কাকের আন্দোলন

অলংকরণ: তুলি
অলংকরণ: তুলি

কাকে ছেয়ে গেছে পুরো বাড়ি। শত শত কাক। ঝাঁকে ঝাঁকে কাক। গাছের ডালে, ঘরের চালে কাক। কা কা করে পুরো বাড়ি মাথায় তুলছে। উড়ছে। বসছে। আবার উড়ছে। অস্থির কাকগুলো।
অস্থির হয়ে গেলেন বাবাও। নিশ্চয়ই কাকদের কোনো সমস্যা হয়েছে। কোনো কাক মারা গেছে নয়তো আঘাত পেয়েছে। তা-ও আমাদের বাড়ির আশপাশেই। এ জন্যই কাকেরা আন্দোলনে নেমেছে। কা কা করে প্রতিবাদ করছে। ‘মানুষের ওপর অবিচার করলে মানুষেরা যেমন একতাবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদ করে, কাকেরাও তেমন একতাবদ্ধ। যদিও মানুষে মানুষে ঐক্য এখন আর খুব একটা নেই। কিন্তু কাকেরা আজও একতাবদ্ধ। তারা প্রকৃতির বন্ধু, উপকারী পাখি। তারা প্রতিবাদীও।’
বাবা উঠানের মধ্যে সবাইকে জড়ো করে কথাগুলো বললেন। কেউ বুঝল। কেউ না বুঝেও মাথা নাড়ল।
আমি আর সুমন ছোটবেলার বন্ধু-সহপাঠী। আমাদের দায়িত্ব পড়ল, পুরো বাড়ি খুঁজে দেখা। কাকদের আন্দোলনের ইস্যু বের করা।
দায়িত্ব পেয়ে আমরা দুজন নেমে পড়লাম। সুমন টিনের চালে উঠল। আমি আমগাছে। এক এক করে প্রায় সবগুলো গাছ খোঁজা হলো। টিনের চালে, রান্নাঘরের চালে খোঁজা হলো। না, কোথাও আহত কিংবা নিহত কাকের দেখা নেই।
বাবা খেয়াল করলেন, ঘরের পেছনে যেখানে কলাগাছের বাগান সেখানে কাকের সংখ্যা বেশি। আমরা কলার বাগানে ঢুকলাম। দেখলাম একটি কাকের মৃতদেহ কে যেন বাঁশের কঞ্চির সঙ্গে বেঁধে রেখেছে।
আমরা রহস্য উদ্ঘাটন করতে পেরে খুশি। কিন্তু বাবার মুখ বিষণ্ন দেখতে পেলাম। তিনি সবাইকে আবার জড়ো করলেন।
বাবা রেগে আছেন। এমন গুরুতর অন্যায় তিনি মানতে রাজি নন। সবার উদ্দেশে তিনি বললেন, ‘বাড়িতে প্রতিদিন মাছ, মাংস, তরিতরকারি কাটা হয়। উচ্ছিষ্টগুলো ফেলে দেওয়া হয়। কাক সেসব খেয়ে পরিবেশ রক্ষা করছে। দুর্গন্ধ থেকে আমাদের হেফাজত করছে। একসময় মোরগের ডাকে ঘুম ভাঙত মানুষের। এখন কাকেরা আমাদের জাগিয়ে দেয়। আরও অনেক অনেক উপকার করে এই বন্ধুপাখি। সুতরাং তাদের নিরাপত্তা দেওয়াও আমাদের বড় দায়িত্ব।’
কথা শেষ করে বাবা সবার দিকে তাকালেন। জানতে চাইলেন, ‘এই কাজটি কে করেছে?’
কারও মুখে কোনো রা নেই।
এমন সময় আমাদের কাজের চাচা আনু মিয়া এসে হাজির হলো। আনু মিয়া জটলা দেখে উত্সাহী হয়ে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে সবার মুখের দিকে তাকাল।
বাবা আনু চাচাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আনু বাড়ির পেছনে একটি মরা কাক পাওয়া গেছে। ওটা কি তোমার কাজ?’
আনু মিয়া হাসি হাসি মুখ করে বলল, ‘হ ভাইজান, কাকগুলান বড়ই বজ্জাত প্রাণী। মাইনষেরে ঠিকমতো কামকাজ করতে দেয় না। আবার ছোডো ছোডো মুরগির ছাও পাইলে তুইল্যা নিয়া যায়। আর কলা পাকলে তো সব খাইয়া শেষ কইরা দিব, হেই জন্যি কাকটারে মাইরা থুইয়া দিছি। একটারে মরা দেখলে সবগুলান পলাইব।’
বাবা ধমক লাগালেন আনু মিয়াকে। বললেন, কাকেরা একটুখানি ক্ষতি করলেও উপকার করে তার চেয়ে বহুগুণ। আর কোনো দিন এমন কাজ করবে না। তুমি বলছ কাক পালাবে। তোমার ধারণা ভুল। দেখো, কাকেরা তাদের সঙ্গী হত্যার প্রতিবাদ জানাতে এসেছে। ওরা তোমাকে খুঁজছে। যাও, কাকটিকে সযত্নে মাটিতে পুঁতে দিয়ে আসো। তাতে যদি কাকদের আন্দোলন থামে।’
আনু চাচা মাটি খোঁড়ার খুন্তি হাতে মরা কাকটি নিয়ে চলল কবর দিতে, আর কাকগুলো ঝাঁকবেঁধে উড়ে উড়ে আনু চাচার মাথায় মলত্যাগ করে বন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নিতে লাগল।