একটি ধানের শিষের উপরে...

আমরা ছোট জিনিসের মধ্যে কত বড় সাফল্য ও সৌন্দর্য লুকিয়ে থাকতে পারে সেটা অনেক সময় যথাযথরূপে উপলব্ধি করতে পারি না।
সে জন্যই হয়তো অনেক আগে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলে গেছেন, ‘দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা,/ দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু/ দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া/ ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া/ একটি ধানের শিষের উপরে/ একটি শিশিরবিন্দু।’

৪৩ বছর আগে ১৯৭০ সালের এ দিনে (১ অক্টোবর ১৯৭০) জন্ম নেওয়া বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) সাফল্যের কথা স্মরণ করতে গেলে কবিগুরুর অমর উক্তি খুব স্বাভাবিকভাবেই স্মরণ করতে হয়।
এটি এমন এক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান, যার সফলতা পরিমাপের জন্য কোনো সমীক্ষা চালাতে হয় না। দিগন্ত বিস্তৃত মাঠজুড়ে একনজর তাকালেই তা সহজেই চোখে পড়ে। বোরো মৌসুমে তেঁতুলিয়া থেকে টেকনাফ অবধি যেকোনো বড় হাওর বা বিলে গিয়ে চাষিরা কোন ধানের জাত আবাদ বেশি করেছেন, এ প্রশ্ন করলেই তাঁরা হয় ব্রি ধান ২৮ অথবা ব্রি ধান ২৯-এর কথা বলেন। আমন মৌসুমে অনুরূপ প্রশ্নের জবাবে তাঁরা বলেন, বিআর ১১-এর কথা। শুধু এগুলো নয়, ব্রি এ পর্যন্ত তিন মৌসুমে চাষাবাদের উপযোগী ৬৫টি উচ্চ ফলনশীল (উফশী) ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে। এদের ফলন দেশে প্রচলিত সনাতন জাতের চেয়ে দু-তিন গুণ বেশি। দেশের ৮০ ভাগ ধানি জমিতে এসব জাত চাষাবাদ করা হয় এবং এ থেকে আসে দেশের মোট ধান উৎপাদনের শতকরা প্রায় ৯০ ভাগ। আর এরই ফলাফল হিসেবে দেশ আজ চাল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ।
একটু পেছন ফিরে তাকালেই এর গুরুত্বটা উপলব্ধি করা যায়। চার দশক আগে দেশের সাড়ে সাত কোটি জনসংখ্যার জন্য ১৯৭০-৭১ সালে চালের উৎপাদন ছিল এক কোটি ১০ লাখ টন। বর্তমানে দেশের জনসংখ্যা বেড়ে ১৫ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। ইতিমধ্যে আবাসন খাতের বিকাশ এবং রাস্তাঘাটসহ বিভিন্ন উন্নয়নকাজে আবাদি জমির পরিমাণ অনেক কমেছে। তার পরও গত ২০১২-১৩ সালে চালের উৎপাদন বেড়ে দাঁড়িয়েছে তিন কোটি ৪৮ লাখ টনে। এটি সম্ভব হয়েছে প্রধানত ব্রি উদ্ভাবিত উফশী ধানের জাতগুলোর কল্যাণে।
আর শুধু যে চাল উৎপাদন বেড়েছে, তা নয়। ব্রির বিজ্ঞানীদের কাছ থেকে উন্নত গুণমানসম্পন্ন ধানের জাতও আমরা পেয়েছি। ব্রি ধান ৫০ বা বাংলামতীর কথা এখানে বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। এর চাল গুণের দিক থেকে ভারত-পাকিস্তানের স্বনামধন্য বাসমতীর সমপর্যায়ের। কিন্তু আমাদের বাংলামতীর ফলন তার চেয়েও প্রতি হেক্টরে প্রায় এক টন বেশি। ব্রির উদ্ভাবনের মধ্যে আরও আছে, সাতটি লবণাক্ততা সহনশীল, দুটি আকস্মিক বন্যা সহনশীল, একটি ডায়াবেটিক রোগীদের খাওয়ার উপযোগী এবং একটি জিংকসমৃদ্ধ আগাম ধানের জাত। উন্নত গুণমানসম্পন্ন চাল এখন আমরা বিদেশে রপ্তানি করার কথা ভাবতে পারছি। দেশের জনগণের প্রধান খাদ্যশস্য চাল উৎপাদনে এই সফলতার কথা দেশ-বিদেশে প্রশংসিত হয়েছে। তবে তা যথেষ্ট নয়। এ ক্ষেত্রে আরও বড় আঙ্গিকে আমরা কাজ করতে পারি এবং জাতীয় জীবনের সংকট উত্তরণের সময়টাতে তা করা আরও বেশি দরকার।
ব্রির জন্মদিন উপলক্ষে আমি এ জায়গাটিতেই জোর দিতে চাই। দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও আমাদের সফল প্রতিষ্ঠানগুলোর যথাযথ মূল্যায়নের জন্য সবাই মিলে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। নতুন প্রজন্মের সামনে অনুপ্রাণিত হওয়ার মতো দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য সেটা আরও বেশি প্রয়োজন। আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি এবং হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন প্রফেসর অ্যাসিমগলো ও রবিনসন দীর্ঘমেয়াদি গবেষণা করে একটি বই লিখেছেন। তাঁদের বইটির নাম জাতি কেন ব্যর্থ হয়: ক্ষমতা, প্রাচুর্য এবং দারিদ্র্যের উৎস (Why nations fail-The origins of power, prosperity and poverty) । এ বইয়ে তাঁরা সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও জাতিগুলোর উন্নয়ন, নেতৃত্বের উত্থান-পতন, সমৃদ্ধি ও দারিদ্র্যের কারণ অনুসন্ধান করেছেন। শত শত বছরের ইতিহাস ঘেঁটে, অনেক খেটেখুটে তাঁরা যা দেখানোর চেষ্টা করেছেন, তার অন্যতম প্রতিপাদ্য হলো উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির জন্য নাগরিকদের দরকার ভালো ইনস্টিটিউশন; যেগুলো উদ্ভাবনের সৎ চক্র গড়ে তোলে এবং তারই আবর্তে অর্থনৈতিক সম্প্রসারণ ও সম্পদের বিকাশ ঘটে। অনেক প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও একের পর এক সফলতার দৃষ্টান্ত তুলে ধরে সকল কাঁটা ধন্য করে মানুষকে তারা দ্রুত সামনে এগোনোর পথ দেখায়।
এম এ কাসেম: প্রযুক্তি সম্পাদক, ব্রি।
[email protected]