উন্নয়নে গতির জন্য চাই সক্ষম চট্টগ্রাম বন্দর

চট্টগ্রাম বন্দরপ্রথম আলো ফাইল ছবি

১৯৭৪ সালের আগস্ট মাসে ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে ভর্তির আগের দিন আমার এক মামা আমাকে চট্টগ্রাম বন্দর দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন। এখনো মনে আছে, তিনি বলেছিলেন, চট্টগ্রাম বন্দর হচ্ছে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের লাইফলাইন বা অর্থনীতিকে চাঙা করার মহৌষধ। পরবর্তী সময়ে ২০০৭-০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় জেনেছি এই বন্দরের প্রচুর সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও আমরা কেন পিছিয়ে। শুনেছি শ্রমিক আন্দোলন বা স্থানীয় নেতৃত্বের উসকানিতে কীভাবে বারোটা বেজেছে বন্দরটির। জেনেছি কোথায় কোথায় কাজ করলে আমাদের অর্থনীতির এই ‘লাইফলাইনটি’ আরও শক্তি-সামর্থ্য নিয়ে উঠে দাঁড়াতে পারে। হতে পারে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সমার্থক।

বিগত ৩০ বছরে দেশে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমের ব্যাপকতা বৃদ্ধির ফলে চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রমেরও ব্যাপ্তি বেড়েছে। তথ্যমতে, প্রতিবছর গড়ে প্রায় ১২ শতাংশ হারে বাড়ছে কার্গো-কনটেইনার হ্যান্ডেলিং। সরকার গৃহীত উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে এ হার আরও বাড়বে নিশ্চিত। তবে জাহাজের আগমন বাড়লেও পিক সিজনে (এপ্রিল-অক্টোবর) চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রমে বিরাট প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখা দেয় জেটির অপ্রতুলতা।

চট্টগ্রাম বন্দর
প্রথম আলো ফাইল ছবি

শুধু জেটির অপ্রতুলতা নয়, দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দরটির যথাযথ ব্যবহারে ১৬ ধরনের সমস্যা চিহ্নিত করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজেই। বন্দরটির কী কী সমস্যা ও তা সমাধানের উপায় জানতে চেয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির এক সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি সংসদীয় কমিটির কাছে একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করেছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। সেখানে ১৬টি সমস্যার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সেই সঙ্গে এসব সমস্যা সমাধানের উপায়ও বাতলাতে চেষ্টা করেছে কর্তৃপক্ষ।

আগেই বলেছি, প্রতিবেদনে তারা যেসব সমস্যা চিহ্নিত করেছে, তার মধ্যে প্রথমেই রয়েছে জেটির অপ্রতুলতার বিষয়টি। এ সমস্যার সমাধানে দ্রুত পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল (পিসিটি), মাতারবাড়ী পোর্ট ও বে টার্মিনালের নির্মাণকাজ শেষ করা এবং পুরোনো জেটিগুলোর প্রয়োজনীয় সংস্কারের সুপারিশ করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ।

প্রতিবেদনে দ্বিতীয় যে সমস্যাটির কথা বলা হয়েছে সেটি হলো, পর্যাপ্ত কার্গো ও কনটেইনার হ্যান্ডেলিং ইক্যুইপমেন্ট বা সরঞ্জামাদি সংগ্রহে না থাকা। এ বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কার্গো ও কনটেইনার হ্যান্ডেলিং বৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে হ্যান্ডেলিং যন্ত্রপাতি সংগ্রহ অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয়। অধিকাংশ ইক্যুইপমেন্ট একনাগাড়ে কর্মক্ষম রাখার প্রয়োজনে প্রায় ২৫ শতাংশ সার্ভিসিংয়ে থাকে। তাই কখনো কখনো অপারেশনাল বা পরিচালন কার্যক্রমে ইক্যুইপমেন্ট সংকট পরিলক্ষিত হয়। এ সমস্যার সমাধান হিসেবে বন্দর কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় ইক্যুইপমেন্টের তুলনায় ২৫ শতাংশ বেশি সংগ্রহ করে রাখার কথা বলেছে, যাতে কিছুসংখ্যক যন্ত্রপাতি মেরামতে থাকলেও অন্যান্য যন্ত্রপাতি দিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে বন্দরের পরিচালন কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়।

