ব্যাপারটি যে শুধু যে প্রবীণ এবং ইতিমধ্যেই অন্য অসুখে আক্রান্ত ব্যক্তিদের নিয়ে ঘটছে, তা নয়। একজন যুবক সংকটাপন্ন হয়ে পড়লেন, আগের কোনো অসুখই যাঁর নেই, এমন ঘটনাও কম নয়।
বিশেষজ্ঞদের বিষয়টি ভাবাচ্ছে। যে রোগ কাউকে একেবারে কাবু করে যমদূত হিসেবে দেখা দিচ্ছে, সেটা আরেকজনকে নিদেনপক্ষে জ্বর-কাশিতে কাহিল করার কথা। কিন্তু কারও কারও ক্ষেত্রে কিচ্ছুটি বোঝা যাবে না, এটা বেশ অদ্ভুত ব্যাপার। অনেকে তো নিজেরাও বলতে পারবেন না, তাঁদের কোনো অসুখ হয়েছে। মানুষে মানুষে রোগটির লক্ষণের ও দুর্ভোগের এমন বিভেদ কেন?
এ নিয়ে নতুন একটি তথ্য গবেষকদের গোচরে এসেছে। সেটা এসেছে সর্দি-জ্বরের (Common Cold) ভাইরাস থেকে। সর্দি-জ্বরের ভাইরাস প্রায় ২০০ রকমের। বছরের বিভিন্ন সময় একেকটি আক্রমণের তুঙ্গে থাকে। প্রধান ভাইরাসকে বলে ‘রাইনো ভাইরাস’। জ্বর-সর্দির দ্বিতীয় প্রধান ভাইরাস হচ্ছে চার রকমের করোনাভাইরাস। এগুলো এই কোভিড-১৯–এর নভেল করোনাভাইরাস নয়। এই চার প্রকার ভাইরাস আবিষ্কৃত হয়েছে ১৯৬৫ সালে। তখনই এদের মুকুট আকৃতি দেখে করোনা (লাতিন শব্দ, অর্থ মুকুট) ভাইরাস নামকরণ করা হয়। তারা হলো 229E, NL63, OC43 ও HKU1।
এখন মানুষের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা সম্পর্কে সামান্য কিছু বিবরণ দেওয়া যাক।
কোনো জীবাণু যখন শরীরে প্রথমবারের মতো প্রবেশ করে, শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা (Immune System) তখন হাজার-লক্ষ ‘অ্যান্টিবডি’ (Antibody) তৈরি করা শুরু করে। অ্যান্টিবডি Y-এর মতো দেখতে প্রোটিন, যেটা সেই আক্রমণকারী ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া বা অন্য জীবাণুর (Antigen) সঙ্গে যুক্ত হয়ে তাকে অকার্যকর (Neutralize) করে ফেলে। শরীরের ইমিউন সিস্টেম একেক ‘অ্যান্টিজেন’–এর জন্য কার্যকর একেক রকম অ্যান্টিবডি তৈরি করে। তবে ভয়ংকর জীবাণুগুলো শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে ফাঁকি দিয়ে কাজ চালিয়ে দিতে পারে অথবা উল্টো তাকে পরাস্ত করে ফেলে, তখনই শরীরের জন্য নেমে আসে দুর্যোগ।
ইমিউন সিস্টেমের সঠিক অ্যান্টিবডি তৈরি করতে কয়েক দিন, এমনকি কয়েক সপ্তাহ লেগে যেতে পারে। কিন্তু একবার সেটা তৈরি হলে ইমিউন সিস্টেমের স্মৃতিতে (Memory) তা থেকে যায়। একে বলা হয় টি-সেল, রক্তের শ্বেতকণিকায় তারা থাকে। পরবর্তী সময়ে সেই ভাইরাস দেহে আবার প্রবেশ করলে ইমিউন সিস্টেমকে আর সময় নিয়ে বারবার চেষ্টা করতে হয় না। টি-সেলের স্মৃতি থেকে দ্রুত সঠিক অ্যান্টিবডি তৈরি করে ছড়ানোর আগেই ভাইরাসকে অকার্যকর করে ফেলতে পারে।
অ্যান্টিবডির কারণেই বহু রোগ, বিশেষত সংক্রামক রোগ আপনা-আপনি কিছুদিনের মধ্যে সেরে যায়। ভ্যাকসিন কাজ করার পেছনেও রয়েছে অ্যান্টিবডি ও ইমিউন সিস্টেমের ‘স্মৃতি’। ভ্যাকসিন একটা মৃত অথবা দুর্বল জীবাণু, যা শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে সঠিক অ্যান্টিবডি তৈরি করতে শেখায়, কিন্তু শরীরকে সম্পূর্ণ কাবু করে ফেলার মতো সামর্থ্য আবার সেই জীবাণুর নেই।
যেহেতু একেক ভাইরাসের জন্য কার্যকর অ্যান্টিবডি একেক রকম, তাই শরীরে অ্যান্টিবডির উপস্থিতি দেখেও বোঝা যাবে, একটি নির্দিষ্ট ভাইরাস মানুষটিকে অতীতে কখনো আক্রমণ করেছিল কি না। নভেল করোনাভাইরাস এসেছে ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে। কিন্তু স্যান ডিয়াগোতে ২০১৫ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে কিছু রক্ত নমুনা সংগৃহীত ছিল। সেগুলোকে তারা নভেল করোনাভাইরাসের অ্যান্টিবডিবিহীন রক্ত নমুনা হিসেবে ব্যবহার করতে গিয়েই এক আশ্চর্যজনক বিষয় উদ্ঘাটিত হয়। সেই ২০১৯ সালের পূর্বের রক্ত নমুনায় নভেল করোনাভাইরাসের মতোই অ্যান্টিবডি পাওয়া যাচ্ছে! তখন তো এই ভাইরাসই ছিল না? তাহলে শরীর তার উপযুক্ত অ্যান্টিবডি তৈরি করল কীভাবে?
