গণতন্ত্রের সামনে চ্যালেঞ্জ: সেদিন-এদিন

তিন দশক আগে আমরা সবাই গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে যে উচ্চাশা পোষণ করেছিলাম, আজ তা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় অপসৃত হয়েছে।ছবি: প্রথম আলো

তিন দশক আগে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার এবং এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশের সামরিক শাসকদের পতনের পর আমরা সবাই গণতন্ত্রের ‘তৃতীয় তরঙ্গ’ নিয়ে আলাপ-আলোচনা করতাম। ওই সময় আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো উদীয়মান গণতন্ত্রের দেশগুলোকে তাদের সদ্যোজাত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো জোরদার করার কর্মকৌশল শেখানোর জন্য কারিগরি বিশেষজ্ঞ সরবরাহে ব্যস্ত সময় পার করছিল।

তখন ধারণা করা হচ্ছিল, যদি আমরা সংসদ, বিচার বিভাগ, মানবাধিকার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, নির্বাচন কমিশন, রাজনৈতিক দলসমূহ, মুক্ত গণমাধ্যম, সুশীল সমাজ প্রভৃতির মতো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অনুভূমিক (হোরাইজনটিক্যাল) ও উলম্ব (ভার্টিক্যাল) জবাবদিহি জোরদার করতে পারি, তাহলে সদ্য গণতন্ত্রে রূপান্তরিত হওয়া শাসনব্যবস্থাগুলো একপর্যায়ে গণতন্ত্রকে সুসংহত ও গণতান্ত্রিক অভিজ্ঞতাকে গভীরতর করতে পারবে।

কিন্তু বছরের পর বছর গণতন্ত্রের কর্মকৌশলসংক্রান্ত নথিপত্র সরবরাহ করে এবং সাংসদ, বিচারক, সরকারি কর্মকর্তা, বেসরকারি সংস্থার কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক নেতাদের বিভিন্ন কর্মশালা করানো ও উত্তম গণতন্ত্র চর্চার দেশে স্টাডি ট্যুরে পাঠানোর পর আমরা গভীর দুঃখের সঙ্গে বুঝতে পারলাম, অনেক উদীয়মান গণতান্ত্রিক দেশেই গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ ও সংহতকরণের প্রক্রিয়া যথাযথভাবে চালু করা হচ্ছে না। সেসব দেশে পার্লামেন্ট একটি জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করার বদলে তা কার্যত নির্বাহী বিভাগের রাবার স্ট্যাম্পে পরিণত হয়েছে। বিচার বিভাগ তার স্বাধীনতা হারিয়েছে। নির্বাহী বিভাগের চাপের মুখে নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন ও মানবাধিকার কমিশন মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছে না। রাজনৈতিক দলগুলো না নিজেদের মধ্যে গণতন্ত্রের চর্চা করছে, না জাতীয় পর্যায়ে গণতন্ত্রকে এগিয়ে নেওয়ার কাজ করছে। তার বদলে দলগুলো নিজেদের সমর্থকদের পৃষ্ঠপোষকতা বিতরণ এবং বিরোধীদের ভয়ভীতি প্রদর্শনের যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। আমরা একটা সময়ে এসে বুঝতে পারলাম, কোনো কারিগরি পরামর্শ কিংবা তহবিল সরবরাহ আসলে এসব প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমে উন্নয়ন ঘটাতে পারবে না।

গণতান্ত্রিক সংহতির চাবিকাঠি হলো ‘রাজনৈতিক সদিচ্ছা’। কিন্তু যে রাজনৈতিক সদিচ্ছার পরিবেশ আমাদের গণতান্ত্রিক চর্চাকে আত্মস্থ করতে সক্ষম করে তুলতে পারে, সেই পরিবেশ কীভাবে আমরা তৈরি করতে পারব তার কোনো সহজ উত্তর আমাদের জানা নেই।

