নতুন এক ইতিহাস সৃষ্টি হতে চলেছে বেনাপোল-পেট্রাপোল সীমান্তে। বিএসএফ-বিজিবির সম্মিলিত সামরিক কুচকাওয়াজ। একদিকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের পেট্রাপোল আর অন্যদিকে বাংলাদেশের যশোর জেলার বেনাপোল সীমান্ত। এই সীমান্তে শুরু হচ্ছে দুই দেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও নামানোর সময় বিশেষ কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠান। এ সময় বাজবে দুই দেশের জাতীয় সংগীত। শোনা যাবে দুই দেশের দেশাত্মবোধক গান। এই সামরিক কুচকাওয়াজকে বলা হয় ‘বিটিং রিট্রিট বর্ডার সেরিমনি’। ভারতের পশ্চিম সীমান্তের আটারি-ওয়াঘার পর এবার সেই একই দৃশ্য দেখা যাবে ভারতের পূর্ব সীমান্ত বেনাপোল-পেট্রাপোলে। আজ ২ অক্টোবর থেকে শুরু হচ্ছে এই কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠান।
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পূর্বাঞ্চল) বি ডি শর্মা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, ২ অক্টোবর এই রিট্রিট প্যারেড অনুষ্ঠান শুরু হবে। প্রথম পর্যায়ে এই অনুষ্ঠান হবে সপ্তাহের তিন দিন শুক্র, শনি ও রোববার। প্রতিদিন সন্ধ্যার আগে শুরু হবে এই অনুষ্ঠান। দুই দেশের জাতীয় পতাকা নামানো হবে সামরিক কায়দায়, দুই দেশের জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে। আর সবচেয়ে সুখের কথা, দুই দেশের জাতীয় সংগীতের রচয়িতা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সন্ধ্যার আগে শুরু হবে এই সীমান্তে দেশাত্মবোধক গানের অনুষ্ঠান। সূর্যাস্তের আগে সীমান্তে বেজে উঠবে বিউগল। খুলে যাবে দুই দেশের সীমান্তের গেট। দুই দিক থেকে দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর জওয়ানেরা প্যারেড করে নো-ম্যানস-ল্যান্ডে চলে আসবেন। সেখানে আড়াআড়িভাবে একসঙ্গে দুই দেশের জওয়ানেরা তাঁদের নিজেদের দেশের জাতীয় পতাকা নামিয়ে আনবেন। আর এই অনুষ্ঠান দেখার সুযোগ পাবে সাধারণ মানুষ।
প্রসঙ্গত, ভারত-পাকিস্তানের আটারি-ওয়াঘা সীমান্তে দীর্ঘ ৫৪ বছর ধরে, সেই ১৯৫৯ সাল থেকে চলে আসছে এই অনুষ্ঠান। এবার সেভাবেই এই কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হবে বেনাপোল-পেট্রাপোল সীমান্তে। তবে ওয়াঘার ভঙ্গিতে হবে না এখানকার অনুষ্ঠান। দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কারণে অনুষ্ঠানও হবে বন্ধুত্বভাবাপন্ন। আটারি-ওয়াঘা ভারত-পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় স্থল সীমান্ত। পাকিস্তানের অংশে ওয়াঘা আর ভারতের অংশে আটারি। এই ওয়াঘা-আটারি সীমান্তপথে চলছে পাকিস্তানের লাহোর থেকে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লির একমাত্র বাস পরিষেবা। যেমনটা বেনাপোল-পেট্রাপোল সীমান্তপথে চলছে ঢাকা-কলকাতার বাস পরিষেবা।
পশ্চিমবঙ্গের পেট্রাপোল সীমান্তের সঙ্গে মিশে আছে বাংলাদেশের বেনাপোল সীমান্ত। এই সীমান্তেই এবার চালু হতে চলেছে সেই ওয়াঘা-আটারি সীমান্তের ধাঁচে সামরিক কুচকাওয়াজ। কীভাবে আটারি-ওয়াঘা সীমান্তে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে ওই কুচকাওয়াজ, তা দেখার জন্য সোজা চলে গিয়েছিলাম সেই আটারি-ওয়াঘা সীমান্তে। ওয়াঘা গ্রামটিই ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পর ভাগ হয়ে গেছে। পশ্চিম দিকে ওয়াঘা আর পূর্ব দিকে আটারি। দুই দেশের দুই গ্রাম। সুনসান সীমান্ত। দুই দিকে শুধু বিস্তীর্ণ ফসলের খেত। আমরা ভারতের সীমান্তগেট পেরিয়ে ঢুকলাম একেবারে ওয়াঘা সীমান্তের কাছে। দূরে দেখা যাচ্ছে ওয়াঘা সীমান্তের পাকিস্তানের গেট। এর মাঝেই নো-ম্যানস-ল্যান্ড।
সূর্যাস্তের আগে সাধারণত নামানো হয় দুই দেশের জাতীয় পতাকা। তার আগে এখানে চলে নানা অনুষ্ঠান। ভারতীয় ছেলেমেয়েরা জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে এই সীমান্তে সেই জিটি রোডের ওপর দেশাত্মবোধক নাচ-গানে মেতে ওঠে। বিএসএফের জওয়ানেরা অংশ নেন দেশাত্মবোধক গানে। পাকিস্তানের ওয়াঘায়ও একই ধরনের অনুষ্ঠান চলে। শেষ পর্যায়ে শুরু হয় জাতীয় পতাকাকে সম্মান জানানোর নানা কুচকাওয়াজ। বিএসএফ খাকি পোশাক আর পাকিস্তানের রেঞ্জার্স বোটল গ্রিন পোশাক পরে এই কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে যোগ দেয়।
একসময় দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী নিজ নিজ দেশের সীমান্তে এসে খুলে দেয় সীমান্তের গেট। এরপর তারা নিজ নিজ দেশের জাতীয় পতাকাকে সম্মান জানান। তারপর নো-ম্যানস-ল্যান্ডে দাঁড়িয়ে জাতীয় পতাকাকে সম্মান জানিয়ে একই সঙ্গে তা নামিয়ে আনেন। এরপর সামরিক কায়দায় এই পতাকাকে সম্মান জানিয়ে নিজ নিজ দেশের পতাকা বহন করে নিয়ে যান নিজ নিজ দেশের মাটিতে। তারপর বন্ধ হয়ে যায় দুই দেশের সীমান্তের দরজা। এভাবেই ৫৪ বছর ধরে এই আটারি-ওয়াঘা সীমান্তে চলছে এই কুচকাওয়াজ।
এবার সেই কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের সেই ঐতিহাসিক বেনাপোল আর পেট্রাপোল সীমান্তে। বেনাপোল বাংলাদেশের যশোর জেলায়। যশোর থেকে বেনাপোলের দূরত্ব ৪৫ কিলোমিটার আর যশোর থেকে ঢাকার দূরত্ব ৩০০ কিলোমিটার। পেট্রাপোল ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার বনগাঁ মহকুমায়। কলকাতা থেকে পেট্রাপোল-বেনাপোলের দূরত্ব ৮০ কিলোমিটার। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ এখন অধীর আগ্রহে প্রহর গুনছে কখন আসবে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, যেদিন আটারি-ওয়াঘার ছায়া পড়বে বেনাপোল-পেট্রাপোল সীমান্তে। নতুন এক প্রাণ পাবে দুই বাংলার বাঙালিরা বেনাপোল-পেট্রাপোল সীমান্তে। দেখবে দুই বন্ধুপ্রতিম দেশের সামরিক কুচকাওয়াজ।
অমর সাহা: প্রথম আলোর কলকাতা প্রতিনিধি।