে যা-ই বলুক, থ্রিলার কিংবা শিশুতোষ—যে ধরনের বই-ই জনপ্রিয় হোক না কেন, মানুষ আবার ছাপা বই হাতে তুলে নিচ্ছে, নতুন বইয়ের গন্ধে ডুবিয়ে দিচ্ছে নাক, দহনদিনে এটাই দারুণ প্রাপ্তি।


সূত্র: ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম, স্ট্যাটিসটা, পাবলিশার্স উইকলি, দ্য গার্ডিয়ান, প্রিন্ট উইক, গ্লোবাল টাইমস ও লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস।