পার্শ্ববর্তিনী

অলংকরণ: এস এম রাকিবুর রহমান

তিনতলার বারান্দা থেকে নায়িকার বাংলো বাড়িটা দেখা যায়। স্পষ্ট চোখে পড়ে বারান্দার একটা অংশ, সামনের বাগান আর ছিমছাম প্রবেশপথটা। তিনি যখন বারান্দায় বসে কাগজ পড়েন কিংবা বাগানে কাজ করেন, যুবক তাকিয়ে থাকে। এটা কেবল তাকেই দেখা নয়, বহুদূরের কৈশোরকে দেখা, যখন সিনেমা হলের আবছা অন্ধকারে বসে সে দেখেছে তাকে, উজ্জ্বল পর্দায় নানা কাহিনির ভেতর। এখন বারান্দায় বসে চায়ে চুমুক দিতে থাকা সেই নায়িকাকে দেখে যুবকের মনে হয় তার কৈশোর ঠান্ডা বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ছে গায়ে। সেই জনপ্রিয় নায়িকা এখন এই দেশে এসে বাস করছেন এবং যুবক তাকে দেখতে পাচ্ছে এত কাছ থেকে, যা সে কখনো কল্পনাও করতে পারেনি।

নায়িকাকে দেখার জন্য যুবক যখন বারান্দায় এসে দাঁড়ায়, তখনই তার মাথার ভেতর মেঘ ঘনিয়ে আসে—নদীপাড়ে তার কৈশোরের শহর, সরু গলির ভেতর হাঁটা, সিনেমা হলগুলোর পাশে শহরের মাঝখানে দাঁড়ানো পিঠ-উঁচু ব্রিজ, গ্রামের দিকে যাওয়ার বাঁকা রাস্তা এবং কৈশোরের দিন-রাতগুলো শুকনো পাতার মতো ঝরে পড়তে শুরু করে তার ওপর।

পেছন থেকে যুবতী ডাকে, ‘নায়িকাকে দেখো? এখনো এত প্রেম!’

‘হ্যাঁ।’

‘ভেতরে এসো।’

যুবক ঘরে যায়।

‘উনি কি খুব জনপ্রিয় ছিলেন?’

‘খুবই।’

‘কিন্তু কেন এমন নির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছেন?’

‘তা জানি না। হয়তো ভক্তদের সামনে বুড়িয়ে যেতে চান না।’

যুবক হাসে।

যুবতী বাথরুমে ঢোকে। যুবক তার স্নানের শব্দ শোনে। কিছুক্ষণ পর সে বেরিয়ে আসে গায়ে তোয়ালে জড়িয়ে। যুবক তার দিকে দেখে। তার ভেজা চুল, নগ্ন ঊরু ও গ্রীবার দিকে তাকিয়ে সে সেই মুহূর্তগুলোর ফিরে আসা অনুভব করে, যার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে দূরের কৈশোর, দূরের দেশ, দূর থেকে দেখা প্রেম, কৈশোরের স্বপ্নে ঢুকে পড়া—সবকিছু। যুবক সেই সময়ের বিহ্বলতার ভেতর স্থির হয়ে থাকে। এমন মুহূর্তগুলোর ফিরে আসার জানালায় দাগ দিয়ে রাখে সে।

রাতের বেলা বারান্দায় বাতাসে দাঁড়িয়ে যুবকের কাছে নিজের দেশ আর কৈশোরকে মনে হয় সমান দূরবর্তী।

যুবতী যখন তার ঘরে নগ্ন শিশুর মতো সহজ আনন্দে ঘুরে বেড়ায়, তার মধ্যে একই সঙ্গে শৈশব ও যৌবনের বিরোধাভাস ফুটে ওঠে। যুবক এই অনুভবটাকেও মনে মনে দাগ দিয়ে রাখে।

যুবক প্রায়ই বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে—একা, নায়িকার বাড়িটাকে পেছনে রেখে। কখনো সে একটা মাহেন্দ্র ক্ষণকে অনুভব করে, যেই মুহূর্তে তিনি একই সঙ্গে দূরের এবং কাছের। ঘরের ভেতরকার কিছু সময় এসে জড়িয়ে যায় একই মুহূর্তের সঙ্গে, ঠিক যেমন কিশোরবেলার সঙ্গে দূরসম্পর্কে জড়িয়ে থাকে যৌনতা। এবং এখন, একসঙ্গে সবকিছুর ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে দখিনা বাতাস।

যুবতী ভেতরে ডাকে। সে নগ্ন দেহে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে বিছানায়। সমুদ্রসৈকতে যাওয়ার ছবিগুলো দেখতে দেখতে সে জিজ্ঞেস করে, ‘এটা তোমার সেই নায়িকা না?’

‘কই কই?’

‘আমার ঠিক পাশের ছাতার নিচে শুয়ে আছেন।’

যুবক ছবিটা দেখে। তাকে চেনামাত্রই সে সমুদ্রের স্বর শুনতে পায়। তীরে আছড়ে পড়ে ছোট আর বড় বড় ঢেউ।