অজানা এক আখ্যান
গোয়ালপাড়া পাওয়ার স্টেশনে ছয় ঘুমন্ত প্রকৌশলীর গল্প
১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর। বাংলাদেশের মানুষ যখন বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে, তখনই খুলনায় একটি বোমার আঘাতে মারা গেলেন ছয় প্রকৌশলী। তাঁরা এখনো ঘুমিয়ে আছেন খুলনার গোয়ালপাড়া পাওয়ার স্টেশনে। কী ছিল তাঁদের কাহিনি?
আমার সবচেয়ে ছোট ভাই রেজিনের জন্ম হয়েছিল ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে, যুদ্ধ শুরু হওয়ার ঠিক আগমুহূর্তে। আব্বার পোস্টিং তখন খুলনার খালিশপুরে, গোয়ালপাড়া পাওয়ার স্টেশনের ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন তিনি। পাওয়ার স্টেশনটা একেবারে নদীর ধারে, আমাদের বাসাটাও ছিল সেই কম্পাউন্ডের মধ্যে। শান্ত, সুন্দর, স্নিগ্ধ জায়গাটা এখনো তেমনই আছে।
আমার আব্বার নাম আবদুল মান্নান। সিলেটের কুমারপাড়ার বাসিন্দা ছিলেন তিনি। মেধাবী ছিলেন খুব। পাকিস্তান সরকারের বৃত্তি নিয়ে ইতালির তুরিন শহরে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিতে গিয়েছিলেন, সে সময়ই আমার জন্ম। এ কারণেই আমার ডাকনাম তুরিন, পরিবারে সবাই আমাকে এ নামেই ডাকে। ইতালি থেকে পড়াশোনা শেষে ফিরে এসে প্রথমে তাঁর পোস্টিং হয় চট্টগ্রামের পতেঙ্গায়, কর্ণফুলী নদীর তীরে আমাদের সেই সরকারি বাসাটার কথা আমার এখনো মনে পড়ে। সেখানে আমার মেজ ভাই তুহিনের জন্ম হয়। তারপর আমরা চলে যাই খুলনায়। আর তারপরই শুরু হয় একাত্তরের যুদ্ধ।
আমার তখন মোটে চার বছর বয়স, কিন্তু অনেক কিছুই আমার এখনো স্পষ্ট মনে পড়ে। আমার মনে পড়ে রাতের বেলায় যখন এয়ার রেইড হতো, আব্বা বাড়ির সব আলো নিভিয়ে দিতেন, আর আমরা সবাই খাবার টেবিলের নিচে লুকিয়ে থাকতাম। সকালবেলা আব্বা অফিস চলে গেলে আমাদের আতঙ্ক বাড়ত। আমার মেজ ভাই তুহিন—তখন যার দুই বছর বয়স—আব্বাকে বলত, তিনি যেন একটা শক্ত ছাতা দিয়ে যান, যাতে সে ওটা দিয়ে বোমা ঠেকাতে পারে! আমার এ–ও মনে পড়ে, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আমরা অনেকগুলো পরিবারের সঙ্গে একটা বড় নৌকায় করে গ্রামের দিকে পালিয়েছিলাম; কোনো এক জায়গায়, সম্ভবত একটা হলঘর বা স্কুলঘরে হবে, অনেক মানুষ গাদাগাদি করে একসঙ্গে ঘুমিয়েছিলাম।
যাহোক, অনেক মৃত্যু, অনেক রক্ত, অনেক বেদনার পর যুদ্ধ একসময় শেষ হতে চলল। আমরা বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে। ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর দিনটার কথা আমার এখন আলো–আঁধারির মতো ঝাপসা মনে পড়ে, যে দিনটা আমাদের সবার জীবন চিরতরে বদলে দিয়েছিল।
একটা চমৎকার সুন্দর শীতের রৌদ্রোজ্জ্বল সকাল ছিল সেটা। গাঢ় নীল আকাশ ছিল, ছিল ঝকঝকে সোনালি রোদ। নদীর ওপার থেকে একটা বোমার শেল উড়ে এসে পড়ল আমাদের প্রতিবেশীর বাগানে, কিন্তু সেটা ফাটল না। পাওয়ার স্টেশনে থাকা আব্বা আর তাঁর সহকর্মীরা শুনে ছুটে এলেন। তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন যে বোমাটা দ্রুত নিষ্ক্রিয় করতে হবে, নয়তো পুরো পাওয়ার স্টেশন তো বটেই, গোটা এলাকা পড়ে যাবে হুমকির মুখে। বোমা নিষ্ক্রিয় করার সময় একজন প্রকৌশলী যখন একটা ফিউজ সাবধানে বের করতে গেলেন, তখনই ঘটল দুর্ঘটনা। চারপাশ কাঁপিয়ে বোমাটি ফেটে গেল। পাঁচজন প্রকৌশলী ঘটনাস্থলেই শহীদ হলেন। আব্বা আর আরও একজন তখনো বেঁচে ছিলেন। আম্মা খবরটা শুনে একছুটে বেরিয়ে গেলেন, এখনো মনে পড়ে আমার, আমাদের তিন ভাইকে বাসায় একমাত্র গৃহকর্মী কিশোরী লাইলির কাছে রেখে। আম্মা আব্বাকে অনেক কষ্টে একজন প্রতিবেশীর বাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন শুশ্রূষা করার জন্য। সেদিন আম্মা সেখানে কী দৃশ্যের সম্মুখীন হয়েছিলেন, তা কখনো আমরা তাঁকে জিজ্ঞেস করিনি। সংগত কারণেই তিনি নিজেও এ নিয়ে কখনো কথা বলতে চাননি।
