২০১২ সালে ঢাকার আশুলিয়ায় তাজরীন ফ্যাশনসে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে শতাধিক মানুষের মৃত্যুর পর আশা করা গিয়েছিল, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের চৈতন্যোদয় হবে, সরকারও কারখানার মালিকদের আইন মেনে চলতে বাধ্য করবে। কিন্তু ৯ বছর পর এসে দেখা গেল আমরা অভিজ্ঞতা থেকে কোনো শিক্ষা নিইনি। কারখানাগুলো চলছে স্বেচ্ছাচারী কায়দায়। আইনের বিষয়টি খাতা-কলমে আছে। বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ নেই।

গত বৃহস্পতিবার নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাশেম ফুডস অ্যান্ড বেভারেজের সেজান জুসের কারখানায় আগুন লেগে অর্ধশতাধিক শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনা মর্মবিদারক। করোনাকালে ঝুঁকি নিয়েও যে শ্রমিকেরা সেখানে গিয়েছিলেন কাজ করতে, তাঁদের অনেকে এলেন লাশ হয়ে।

পত্রিকার খবর অনুযায়ী, কারখানার নিচতলা থেকে আগুনের সূত্রপাত হলে নিরাপত্তাকর্মীরা প্রধান গেট লাগিয়ে দেন। শ্রমিকেরা আগুন থেকে বাঁচার জন্য ওপরের তলায় উঠে যান। কিন্তু কারখানার নিজস্ব অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা না থাকায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। কয়েকজন শ্রমিক ছাদ থেকে লাফিয়ে নিচে নামতে গিয়ে মারাও যান। তবে তঁাদের বেশির ভাগই মারা যান আগুনে পুড়ে। আগুন লাগার সময় প্রায় দুই শ শ্রমিক কারখানায় ছিলেন। এর মধ্যে ৫২ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। ৫০ জনের মতো আহত হয়েছেন, যাঁদের বেশির ভাগ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

আইনানুযায়ী এ ধরনের কারখানায় নিজস্ব অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। অনেক কারখানায় যন্ত্রপাতি থাকলেও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লোকবলও থাকে না। আর হাশেম ফুডসে যন্ত্রপাতি ও লোকবল কোনোটাই ছিল না। দ্বিতীয় উদ্বেগের কারণ হলো কারখানার নিরাপত্তাকর্মীরা নিজেদের ও কারখানার নিরাপত্তা রক্ষায়ই সচেষ্ট ছিলেন। শ্রমিকদের নিরাপত্তার কথা তাঁরা ভাবেননি। আগুন লাগার পর প্রধান গেট বন্ধ করে দেওয়ায় অনেক শ্রমিক চাইলেও বাইরে যেতে পারেননি। কারখানার আগুন নেভানোর দায়িত্বে নিয়োজিত ফায়ার ব্রিগেডের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, এ ধরনের কারখানায় অন্তত চারটি সিঁড়ি থাকা প্রয়োজন। হাশেম ফুডসে ছিল দুটি সিঁড়ি। ফলে শ্রমিকদের সিঁড়ি দিয়ে নামতেও বেগ পেতে হয়েছে।

তাহলে প্রশ্ন, কারখানাগুলোতে কি এভাবেই আগুনে পুড়ে শ্রমিক মারা যাবে? কোনো প্রতিকার নেই? শ্রমিকদের জীবন বাঁচাতে মালিকদের কিছু করণীয় নেই? এতগুলো মানুষের মৃত্যুর দায় কোনোভাবেই কারখানা মালিক এড়াতে পারেন না। আমরা চাই লোকদেখানো নয়, এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হোক। দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনা হোক। সেই সঙ্গে নিহত শ্রমিকদের পরিবারকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। আহত শ্রমিকদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। কারখানায় মৃত্যুর এ মিছিল বন্ধ হোক।

তাজরীনের ঘটনার পর সারা দেশে শ্রমিকদের মধ্যে প্রচণ্ড বিক্ষোভ দেখা দিয়েছিল। আন্দোলনের মুখে সরকার কারখানা মালিককে গ্রেপ্তারও করে। কিন্তু এরপর তিনি জামিন নিয়ে বিদেশে চলে যান। নিহত শ্রমিকদের পরিবার ও আহত শ্রমিকেরা তাঁদের ক্ষতিপূরণ ও প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। হাশেম ফুডসের ঘটনায় তার পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে। সরকারকেও নজরদারি বাড়াতে হবে, যাতে কোনো কারখানা মালিক আইন ফাঁকি দিয়ে শ্রমিকদের এভাবে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে না পারে।

আগুনে পুড়ে যে শ্রমিকেরা মারা গেছেন, তাঁরা আর ফিরে আসবেন না। কিন্তু সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিলে ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়ানো যাবে আশা করা যায়।