১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি গণতন্ত্রের বিশেষজ্ঞ ও পর্যবেক্ষকেরা গণতন্ত্রের অবক্ষয় নিয়ে লেখালেখি শুরু করেছিলেন। ১৯৯৭ সালে ফরিদ জাকারিয়া একটি লেখায় বলেছিলেন, সদ্য গণতন্ত্রের উত্তরণ ঘটা দেশগুলোর অর্ধেকই অনুদার গণতন্ত্রে পরিণত হচ্ছে এবং তিনি হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন, এসব অনুদার গণতন্ত্র দ্রুতগতিতে একটি বিকাশমান শিল্পে পরিণত হচ্ছে। চলমান শতকের গোড়া থেকেই বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের চালানো জরিপে দেখা গেছে, উদীয়মান গণতন্ত্রের অনেকগুলোতে যদিও নিয়মিত নির্বাচন হচ্ছে এবং সেসব জায়গায় সামরিক শাসনও নেই, কিন্তু সেখানে নির্বাহী প্রশাসনের ক্ষমতাচর্চার জবাবদিহি সীমিত হয়ে পড়েছে। অনেক দেশেই নির্বাহী শাখা বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেছে এবং পার্লামেন্টকে পাশ কাটিয়ে এসেছে। এসব দেশে নির্বাচনগুলো অবাধ ও স্বচ্ছ হয় না। এসব দেশে ক্ষমতাসীনেরা ভোটের ফল নিজেদের দিকে টানতে নানা ধরনের স্থূল ও সূক্ষ্ম কারসাজি করে থাকে। এর ফলে সত্যিকারের প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনের মাধ্যমে ভোটাররা তাঁদের পছন্দের প্রার্থী নির্বাচন করতে পারেন না। রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং তারা ক্ষমতাবান বিশেষ স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর কবজায় চলে গেছে। দলীয় রাজনীতি ও নির্বাচনের প্রক্রিয়া কালোটাকা, অপরাধ ও রাজনৈতিক বংশীয় শাসনে জড়িয়ে পড়েছে। একবার গদিতে বসতে পারলেই শাসকগোষ্ঠী স্বৈরশাসক হয়ে উঠছে। তারা জনগণের মৌলিক স্বাধীনতা দমিয়ে রাখছে, আইনের শাসনের ব্যত্যয় ঘটাচ্ছে, ‘জয়ীরা সব লুটেপুটে খাবে’ এমন খেলায় জড়িয়ে পড়ছে এবং সব ধরনের সমালোচক ও সমালোচনার চরিত্র হনন করছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গণতন্ত্র নিয়ে গবেষণা করা প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন গজিয়ে ওঠা আর একটি প্রবণতা, যেটিকে ‘স্বৈরাচারীকরণ’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে, সেটির দিকে মনোযোগ দিয়েছে। গণতন্ত্রবিষয়ক অনেক জরিপ শুধু বিভিন্ন দেশের গণতন্ত্রায়ণের মাত্রাই নয়, বরং একই সঙ্গে স্বৈরাচারীকরণের মাত্রারও পরিমাপ করেছে। এর আগে গবেষণায় যেমন গণতন্ত্রের বিভিন্ন তরঙ্গ নিয়ে আলোচনা করেছে, আজকাল অনেকে গবেষণা শুরু করেছেন ‘স্বৈরাচারীকরণের বিভিন্ন তরঙ্গ’কে চিহ্নিত করতে। যেখানে গণতন্ত্র কখনো সুসংহত হয়নি বা গণতন্ত্রের শিকড় গভীরে প্রোথিত হয়নি, সেসব জায়গার দুর্বল উদীয়মান গণতন্ত্র স্বৈরাচারীকরণের ‘প্রথম তরঙ্গ’-এর শিকার হয়ে থাকে। তবে তুরস্ক, হাঙ্গেরি ও ফিলিপাইনে তুলনামূলক অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা সরকারও যখন স্বৈরাচারী হয়ে উঠল, তখন গণতন্ত্র পর্যবেক্ষকেরা চিন্তিত হয়ে উঠলেন। এরপর যখন যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প, ভারতে মোদি এবং ব্রাজিলে বোলসোনারোর মতো নেতা নির্বাচিত হয়ে এলেন, তখন উদার গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে মানুষের দুশ্চিন্তা নতুন উচ্চতায় গিয়ে ঠেকল।

