গতকাল সোমবার সকাল ৯টায় একটা কাজে একাই হোটেল থেকে বের হই। শুনলাম, প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষে আগের দিন পদত্যাগের কথা বলেও শেষ মুহূর্তে তাঁর অনুসারীদের অনুরোধে আর পদত্যাগ করলেন না। দেখলাম, রাস্তায় আস্তে আস্তে সাধারণ জনতা জড়ো হচ্ছেন। দুপুর ১২টার দিকে হোটেলে ফিরে বাকিদের নিয়ে আবার বের হই। এবার দেখি, রাস্তায় অনেক লোক! আর এই প্রথম মনে হলো, যানজটও শুরু হয়েছে। তবুও একটি দোকানে পৌঁছে কেনাকাটা করে আবার হোটেলের দিকে ফেরত আসার পথে ঢুকে দেখি, রাস্তা বন্ধ এবং মারামারি ও ভাঙচুর চলছে। গাড়ি ঘুরিয়ে পাশের আরেকটা রাস্তা দিয়ে অন্য দিকে চলে আসি। পরে কাছে একটা রেস্তোরাঁয় দুপুরের খাবার খেয়ে একটু সময় কাটিয়ে আবার হোটেলের দিকে ফিরে আসি। রাস্তায় তখন অনেক লোক। কিছু বাস দেখলাম ভাঙা। কিছু লোক গাড়ি থামিয়ে কথা বলছেন। গাড়ির ড্রাইভার আমাদের ট্যুরিস্ট পরিচয় দেওয়ায় ছেড়ে দেওয়া হলো। আন্দোলনকারী নাগরিকেরা সুন্দর করে আমাদের অনুরোধ করলেন, আমরা যেন কোনো ছবি বা ভিডিও না করি।
গাড়ি এগিয়ে যেতেই দেখলাম, আরও অনেক ভাঙা বাস। ড্রাইভার বললেন, রাজাপক্ষের লোকজন এসব বাসে করে কলম্বো শহরে এসে মাথায় হেলমেট পড়ে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারী ও সাধারণ জনগণের ওপর হামলা করায় জনগণ তাঁদের আটক করেছেন। শুধু তাঁদের ব্যবহারের নির্দিষ্ট বাসগুলোতে ভাঙচুর চালিয়েছেন। সামনেই লেকপাড়ে দেখলাম মানুষের বিশাল জটলা। স্বচক্ষে দেখলাম, আন্দোলনকারী সাধারণ জনতা রাজাপক্ষের হেলমেট পরা কর্মী–সমর্থকদের একজন একজন করে লেকের পানিতে নামিয়ে দিচ্ছেন। এত সব ঘটনার একদম মাঝখানে আমি ও আমার পরিবার। গাড়িতে করে ভেতর দিয়ে যাচ্ছি, কিন্তু কোনো ভয়ই লাগেনি। মনে হয়েছে, আন্দোলনকারীরা সভ্যভাবে সব করছেন। (যদিও গাড়ি ভাঙা এবং কাউকে আটক করে পানিতে নামানো কখনোই ঠিক কাজ নয়)
একবারও মনে হয়নি, কেউ আমাদের ক্ষতি করবে। ট্যুরিস্ট পরিচয় দেওয়ার পর বরং গাড়ি আরও এগিয়ে দিয়েছে। রাস্তায় আন্দোলনকারীর তুলনায় পুলিশ ছিল অনেক কম এবং তাদের একবারও মারমুখী মনে হয়নি। শেষমেশ হোটেলে পৌঁছে রুম থেকেই বাইরে শোরগোল আর বাস ভাঙার শব্দ শুনতে পাই। রাজাপক্ষে পদত্যাগ করেছেন, কিন্তু জনগণ তাঁর ভাইয়েরও পদত্যাগ চায়। কারফিউ ঘোষণা করা হয়েছে। তবুও রাস্তার স্লোগান শুনতে পাচ্ছিলাম। সারা রাত চলল স্লোগান আর মাঝে কিছু টিয়ার গ্যাস ছোড়ার শব্দ।
আজ সকালে ঢাকায় আসার জন্য ভোর পাঁচটায় হোটেল থেকে বের হলাম। রাস্তায় সুনসান নীরবতা। কোনো লোকজন বা পুলিশ দেখতে পেলাম না। গল ফেস গ্রিন, যেখানে আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল, তার আশপাশে তখনো অনেক মানুষের উপস্থিতি। দেখে বুঝলাম, তারা অনেক দিন ধরে আন্দোলনের কারণে রাস্তায় তাঁবুর ভেতরে থাকছেন। বাকি রাস্তায় কোনো লোকজন দেখলাম না। আগের রাতে পোড়ানো কয়েকটা গাড়ি ছাড়া রাস্তায় সবকিছু ছিল গোছালো ও পরিষ্কার। এয়ারপোর্টের কাছে আসতেই দেখি, কিছু লোক রাস্তা পাহারা দিচ্ছেন। তাঁরা আমাদের গাড়ি থামালেন। ভেতরে দেখে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বললেন, তাঁরা আমাদের গাড়ি থামানোর জন্য অনেক দুঃখিত, কিন্তু তাঁদের প্রতিটা গাড়ি চেক করতে হচ্ছে। কারণ, তাঁদের কোনো মন্ত্রী বা এমপি অথবা বড় রাজনৈতিক নেতা যেন বিদেশে পালিয়ে যেতে না পারেন।
আজ দুপুরে বাংলাদেশে এসে পৌঁছেছি। শ্রীলঙ্কা আমার প্রিয় একটা দেশ। ওদের মানুষও অনেক ভালো। আল্লাহ যেন তাদের মঙ্গল করেন।
নাভিদুল হক, পরিচালক মোহাম্মদী গ্রুপ, নাগরিক টেলিভিশন ও বিজিএমইএ, ঢাকা উত্তরের সাবেক মেয়র প্রয়াত আনিসুল হকের ছেলে।