তৃতীয় সমস্যা হিসেবে কনটেইনার সংরক্ষণের ইয়ার্ড বা স্থান সংকুলানকে চিহ্নিত করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। এ সমস্যা প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে কনটেইনারবাহী আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের পরিমাণ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্ধিত পরিমাণ কনটেইনার সংরক্ষণের জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষ পর্যায়ক্রমে ইয়ার্ড ও স্পেস বৃদ্ধি অব্যাহত রেখেছে। তবে ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ সময়সাপেক্ষ বিধায় সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কনটেইনার সংরক্ষণের ইয়ার্ড বৃদ্ধি করা যায়নি। এর ফলে কখনো কখনো কনটেইনার সংরক্ষণ স্থানের সংকট দেখা দেয়। এ সমস্যা সমাধানে দ্রুত সময়ে কনটেইনার সংরক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত ইয়ার্ড বা স্পেস নির্মাণ করা এবং বে-টার্মিনাল এলাকায় চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য ডেলিভারি ইয়ার্ড নির্মাণের কাজ সম্পন্ন করা প্রয়োজন। পাশাপাশি নতুন নতুন অফডক স্থাপনের অনুমোদন প্রদান করা হলে এ সমস্যা সহজে লাঘব হবে বলে প্রতিবেদনে মত প্রকাশ করা হয়েছে।

চট্টগ্রাম বন্দর
প্রথম আলো ফাইল ছবি

সম্প্রতি শিপিং-বিষয়ক প্রাচীনতম জার্নাল লয়েড’স লিস্ট বিশ্বের ১০০ বন্দরের ২০২০ সালের সংস্করণ প্রকাশ করেছে। বিশ্বের ১০০ ব্যস্ততম বন্দরের মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরের বর্তমান অবস্থান ৫৮। জার্নালটির মতে, চট্টগ্রাম বন্দর ২০১৯ সালে ৩০ লাখ ৮৮ হাজার ১৮৭ টিইইউ (২০ ফুট দীর্ঘ) কনটেইনার পরিচালনা করেছে, ২০১৮ সালে যার পরিমাণ ছিল ২৯ লাখ ৩ হাজার ৯৯৬ টিইইউ। আগের থেকে এই বন্দরে কনটেইনার পরিবহনের বার্ষিক হার ৬ দশমিক ৩ শতাংশ বেড়েছে। যার ফলে, চট্টগ্রাম বন্দর ২০১৮ সালের অবস্থান থেকে ৬ ধাপ এগিয়েছে। ২০১৭ সালে চট্টগ্রাম বন্দরের অবস্থান ছিল ৭০ যা ২০১৬ তে ছিল ৭১। ২০১৫ তে ৭৬ এবং ২০১৪ তে ছিল ৮৭ তম। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক বাণিজ্যের কারণে চট্টগ্রাম বন্দরের কনটেইনার পরিবহন ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। শুধু চট্টগ্রাম বন্দর দেশের মোট কনটেইনার পরিবহনের ৯৮ শতাংশ পরিচালনা করে থাকে আর বাকিগুলো পরিচালনা করে মোংলা বন্দর।

বিশ্বের ১০০ ব্যস্ত বন্দরের মধ্যে চীনের সাংহাই বন্দর ২০১৯ সালে ৪৩ দশমিক ৩০ মিলিয়ন টিইইউ নিয়ে শীর্ষ স্থানে আছে। বস্তুত এই তালিকায় মোট ২৫টি চীনা বন্দর স্থান পেয়েছে। শ্রীলঙ্কার কলম্বো বন্দর গত দুই বছরে (২০১৯ ও ২০১৮) ২৪তম স্থান ধরে রেখেছে। তালিকায় থাকা ভারতের দুই বন্দর জওহরলাল নেহরু বন্দর ৩৩ এবং মুন্ড্রা ৩৭তম অবস্থানে আছে। পাকিস্তানের করাচি বন্দর থেকে চট্টগ্রাম বন্দর ২৭ ধাপ এগিয়ে আছে। করাচির অবস্থান ৮৫তম।

আমরা নিশ্চিত, বিদেশি মার্সকলাইন বা আমেরিকান প্রেসিডেন্ট লাইনস নয়, শুধু বন্দর কর্তৃপক্ষের প্রস্তুত করা করণীয় বা লন্ড্রি লিস্টটি ধরে ভালোভাবে কাজ করতে পারলেই চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা ও দক্ষতা বাড়বে। এ ক্ষেত্রে প্রযুক্তি সহায়তার বিষয়টিকে আরও গুরুত্ব দিতে হবে। সেই সঙ্গে বন্দর ব্যবস্থাপনা টিমের দক্ষতা বৃদ্ধির বিষয়টিও নজর এড়ালে চলবে না।

মামুন রশীদ: অর্থনীতি বিশ্লেষক