প্রতিবছর কোন দেশে কতটা গণতন্ত্রায়ণ এবং কতটা স্বৈরতন্ত্রীকরণ হলো, তা জরিপ করে থাকে ভি ডেম (ভ্যারাইটিস অব ডেমোক্রেসি) ইনস্টিটিউট নামের একটি সংস্থা, যা সুইডেনে অবস্থিত। তাদের সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘আমরা এখন “স্বৈরতন্ত্রীকরণের তৃতীয় তরঙ্গে” প্রবেশ করছি, যে তরঙ্গের সূচনা হয়েছিল অর্থাৎ প্রথম তরঙ্গটি দেখা দিয়েছিল ২০০১ সালে। তারপর থেকে ক্রমাগত বহু দেশই স্বৈরশাসনের পথে হাঁটছে। বর্তমানে বিশ্বের জনসংখ্যার ৩৫ শতাংশই স্বৈরতন্ত্রীকরণের শিকার হওয়া দেশে বাস করে। ২০০৮ সালে যেখানে উদার গণতন্ত্রের দেশ ছিল ৪৪ টি, ২০১৮ সালে সেই সংখ্যা ২৯টিতে নেমে এসেছে।’

ভি ডেমের ওই প্রতিবেদনে গণতন্ত্র নতুন তিনটি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথমটি হলো, এখন গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারগুলোর মধ্যে গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজকে নিয়ন্ত্রণ কিংবা সেগুলোকে নানা কারসাজির মাধ্যমে নিজের মতো করে ব্যবহার করার প্রবণতা বাড়ছে এবং সেখানে নির্বাচন প্রক্রিয়ার গ্রহণযোগ্যতাও ক্রমাগত অপসৃত হচ্ছে।

দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ হলো, রাজনৈতিক নেতারা ঘৃণা ছড়ানো ভাষণ দিচ্ছেন। এর ফলে জনসাধারণের মধ্যে বিষাক্ত মেরুকরণ দেখা দিয়েছে। এতে বিরোধী মতের প্রতি শ্রদ্ধা এবং জনগণের সহিষ্ণুতা কমে যাচ্ছে। যার কারণে জনগণের মধ্যে পরস্পরবিরোধী শিবির গড়ে উঠেছে।

তৃতীয় চ্যালেঞ্জ হলো, ডিজিটালাইজেশনের কারণে ভুয়া তথ্য ও গুজব এখন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের মতো ‘সুসংহত’ গণতন্ত্রের দেশেও এসব গুজব নির্বাচন প্রক্রিয়ায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বিদেশি রাষ্ট্রও অন্য রাষ্ট্রের নির্বাচনী প্রচারণার ওপর প্রভাব ফেলছে। এবং তার ফলে নির্বাচনের ফলাফলের ওপরও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হচ্ছে। ২০১৬ সালের যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের ওপর রাশিয়ার হস্তক্ষেপ নিয়ে বহুল আলোচনা হয়েছে। ভি ডেমের প্রতিবেদনে স্বৈরতন্ত্রীকরণের মারাত্মক রূপ নেওয়ার প্রাথমিক হুঁশিয়ারিমূলক পূর্বাভাস হিসেবে গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ ও সুশীল সমাজ দমন করাকে শনাক্ত করা হয়েছে।

তিন দশক আগে আমরা সবাই গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে যে উচ্চাশা পোষণ করেছিলাম, আজ তা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় অপসৃত হয়েছে। নিয়মিত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বেসামরিক রাজনৈতিক নেতারা ক্ষমতায় আসবেন এবং তাঁরাই দেশ চালাবেন—গণতন্ত্রের এই একটি মাত্র দিকের ওপর মাত্রাতিরিক্ত জোর দিতে গিয়ে আমরা আইনের শাসন, ব্যক্তির মৌলিক স্বাধীনতা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা, বহুমতের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা সুশীল সমাজ, মুক্ত গণমাধ্যম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা প্রভৃতির মতো গণতন্ত্রের জন্য সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ অপর বিষয়গুলোকে যে অবহেলা করে এসেছি, তা এখন আমরা টের পাচ্ছি। এদিকে মনোযোগ কম দেওয়ার সুযোগে অনেক ‘দায়সারা গোছের’ গণতন্ত্রের নেতাদের পক্ষে স্বৈরতন্ত্রীকরণে ঢোকা সহজ হয়েছে

যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প এবং ভারতে মোদির মতো নেতা নির্বাচিত হওয়ার বিষয়টি এখন সারা বিশ্বের উদার গণতন্ত্রপন্থীদের জন্য রূঢ় সতর্কবার্তা হিসেবে হাজির হয়েছে।