আব্বা সম্ভবত মৃত্যুর আগে তাঁর ছোট ছোট ছেলেদের দেখতে চেয়েছিলেন। তাই অফিসের একটা সাদা জিপ নিয়ে একজন ড্রাইভার আমাদের নিতে এলেন, আমরা লাইলিসহ সেই জিপে উঠলাম। মনে পড়ে, জানালা দিয়ে আমি আব্বাকে দেখতে পেলাম, একটা বিছানার ওপর শুয়ে আছেন, পাশে আরেকটা বিছানায় অন্য আহত প্রকৌশলী। আব্বার পায়ে আঘাতের চিহ্ন ছিল, রক্ত ঝরছিল। সে সময় হাসপাতালে বা ডাক্তারের কাছে নেওয়ার প্রশ্নই ছিল না, তাই অতিরিক্ত রক্তপাতের কারণেই আব্বা মারা যান। তারপর কিছু পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা এসে আদেশ করল যে বাগানে বোমাটি ফুটেছে আর একটা বড় গর্ত সৃষ্টি হয়েছে, সেখানেই যেন সবাইকে কবর দেওয়া হয়। আমরা সে রাতটা প্রতিবেশীর বাসায়ই কাটালাম। সে রাতে সাদা খিচুড়ি দিয়ে রাতের খাবার সেরেছিলাম, সাদা খিচুড়ি আমার খুবই অপছন্দের খাবার! মনে পড়ে, আম্মা জোরে জোরে দোয়া পড়ছিলেন মোকসেদুল মুমিনিন থেকে, যে দোয়া পড়ছিলেন তার মর্মার্থ পরে বড় হয়ে বুঝেছি—আমাদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট, তিনিই সব ঘটনার হর্তাকর্তা!
একটা চমৎকার সুন্দর শীতের রৌদ্রোজ্জ্বল সকাল ছিল সেটা। গাঢ় নীল আকাশ ছিল, ছিল ঝকঝকে সোনালি রোদ। নদীর ওপার থেকে একটা বোমার শেল উড়ে এসে পড়ল আমাদের প্রতিবেশীর বাগানে, কিন্তু সেটা ফাটল না। পাওয়ার স্টেশনে থাকা আব্বা আর তাঁর সহকর্মীরা শুনে ছুটে এলেন। তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন যে বোমাটা দ্রুত নিষ্ক্রিয় করতে হবে, নয়তো পুরো পাওয়ার স্টেশন তো বটেই, গোটা এলাকা পড়ে যাবে হুমকির মুখে।
খুলনা ক্রিসেন্ট জুট মিলে আম্মার খালাতো ভাই শাহজাহান মামা চাকরি করতেন। তিনি পরদিন এসে আমাদের তাঁর কাছে নিয়ে গেলেন। তারপর সিলেট থেকে কয়েক দিন পর নানা আমাদের নিতে এলেন। সিলেট যাওয়ার আগে আমরা খালিশপুরে আমাদের ফেলে আসা কিছু জিনিসপত্র নিতে গেলাম। আব্বা ইতালি থেকে একটা নীল রঙের ফিয়াট ৫০০ গাড়ি এনেছিলেন। আব্বার আনা সেই গাড়ি দিয়েই আমরা চিরতরে খুলনায় আব্বাকে চিরতরে ফেলে চলে এলাম। দীর্ঘ যাত্রাপথটা আমার বেশ মনে পড়ে। যুদ্ধে নানা জায়গায় ব্রিজ, সেতু, রাস্তা উড়ে গেছে। আমাদের অনেক ঘুরে, অনেকবার ফেরি পার হয়ে সিলেট যেতে হয়েছিল। তত দিনে দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। আমরা ফিরেছি বিজয়ের আনন্দে উদ্ভাসিত পথঘাট প্রান্তর পেরিয়ে। কিন্তু আমাদের কারও মনে আনন্দ ছিল না।
বাংলাদেশের ছয়জন মেধাবী প্রকৌশলী একটি বাগানে এখনো সমাধিস্থ আছেন খুলনার খালিশপুরে। ছোট্ট নির্জন পথের ধারে, একটা সবুজ পুকুরের পাশে, শান্ত সমাহিত পরিবেশে। বাগানটির চারদিকে সাদা দেয়াল তোলা হয়েছে, প্রতিটি কবরের সামনে নামফলকে নাম উৎকীর্ণ করা আছে। আমার আব্বার কবরটি বাঁ দিক থেকে প্রথমটি। শেষ ২০১১ সালে আমি সেখানে গিয়েছিলাম। বর্তমানে পাওয়ার স্টেশনটি বেসরকারীকরণ হয়েছে, কিন্তু তাঁরা শহীদ কবরস্থানটিকে দেখভাল করে থাকেন। একবার আমরা যখন সেখানে গিয়েছিলাম, চিফ ইঞ্জিনিয়ার সাহেব আমাদের পাওয়ার স্টেশনটি ঘুরে দেখিয়েছিলেন, গেস্টহাউসে রাতে থাকতে দিয়েছিলেন। আশ্চর্য, ছোটবেলায় যে গেস্টহাউসের খাবার খুবই বিস্বাদ লাগত, সেবার ওখানকার খাবার আমার কাছে অমৃতের মতো সুস্বাদু লাগছিল!
মোহাম্মদ আবদুল মুঈজ চৌধুরী: চিফ ফিন্যান্সিয়াল অফিসার, আরকাপিটা, মানামা, বাহরাইন।