নজরুলের অগ্রন্থিত তিনটি কবিতিকা

>আন্তরিক উদ্যোগ গ্রহণ করে এখনো নজরুলের কিছু লুপ্তপ্রায় রচনা পুনরুদ্ধার করা সম্ভব। আর এ কাজটি নিঃসন্দেহে জরুরিও বটে। নজরুল-পরিকরদের উত্তরাধিকারীদের মধ্যে যাঁরা এখনো সৌভাগ্যক্রমে আমাদের মধ্যে আছেন, তাঁদের সহযোগিতা গ্রহণের শেষ সুযোগ হয়তো এখনই।

জীবনোৎসবে মেতেছিস তোরা নবযৌবন মদমাতাল

উহারা বেহেস্ত খুঁজুক শূন্যে তোরা খুঁড়ে দেখ নীলপাতাল

এসেছে যাদের কল্যাণ লাগি ধর্ম সেই সে মানুষেরে

তোরা তুলে ধর তোদের ঊর্ধ্বে তোদের ধর্ম সেই যে রে

উহারা পূজুক শাস্ত্রগ্রন্থ বিধি-আচার ও ভজনালয়

যাহাদের তরে এসব সৃষ্টি সেই মানুষের গা তোরা জয়

ভয় নাই এই নবযৌবন বিপুল স্রোতে যাবে রে ভাসি

দুই তীরের ঐ শান্তি আবাস আবর্জনার স্তূপরাশি

যে গড়ে গড়ুক তোরা বেপরোয়া ভেঙে যা ভাঙনব্রতীর দল

শূন্যের ওরা শূন্যে লড়ুক তোরা ডুবে দেখ পাতালতল

মাটির গর্ভে জ্বলে যে মানিক সাগরের তলে মুকুতারাশ

বাসুকিখানার (বাসুকিফণার) জ্বলিতেছে মণি তোরা হান হরি হানিয়া ত্রাস

কে জানে কখন উদিবে সে রবি দেখেছি তোদের অভ্যুদয়

সৃষ্টি নামিবে সে কোন প্রভাতে তোরা আন রাতে মহাপ্রলয়।

শওকত ওসমানকে লিখে দেওয়া নজরুলের কবিতিকা
শওকত ওসমানকে লিখে দেওয়া নজরুলের কবিতিকা

২.
নতুন পথের সন্ধানীরা, খোলরে দুয়ার খোল।

ঘাটের তরী ঢেউ-এর দোলায় নাচ্‌ছে উতরোল।

উদ্দাম তোর তুফান-গাজী বল্গাবিহীন ঐ

সওয়ার হারা ছুটচে একা, যাত্রী তোরা কই?

বজ্রে তোদের বাজল তূরী ঝঞ্ঝা বাজায় ঢোল

নতুন দিনের রক্ত সেনা, খোল্ রে দুয়ার খোল্।

৩.

আছে সত্যের পূর্ণ স্বরূপ

চূর্ণিত পরমাণুতে

আছে দেহাতীত অজানা অরূপ

তোমারই বদ্ধ তনুতে।

উল্লিখিত কবিতিকা তিনটি তিনজন কবিভক্তকে উপহার দিয়েছিলেন নজরুল ইসলাম। প্রথম দুটি ১৯২৮-এ সিলেট সফরকালে আর শেষটি ১৯৪০-এ কলকাতায়। কবি ১৯২৮-এর সেপ্টেম্বরে সিলেটে এসেছিলেন। প্রথম কবিতিকা সম্পর্কে প্রত্যক্ষদর্শী দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের (পরিণত বয়সে খ্যাতিমান দার্শনিক) চারণ করেছেন তাঁর স্মৃতি:

‘নজরুল ইসলামের আগমন উপলক্ষে আমাদের বন্ধু আবদুল মুহিত চৌদুরী অত্যন্ত খেটেছিল। সে কলকাতায় ইসলামিক (ইসলামিয়া) কলেজে পাঠকালে নজরুল ইসলামের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে এসেছিল বলে নজরুল তাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। সিলেট থেকে বিদায়ের প্রাক্কালে তাকে একটি স্নেহ-উপহার লিখে দিয়ে যান।

কবিতাকার শীর্ষে লেখেন--

শ্রীমান আবদুল মুহিত চৌধুরী

স্নেহভাজনেষু।’