আর যা-ই হোক, যুক্তরাষ্ট্র একটি সংহত গণতন্ত্রের দেশ বলে পরিচিত, যেখানে সরকারের তিনটি শাখা ভারসাম্য মেনে চলে এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতাসহ ব্যক্তির মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা দেয়। সেই দেশে কেউ এটি আশা করেননি, একজন মার্কিন প্রেসিডেন্ট সিএনএনের মতো প্রতিষ্ঠিত সংবাদমাধ্যমগুলো ‘ভুয়া খবর’ সরবরাহ করছে বলে প্রতিনিয়ত মন্তব্য করবেন। ভারতে দেশটির স্বাধীনতা লাভের পর থেকে ৭০ বছর ধরে গণমাধ্যম স্বাধীনতা ভোগ করে এলেও ক্ষমতাসীন মোদি সরকারের আমলে সংবাদমাধ্যমগুলো এবং সুশীল সমাজের বাকস্বাধীনতা সরকারি নিয়ন্ত্রণ ও সরকার সমর্থকদের আক্রমণের মুখে পড়ে গেছে।

বৃহৎ ও সুদীর্ঘ কালব্যাপী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত থাকা এই দুটি দেশে যখন মানুষের মৌলিক অধিকারের ওপর আচমকা আঘাত আসে, তখন তা ‘স্বাধীনতার জন্য দরকার সর্বক্ষণের প্রহরার ব্যবস্থা’ এই প্রাচীন প্রবাদকেই মনে করিয়ে দেয়। এর মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়, আমাদের কোনো শাসকের, এমনকি বিপুল ভোটে নির্বাচিত হওয়া জনপ্রিয় কোনো শাসকের হাতেও গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকা যাবে না। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে গণতন্ত্রের ঘাটতিগুলো আমাদের নিরবচ্ছিন্নভাবে নির্ধারণ করে যেতে হবে এবং যখনই ঘাটতিগুলো দৃশ্যমান হবে, তখনই ব্যবস্থা নিতে হবে যাতে সেই ঘাটতি এমন পর্যায়ে না যেতে পারে, যে পর্যায়ে গেলে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক জনগণ বঞ্চনা বোধ করবে এবং গণতন্ত্র তাদের জন্য কোনো কাজে আসছে না, এমন অনুভূতি তৈরি হবে।

আমাদের সংসদ কখনো একটি কার্যকর জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড়াতে পারেনি।
কার্টুন: তুলি

বাংলাদেশ: পুরোনো ও নতুন চ্যালেঞ্জ

১৯৯০ সালে আমরা ‘তৃতীয় তরঙ্গ প্রবাহের’ গণতন্ত্র ক্লাবে যোগ দেওয়ার পর থেকে অদ্যাবধি আমাদের অভিযাত্রা কখনোই মসৃণ হয়নি। গণতান্ত্রিক উত্তরণের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচন অনুষ্ঠান বরাবরই আমাদের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে।

স্বাধীনতার পর গত পাঁচ দশকে দেখা গেছে, ক্ষমতাসীন কোনো সরকার তাদের ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত নির্বাচনে হারেনি। একমাত্র যখনই নিরপেক্ষ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়েছে, শুধু তখনই ক্ষমতাসীন দলকে আমরা হারতে দেখেছি। কিন্তু ২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি বাতিল হয়ে যায় এবং তার পর থেকে এ পর্যন্ত আয়োজিত সব নির্বাচনই বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে।

আমাদের সংসদও কখনো একটি কার্যকর জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড়াতে পারেনি। ১৯৯১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত যখন সংসদে বিরোধী দলের একটি উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ ছিল, তখন আমরা বেশির ভাগ অধিবেশনে বিরোধী দলকে সংসদ বর্জন করে সংসদকে অকার্যকর করা ও রাজপথের আন্দোলনে নামার সিদ্ধান্ত নিতে দেখেছি। ২০১৪ সাল থেকে পার্লামেন্টে কার্যত কোনো বিশ্বাসযোগ্য বিরোধী দল নেই। সরকারের দমনপীড়নমূলক পদক্ষেপের কারণে বিরোধী দলগুলোর রাজপথে নেমে আন্দোলন করার সক্ষমতাও অনেক কমে গেছে।