ব্যাপারটি অবশ্য সহজেই ব্যাখ্যা করা গেল। এ আসলে ঠিক নভেল করোনাভাইরাসের অ্যান্টিবডি নয়, অন্য চার প্রকার করোনাভাইরাস, যা আগে থেকেই ছিল এবং সর্দি–জ্বর ঘটাচ্ছিল, তার অ্যান্টিবডি এসব। এই ভাইরাসগুলো একই গোত্রের হওয়ার কারণে তাদের অ্যান্টিবডি অনেকটা একই রকমের। সে থেকে গবেষকেরা বলছেন, যাঁর শরীরে সেই অ্যান্টিবডি আছে, তিনি রোগটিকে সহজেই প্রতিরোধ করতে পারছেন। কারণ, নভেল করোনাভাইরাস ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে শরীরে ইমিউন স্মৃতি তাকে চিনে ফেলছে। ভাইরাস কোষের ভেতরে ঢুকে হাজার-লক্ষ প্রতিরূপ সৃষ্টি করার আগেই ইমিউন সিস্টেম বিপুল অ্যান্টিবডি তৈরি করে ফেলছে। সেগুলো নভেল করোনাভাইরাসের সঙ্গে লেগে গিয়ে, তার কোষের ভেতরে প্রবেশ করার ক্ষমতা নষ্ট করে দিচ্ছে। আর তাতেই ভাইরাসের ‘ভাইরাল’ হয়ে ছড়ানো আর হয়ে উঠছে না। শরীর অসুস্থ হচ্ছে না।
গবেষকেরা আরও বলছেন, অল্প বয়সীদের এ রোগের প্রকোপ কম হওয়ার কারণ এ থেকে বোঝা যাচ্ছে। তারা সর্দি–জ্বর ও কাশির ভাইরাসে বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে। কাজেই তাদের শরীরে বিশেষ অ্যান্টিবডি ইতিমধ্যেই থাকার সম্ভাবনাও বেশি।
অল্প বয়সীদের কোভিড-১৯ রোগটি কম কাবু করার জন্য মানুষের শরীরে এসিই-২ (ACE-২) রিসেপ্টরও আংশিক দায়ী। সে সম্পর্কে বলার আগে ভাইরাস কীভাবে মানবদেহের কোষে ঢুকে সর্বনাশ ঘটায়, সে বিষয়ে সামান্য আলোকপাত করা যাক।
ভাইরাসের বাইরে থাকে একটি প্রোটিনের আবরণ, যা তার ভেতরের জিনগত উপাদানকে (Genetic Material) রক্ষা করছে। সেটাই আবার আক্রমণের চাবিকাঠি। সেটাকে বিজ্ঞানীরা বলছেন প্রোটিনের তৈরি চাবি, যা হোস্টের কোষের আবরণে প্রোটিনের তৈরি তালার সঙ্গে লেগে গিয়ে তাকে খুলে ফেলছে। তারপর ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। হোস্টের কোষের এই তালার শুদ্ধ নাম ‘ভাইরাস রিসেপ্টর’। হালকাভাবে বললে, সব চাবি দিয়ে যেমন সব তালা খোলে না, তেমনি একটি ভাইরাস যেকোনো হোস্টের কোষের ‘ভাইরাস রিসেপ্টর’ নামক তালা খুলতে পারে না। যে হোস্টে পারে, সচরাচর সে হোস্টেই সে আক্রমণ এবং বংশবৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়। সে জন্যই সব ভাইরাস সব প্রাণীকে আক্রমণ করতে পারে না।
করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে চারপাশের সেই সুচালো দণ্ডগুলো, যেগুলোর জন্য তার নাম হয়েছে করোনা, অর্থাৎ মুকুট, এই দণ্ডগুলোই চাবি। সেগুলো মানুষের দেহের কোষের একটা বিশেষ প্রোটিনের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে, তারপর তাকে খুলে ভেতরে ঢুকতে পারে। মানবদেহের কোষের আবরণের এই প্রোটিনের নাম এসিই-২ (ACE-২), পুরো নাম ‘এনজিও টেনসিন কনভার্টিং এনজাইম–২’।