রচনার নিচে উল্লেখ আছে--শ্রীহট্ট/১লা কার্তিক ১৩৩৫

সিলেট শহরের আম্বরখানাস্থ মাদির ভবনে অবস্থানকালে পরের দিন ২ কার্তিক ১৩৩৫ তারিখে আরেক কবি অনুরাগী আবু সা'দত মোহাম্মদ আলী আশরাফকে '‘কল্যানীয়েষু’' সম্বোধন করে কবি লেখেন দ্বিতীয় কবিতিকা।

যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য সম্পাদিত ‘শ্রীহট্ট সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা’র (চতুর্দশ বর্ষ প্রথম সংখ্যা, বৈশাখ ১৩৫৮ সংখ্যায় প্রথমটি এবং ‘আল্-ইসলাম’ পত্রিকার নজরুল সংখ্যায় (বর্ষ ৬৫) প্রকাশ পায় দ্বিতীয় কবিতিকাটি।

তৃতীয় কবিতিকাটি ‘শ্রীমান/শওকত ওসমান/কল্যাণীয়েষু’ সম্বোধনে ১৭ ভাদ্র ১৩৪৭ তারিখে কলকাতায় প্রদত্ত। পার্ক সার্কাসে নজরুল-সুহৃদ জুলফিকার হায়দরের ঝাউতলা রোডের বাসায় কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমানের খাতায় কবি এটি লেখেন।

সব খ্যাতিমানের মতোই নজরুলকেও তাঁর অনুরাগীদের আবদার রক্ষার জন্য অটোগ্রাফ-কবিতা (রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘কবিতিকা’) লিখতে হয়েছে।

আবু সা`দত মোহাম্মদ আলী আশরাফকে লিখে দেওয়া নজরুলের কবিতিকা
আবু সা`দত মোহাম্মদ আলী আশরাফকে লিখে দেওয়া নজরুলের কবিতিকা

‘নজরুল-পরিকর’ ও ‘রচনাবলী’র কিংবদন্তি সম্পাদক আবদুল কাদিরের জীবনব্যাপী সনিষ্ঠ প্রয়াসে নজরুলের কিছু কবিতিকা সংগৃহীত-সংকলিত হয়েছে। তবে এ কথা দাবি করা যাবে না, তাঁর এ ধরনের ছোট সব কবিতার হদিস মিলেছে বা সংগৃহীত হয়েছে। অনুমান করি, কিছু কিছু লেখা ভক্ত-অনুরাগীদের উত্তরাধিকারীদের কাছে হয়তো এখনো পাওয়া যেতে পারে। লুপ্ত সাময়িকপত্রের অনুসরণে নজরুলের রচনাসমূহের ভাগ্যেও একই পরিণতি ঘটেছে হয়তো। এখনো আমরা সচেতন হলে এসব অপরিজ্ঞাত লেখা অনুসন্ধান করা অসম্ভব না-ও হতে পারে। নজরুলের নামানুসারে ইনস্টিটিউট ও বিশ্ববিদ্যালয় আছে। এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মী ও ছাত্র-শিক্ষকেরা আন্তরিকভাবে উদ্যোগী হলে নজরুলের অপ্রকাশিত/অগ্রন্থিত রচনাসমূহ পুনরুদ্ধারের প্রয়াস ফলদায়ী হতে পারে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চার শতাধিক কবিতিকা ‘স্ফুলিঙ্গ’ সংকলনে সংকলিত হয়েছে। পুলিনবিহারী সেন, শোভনলাল গঙ্গোপাধ্যায় কিংবা কানাই সামন্তর মতো পরিকর নজরুলের ভাগ্যে জোটেনি। বেচারা আবদুল কাদিরের একক প্রচেষ্টায় নজরুলের অনেক লেখা রক্ষা পেয়েছে। কিন্তু আগেই বলেছি, কিছু কিছু লেখা এখনো অগ্রন্থিত রয়ে গেছে, যার পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। সিলেট শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জফির সেতু অতিসম্প্রতি যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য সম্পাদিত ‘শ্রীহট্ট সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা’ ও মুহম্মদ নুরুল হক প্রতিষ্ঠিত কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের মুখপত্র ‘আল-ইসলাম’ থেকে কবির স্বাক্ষর করা দুটি কবিতিকা উদ্ধার করে আমাকে পাঠিয়েছেন। শামসুজ্জামান খান সম্পাদিত ‘জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১১৪তম জয়ন্তী স্মরণীকা’য় মনিরুজ্জামানের রচনা ‘চট্টগ্রামে নজরুল’ থেকে পেয়েছি একটি কবিতিকা। আবার সেলিনা বাহার জামানের ‘নির্বাচিত বুলবুল’-এর পাতা ওল্টাতে পেয়ে গেলাম একটি কবিতিকা (২০ সেপ্টেম্বর ১৯৪১-এ লেখা: ‘আঁধার হেরেমে তোমরা দিব্য দীপ্তি সঞ্চারিকা’)। কবিতিকাটি লেডি ব্রেবোর্ন কলেজের এক ছাত্রীকে লিখে দিয়েছিলেন কবি। মনিরুজ্জামান উল্লেখ করেছেন, শামসুন্নাহার মাহমুদ নজরুলের দুটি অটোগ্রাফ সংগ্রহ করেছিলেন তাঁর কলেজের ছাত্রীদের থেকে।