১৯৯০-এর দশক থেকে সব বৈশ্বিক জরিপে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে দুটি সূচককে সব সময়ই নিচের দিকে নামতে দেখা গেছে। একটি হলো আইনের শাসন এবং অপরটি নাগরিক অধিকার। ১৯৯০-এর দশকে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের একমাত্র যে সূচকটি ভালো অবস্থানে ছিল সেটি হলো কণ্ঠস্বর (ভয়েস ইন্ডিকেটর)। অর্থাৎ এই সময়টিতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, মুক্ত গণমাধ্যম ও মুক্ত সুশীল সমাজ—বিষয়গুলো ভালো অবস্থানে ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সেই ভয়েস ইন্ডিকেটরও নিম্নগামী হয়ে গেছে। এই নিম্নগামিতা নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে। ভি ডেমের প্রতিবেদনে যেমনটা বলা হয়েছে, সংবাদমাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ আরোপ ও সুশীল সমাজের কথা বলার জায়গা ছোট হয়ে আসা আসলে স্বৈরাচারীকরণের আগাম সতর্কসংকেত।

ভি ডেমের প্রতিবেদনে আরও যে দুটি চ্যালেঞ্জকে নতুন হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে তা আসলে বাংলাদেশের জন্য মোটেও নতুন নয়। আগেই যেমনটি বলেছি, আমরা বরাবরই একটি অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচনের জন্য ব্যবস্থা তৈরির প্রচেষ্টা করে আসছি, যা সব দলের কাছে প্রহণযোগ্য হবে। কিন্তু সেই কাজটি এখনো অপূর্ণ। আমরা এখনো জনমনে এই বিশ্বাস তৈরি করতে পারিনি যে আইন তার নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় কাজ করবে। সিকি শতাব্দী ধরে আমাদের বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা গুনে চলেছে। বছরের পর বছর এই ধরনের হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা কমছে না, বরং বেড়েই চলেছে।

এ ছাড় প্রায় সিকি শতাব্দী ধরে আমরা জনজীবনে এক ধরনের বিষাক্ত মেরুকরণের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। ১৯৯০-এর দশকের শুরুতে একটা সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য আমরা ভেবেছিলাম আমরা হয়তো যুক্তরাষ্ট্রের মতো দুই দলীয় শাসনব্যবস্থার দিকে যাচ্ছি। অর্থাৎ আমরা ভেবেছিলাম দুটি দল নির্বাচনের মাধ্যমে ঘুরেফিরে ক্ষমতায় আসবে। একবার এ দল আসবে, পরেরবার সে দল আসবে। কিন্তু আমরা দেখলাম, দল দুটি যুদ্ধোন্মত্ত মনোভাব নিয়ে মুখোমুখি হলো এবং এক দল আরেক দলকে নিশ্চিহ্ন করার মতো মনোভাব পোষণ করতে শুরু করল। নির্বাচনে হেরে যাওয়া মানে শুধু ক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়া নয়, বরং এরপরই আইনিভাবে হেনস্তা হওয়া, কারাবরণ করা, সহায় সম্পদ হারানো এমনকি জীবন হারানোও পরাজিত দলের নেতা-কর্মীদের পরিণতি হিসেবে দেখা দিল।

২০০৪ সালে বিরোধী দলের সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় তৎকালীন বিরোধী দলের বহু নেতা-কর্মী হতাহত হয়েছিলেন। তৎকালীন প্রধান বিরোধীদলীয় নেতা (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী) অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন কিন্তু ওই সময় এই নৃশংস হামলার যথাযথ তদন্তে তখনকার সরকার কোনো উদ্যোগই নেয়নি। বরং বিচারপ্রক্রিয়াকে ভিন্ন খাতে নেওয়ার অপপ্রয়াস চালিয়েছে। বছরের পর বছর ধরে আমাদের নির্বাচনভিত্তিক গণতন্ত্র এমন একটি ভয়ানক ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে পৌঁছেছে, যেখানে শুধু অতিধনী ও অত্যন্ত সাহসী ব্যক্তিরাই অংশগ্রহণ করতে পারেন।

