এ কথা ঠিক যে বই পড়ার একটি আবহ বা পরিবেশের প্রয়োজন হয়। আমাদের দেশের জীবনে তো বটেই, পৃথিবীর সব দেশেই বই পাঠের প্রয়োজনীয় সেই আবহ বা পরিবেশের ওপর আঘাত আসছে।
বই পাঠের আবহের ওপর সর্বাধুনিক এবং সবচেয়ে শক্তিশালী আঘাত ও আক্রমণ আসছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিস্ময়কর বিকাশ থেকে। দূরদর্শন তথা টেলিভিশন আর ভিডিও ক্যাসেট বা ছায়াছবি প্রদর্শনযন্ত্র তথা ভিসিআর থেকে। যে সিরিয়াস বা গুরুতর পাঠক, তারও একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বই পাঠ করতে সময়ের প্রয়োজন। পরীক্ষার্থী বা ছাত্রছাত্রীর পাঠ্যবইয়ের বাইরে শিক্ষা–সংস্কৃতিকমূলক জ্ঞানের বইয়ের কথা বলছি। সাধারণ পাঠকের এই পাঠের কথা বলছি।
এ কথা সত্যি যে এই পাঠকের সামনে জ্ঞান ও আনন্দ উভয়কে লাভের ক্ষেত্রে আজ বইয়ের জায়গায় হাজির হয়েছে টেলিভিশন আর ভিডিও। [...] টেলিভিশন ও ভিডিও দেখার চেয়ে বই পাঠ অধিক পরিশ্রমসাধ্য ব্যাপারও বটে। একখানা বই পড়তে দৃষ্টি ও মন উভয়কে একনিষ্ঠভাবে নিবদ্ধ করতে হয়। কিন্তু টেলিভিশন ও ভিডিও প্রদর্শিত কোনো দৃশ্যের ক্ষেত্রে তা নয়। তাই টেলিভিশনকে আমরা সাধারণত বইয়ের প্রতিদ্বন্দ্বী বলে গণ্য করি।
কিন্তু বিষয়টি নিয়ে যদি আমরা কিছুটা গুরুতরভাবে চিন্তা করি তাহলে এর অন্য তাৎপর্যও তো আমরা ধরতে পারি। বই বাদে কি টেলিভিশনের দৃশ্য তৈরি হতে পারে। বইমাত্র যে মূল্যবান—এমন কথা বলা যায় না। বইয়ের মধ্যে ভালো-মন্দ, কদর্য, মনোহর, সুন্দর—এসব ব্যাপার আছে। টেলিভিশনে যেসব অনুষ্ঠান দেশে দেশে এবং দেশনির্বিশেষে আন্তর্জাতিকভাবে প্রদর্শিত হচ্ছে তার মধ্যেও তো ভালো-মন্দ, কদর্য, সুন্দর অনুষ্ঠান আছে।
কিন্তু যে অনুষ্ঠানকে আমরা সুন্দর বলি, যে নাটক, যে সংগীত আমাদের হৃদয়ের মহৎ উপাদানগুলোকে দু-এক সময়ে আলোড়িত করে তোলে, টেলিভিশনে ও ছায়াশিল্পের সেসব সৃষ্টির মূলে কি বই নেই? বই বাদে কি মার্কিন টেলিভিশনের আলোড়নসৃষ্টিকারী রুটস ছবিটি তৈরি হতে পেরেছে। রুটস-এর ভিডিও তো রুটস-এর লেখকের লিখিত গ্রন্থ।
আমাদের আরও নিকটবর্তী সত্যজিৎ রায়ের নির্মিত ছায়াছবি পথের পাঁচালী, অপুর সংসার, অপরাজিত, পোস্টমাস্টার—এসবের মূলে তো বিভূতভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কালজয়ী গ্রন্থ। বই বাদে ভালো–মন্দ কোনো দৃশ্য তথা ছায়াছবিই তো তৈরি হতে পারে না।
একদিক দিয়ে দেখলে টেলিভিশনের প্রযুক্তি: তথা সংখ্যাহীন স্রষ্টার সম্মিলিত যে সৃষ্টি তা গ্রন্থমাত্রের একটি মহৎ গ্রন্থের সম্পূরক বা পরিপূরক। পথের পাঁচালী সত্যজিৎ রায়ের ছবি হিসেবে তৈরি হওয়ার পূর্বেও অবশ্যই এক মহৎ সৃষ্টি ছিল। মহৎ সৃষ্টি ছিল বলেই সত্যজিৎ রায় তাকে আরও মনোমুগ্ধকরভাবে পাঠক সাধারণের কাছে উপস্থিত করার জন্য তাঁর সৃজনী প্রতিভার সমগ্রকে অবিশ্বাস্যরূপে নিয়োজিত করেছিলেন।
তাঁর অর্থ, সম্পদ, স্বপ্ন, কল্পনা, কারিগরি কুশলতা, অভিনেতা চরিত্র অন্বেষণ, সম্মেলন ও তাঁদের পরিচালন—সবকিছুকে তিনি নিবেদন করেছিলেন পথের পাঁচালী তৈরিতে। এদিকটি ভাবতে গেলে আমাদের বিস্ময়ের আর অন্ত থাকে না। তখন মনে হয় সত্যজিৎ রায়ের পূর্বে পথের পাঁচালী যদি শক্তিমান লেখক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের একক সৃষ্টি হয়ে থাকে তবে সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালী অভূতপূর্বভাবে এক সম্মিলিত সৃষ্টি। আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে মহৎ মানুষ মহৎ সংস্কৃতি সৃষ্টিতে কীভাবে নিযুক্ত করতে পারে, তারই দৃষ্টান্ত দৃশ্যন করে গেছেন সত্যজিৎ রায়।
বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালী যেমন বাঙালিমাত্র এবং মানুষমাত্রেরই অবশ্য পাঠ্যগ্রন্থ হওয়া উচিত, তেমনি সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালী বাঙালি ও পৃথিবীব্যাপী মানুষমাত্রেরই অবশ্যদর্শনীয় ছায়াছবি হওয়া উচিত। বিভূতিভূষণ ও সত্যজিৎ রায়ের মিলিত সৃষ্টি পথের পাঁচালী। এ কারণেই একজন গুরুতর সাহিত্য পাঠককে এখন যেমন শুরু করতে হবে পথের পাঁচালী গ্রন্থের পাঠ দিয়ে, তেমনি সে পাঠকে শেষ করতে হবে পথের পাঁচালী ছবির দর্শন দিয়ে।
দর্শনের পূর্বে পাঠ এবং দর্শনের পরে পাঠ—এদিক থেকে টেলিভিশন ও ভিডিও পাঠ্য বা গ্রন্থজগৎ থেকে পাঠককে হরণ করবে—এমন আশঙ্কা অমূলক। টেলিভিশনও পাঠক তৈরি করতে সক্ষম। অবশ্য সে জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ভালো–মন্দ প্রয়োগের দিক নিয়ে আমাদের চিন্তা করতে হবে।
বিজ্ঞানের যেকোনো অধিকারই যেমন মানুষেরই সাধিত কীর্তি, তেমনি তার ভালো–মন্দ প্রয়োগ মানুষের ওপরই নির্ভরশীল। আপেক্ষিক শক্তি অবশ্যই অপরিমেয় এক শক্তি, যেমন ধ্বংসের, তেমনি সে সৃষ্টির। মানুষের সঙ্গে মানুষের, রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের আণবিক সম্পর্ক থেকে তার ধ্বংসাত্মক ব্যবহার মানুষের সভ্যতার অপরিমেয় ক্ষতি সাধিত করেছে। এখন তার সব পর্যায়ে তথা জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আণবিক শক্তির সৃষ্টিশীল ব্যবহারের পর্যায়ের নিশ্চয়ই সূচনা ঘটবে। জ্ঞানের ক্ষেত্রে টেলিভিশনের দান–অপদানের বিষয়টিকেও আমাদের এভাবে চিন্তা করতে হবে। [...]
হ্যাঁ, তবু বই পড়ার এই এক সাহায্য। আমাদের জীবনের সকল দুঃখ–কষ্ট, দৈন্যের মধ্যেও একখানি মহৎ বই আমাকে বাঁচাতে সাহায্য করে। আর তা ছাড়া বই মানেই তো জ্ঞান। জ্ঞানের প্রতিশব্দ হচ্ছে বর্বরতা। বইয়েরও পাল্টা শব্দ হচ্ছে বর্বরতা। এবং বই ‘তবুও বই পড়ুন’–এর আবেদন নয়। বই আমাদের জীবন। এ কথা নতুন জীবনের স্বপ্নস্রষ্টা বর্তমানের প্রজন্মকে বুঝতে হবে।
ভূমিকা: আনিসুর রহমান
সরদার ফজলুল করিম নিয়মিত দিনলিপি লিখতেন। মনের বিচিত্র ভাবনাগুলো অল্প কথায় টুকে রাখতেন সেখানে। তাঁর ওপর কাজ করতে গিয়ে তাঁর হাতে লেখা সেই দিনলিপিগুলোর বড় একটা অংশই পড়ার সুযোগ হয়েছে আমার। এখানে পত্রস্থ ‘তবুও বই পড়ুন’ নামে দিনলিপিটি তিনি লিখেছিলেন ১৯৯২ সালের ৬ জুন।
সেটা আজ থেকে ত্রিশ বছর আগের কথা, বিশ্বের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশের ছাপ তখন বাংলাদেশেও বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে। সমাজে বেশ পোক্তভাবে জায়গা করে নিচ্ছে টেলিভিশন আর ভিসিআরের মতো বিনোদনমূলক যন্ত্র। সেই সময়ই সরদার ফজলুল করিম অনুধাবন করতে পেরেছিলেন এসব প্রযুক্তির বিকাশ বই পাঠের জন্য প্রয়োজনীয় আবহ বা পরিবেশকে নষ্ট করবে। আবার এই প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে যে পাঠকও তৈরি করা সম্ভব, এ–ও তিনি ভেবেছিলেন সেই সময়েই। আজকের দিনের বাস্তবতায় তাঁর এই অনুধাবন ও ভাবনাগুলো যে কতটা প্রাসঙ্গিক, তা সহজেই উপলব্ধি করা যায়। সরদার ফজলুল করিমের মৃত্যুদিন উপলক্ষে ‘তবুও বই পড়ুন’ নামাঙ্কিত লেখাটির নির্বাচিত অংশ ঈষৎ সম্পাদনার মাধ্যমে এখানে মুদ্রিত হলো।