সুধীর সেন ‘চতুরঙ্গ’ পত্রিকায় (জুন ১৯৯০) চারণ করেছেন নজরুল-স্মৃতি: প্রেসিডেন্সী কলেজের অধ্যাপক খগেন্দ্রনাথ মিত্রের কিশোর পুত্র মিহির মিত্রকে নজরুল একটি কবিতা লিখে দিয়েছিলেন: ‘তোমরা কবি, তোমরা মুকুল, তনুর কিশলয়ে’... (কাজী নজরুল: স্মৃতির পাতা থেকে)।

সাহিত্যানুরাগীরা সক্রিয় হলে এসব লুপ্ত রত্ন যে উদ্ধার করা যেতে পারে, এবার এমন কিছু ঘটনার উল্লেখ করি। মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন সিলেট মুরারীচাঁদ কলেজে অধ্যাপনাকালে একটি আশীর্বাদী কবিতা সংগ্রহ করে তৎকালের পত্রিকা ‘ইমরোজ’-এর প্রথম সংখ্যায় প্রকাশ করেছিলেন। বিশ্বভারতীর রবীন্দ্রভবন মহাফেজখানা থেকে ‘উত্তরা’ পত্রিকায় মুদ্রিত ‘মৃত্যুহীন রবীন্দ্র’ কবিতাটি আমাকে পাঠিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের ‘কবিতা সমগ্র’র সম্পাদক অনাথনাথ দাস। আমরা সিলেট কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত ‘কৃষক’ পত্রিকা থেকে দুষ্প্রাপ্য ও বইয়ে অপ্রকাশিত ‘আগুন’ কবিতাটি উদ্ধার করি (দেখুন, ‘নজরুল রচনাবলী’, জন্মশতবর্ষ সংস্করণ, বাংলা একাডেমি, একাদশ খণ্ড)। ড. ইসরাইল খান নজরুলের অজানা কবিতা ‘ঢাকার দাঙ্গা’ আবিষ্কার করেছেন। ড. আবুল আহসান চৌধুরী কুষ্টিয়ার কুমারখালীর একটি ধর্মীয় সংগঠনের প্রকাশিত ভাঁজপত্র থেকে নজরুলের দীর্ঘতম গান সংকলন করেছেন মাসিক ‘কালি ও কলম’ পত্রিকায়।

এসব তথ্য উল্লেখ করছি এ কারণে যে আন্তরিক উদ্যোগ গ্রহণ করে এখনো নজরুলের কিছু লুপ্তপ্রায় রচনা পুনরুদ্ধার করা সম্ভব। আর কাজটি নিঃসন্দেহে জরুরিও বটে। নজরুল-পরিকরদের উত্তরাধিকারীদের মধ্যে যাঁরা এখনো সৌভাগ্যক্রমে আমাদের মধ্যে আছেন, তাঁদের সহযোগিতা গ্রহণের শেষ সুযোগ হয়তো এখনই। তাই লুপ্ত নজরুল-রচনা সংগ্রহ অভিযান শুরুর আবেদন করি নজরুল ইনস্টিটিউট ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে।

স্বীকৃতি: জফির সেতু, আবুল কাসেম ফজলুল হক, আবুল আহসান চৌধুরী ও রাশেদুল আনাম।

অন্য আলো অনলাইনে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]