আমাদের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার পথে সর্বশেষ ও সবচেয়ে ভয়ানক চ্যালেঞ্জ হলো গণমাধ্যম, সুশীল সমাজ ও বাকস্বাধীনতার ওপর সরকার ও সরকার-সমর্থকদের পাহাড়সমান চাপ বেড়ে গেছে। নতুন পাস হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন জনমনে এমন ধারণা সৃষ্টি করেছে যে এটির যথেচ্ছাচার ব্যবহার হতে পারে। এই আশঙ্কা সবাইকে সেল্ফ সেন্সরশিপের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় এর তীব্র প্রভাব পড়ছে।

গণপ্রতিরোধ ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা

ভি ডেমের প্রতিবেদন বৈশ্বিক গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে যদিও হতাশাজনক চিত্র দিয়েছে, তথাপি প্রতিবেদনটি কিছু আশার আলোও দেখিয়েছে। প্রতিবেদনটিতে বিভিন্ন দেশে স্বৈরাচারীকরণের বিরুদ্ধে ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষায় নাগরিকদের বিক্ষোভে নামার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। মূলত ২০০৯ সাল থেকে স্বৈরাচারীকরণের প্রবণতা বাড়তে শুরু করে এবং তখন থেকেই স্বৈরাচারীকরণ ও সরকারের অন্যায্য কার্যকলাপের বিরুদ্ধে নাগরিক বিক্ষোভ বেড়ে যায়।

সম্প্রতি আমরা হংকং, সুদান, তিউনিসিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতে নাগরিকদের দীর্ঘ আন্দোলন প্রত্যক্ষ করেছি। যুক্তরাষ্ট্রে করোনা মহামারির মধ্যেও ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলন হয়েছে। হংকং ও থাইল্যান্ডে গণতন্ত্রের আন্দোলনকারীরা আবার রাস্তায় ফিরে এসেছেন। দিল্লির শাহীনবাগে ২০১৯ সালে তীব্র শীতের মধ্যেও সাধারণ নারীরা রাস্তায় অবস্থান নিয়ে আন্দোলন করেছেন এবং শুধু করোনাভাইরাস মহামারির জন্য লকডাউন ঘোষণার পরই তাঁদের ঘরে ফেরানো গেছে। ভারতে বিভিন্ন প্রদেশে হঠাৎ লকডাউনের পর অন্য প্রদেশের অভিবাসী শ্রমিকদের যে দুর্দশা হয়েছে এবং তাঁদের সঙ্গে অমানবিক আচরণ করার প্রতিবাদে আন্দোলন হয়েছে।

সর্বশেষ কথা হলো, বৃহৎ পরিসরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও গণতন্ত্রের জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা সৃষ্টির জন্য শুধু নাগরিকদের আন্দোলনই যথেষ্ট নয়। সুবিধাবঞ্চিত, দরিদ্র ও সমাজের বাইরে ছিটকে পড়া মানুষের সম-অধিকার প্রতিষ্ঠায় সক্ষম গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য অনস্বীকার্য মৌলিক ও দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারকাজ এসব অসংগঠিত ও বিক্ষিপ্ত আন্দোলন দিয়ে নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।

বিগত বহু দশকজুড়ে বহু গণতান্ত্রিক দেশে ধনী উদারপন্থীরা সরকারি খাতে মানসম্পন্ন শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবা সরবরাহের ব্যবস্থা করেননি। বহু গণতান্ত্রিক দেশে আমরা কতটা বৈষম্যমূলক ও অন্যায্য সমাজব্যবস্থার মধ্যে বাস করি, তা এই করোনা মহামারি খোলাসা করে দিয়েছে। এর ফলে এই ব্যবস্থাগুলোর আমূল সংস্কার দরকার।

যখন দেশে দেশে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে থাকা ভিন্ন ভিন্ন প্রতিরোধ স্ফুলিঙ্গ সুসংহত হয়ে একটি টেকসই সংগঠন ও নেতৃত্ব তৈরি করতে পারবে এবং দীর্ঘমেয়াদি প্রতিশ্রুতি নিয়ে তা এগিয়ে যেতে পারবে, কেবল তখনই সত্যিকার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা বিনির্মাণের পথে আমরা এগিয়ে যেতে পারব। তার আগে নয়।

ইংরেজি থেকে অনূদিত। প্রথম প্রকাশিত ডেইলি স্টার-এ ১৫/৯/২০।

রওনক জাহান: রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও লেখক।