গবেষকেরা বলছেন, কম বয়সে এই এসিই-২ রিসেপ্টর শরীরে কম থাকে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেটার পরিমাণ বাড়তে থাকে। এ কারণেই অল্প বয়সীদের আক্রমণ কম হবে, তাদের লক্ষণও সেভাবে দেখা যাবে না। কিছু কিছু রোগের ওষুধ, যেমন ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ, শরীরে এসিই-২ রিসেপ্টর বাড়িয়ে দেয়। সে কারণে এসব রোগ যাঁদের রয়েছে, তাঁদের নভেল করোনাভাইরাস বেশি কাহিল করে ফেলতে পারে।
এর বাইরেও মানুষের শরীরের ক্রোমোসম-৩–এ ছয়টি প্রাচীন জিনের কারণে রোগের প্রকোপ কমবেশি হচ্ছে বলে অনেক বিশেষজ্ঞের ধারণা। জাতিভেদে (Race) ও মানুষভেদে ক্রোমোসমের গঠন সামান্য ভিন্ন হয়। সেটাও রোগের লক্ষণ কারও বেশি, কারও কম হওয়ার একটি কারণ।
আরও নতুন একটি গবেষণা চলছে, তাকে বলে ‘ডিজিজ টলারেন্স’, বাংলায় বলা যেতে পারে, ব্যাধির সহনশীলতা। দেখা গেছে, উদ্ভিদ ও অন্য কিছু প্রাণীর মধ্যে বিভিন্ন মাত্রায় ব্যাধির সহনশীলতা রয়েছে। একটি ক্ষত হলে বা ডিহাইড্রেশনের মতো অন্য কোনো শারীরিক দুর্যোগ ঘটলে, শরীর নিজেই দ্রুত তাকে সারিয়ে তুলতে পারাই হচ্ছে ব্যাধির সহনশীলতা। এটা জিনগত প্রবণতার (Genetic Predisposition) কারণে হতে পারে অথবা আচরণ ও পরিবেশগত কারণেও হতে পারে। সম্প্রতি গবেষকেরা মানুষের ক্ষেত্রেও এমন ডিজিজ টলারেন্স বিষয়টি আছে বলে মনে করছেন। মানুষে মানুষে এ ডিজিজ টলারেন্স কমবেশি হবে, কাজেই একই রোগ (কোভিড-১৯) একেকজনকে একেক মাত্রায় ভোগাবে।
এ ছাড়া সম্প্রতি পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছ, যে দেশে মাস্কের ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়েছে, সেখানে রোগটি হলেও শতকরা হিসাবে মাস্ক ব্যবহারের আগে যা ছিল, তার চেয়ে কম মানুষের জন্য রোগটি গুরুতর হচ্ছে। কাজেই তাঁরা বলছেন, ব্যাপক মাস্ক ব্যবহারের ফলে শুধু যে সংক্রমণ কমবে তা নয়, রোগটি গুরুতর বা প্রাণঘাতী হয়ে যাওয়ার হারটাও সঙ্গে সঙ্গে কমে যাচ্ছে। সঠিক কী কারণে এমনটি হচ্ছে, তা এখন পর্যন্ত নির্ণয় করা না গেলেও পরিসংখ্যান রোগ কম গুরুতর হয়ে যাওয়ার দিকে সরাসরি ইঙ্গিত করছে।
মনে রাখতে হবে, ভাইরাসটি একেবারেই নতুন। এর কার্যকলাপ কিছুটা হতবুদ্ধিকর। কাজেই রোগটি কারও জন্য গুরুতর, কারও জন্য একেবারে নস্যি হওয়ার পেছনের কারণ উদ্ঘাটন করতে সময় লাগবে। আরও নতুন তথ্য ও ফলাফল আসবে। আমাদের সেসব সঠিক তথ্য জানার জন্য বিজ্ঞানমনস্ক দৃষ্টিকোণ নিয়ে প্রস্তুত থাকতে হবে। গুজবে কান দিলে এই দুর্যোগ মোকাবিলা করা আরও দুষ্কর হয়ে পড়বে।
মোস্তফা তানিম: বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি লেখক