জাতীয় পরিচয়পত্র কেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে

কিছুদিন আগে এক অনলাইন সংবাদপত্রে একটি খবর দেখে পুরোনো এক প্রশ্ন মনে জাগল। একটি চলমান ফলপ্রসূ কার্যক্রমকে আরও গতিশীল করার চেষ্টা না করে আমরা কেন তাতে বাধার সৃষ্টি করি? সংবাদপত্রের খবরটি সরকারের সাম্প্রতিক একটি উদ্যোগসংক্রান্ত, যার উদ্দেশ্য জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরির দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের পরিবর্তে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষাসেবা বিভাগে ন্যস্ত করা। এ বছর ১৭ মে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে পাঠানো একটি চিঠিতে নির্বাচন কমিশনকে এই দায়িত্ব হস্তান্তরের বিষয়টি জানিয়ে তা নিশ্চিত করতে বলা হয়। খবরটির শিরোনামে বলা হয়েছে, আপাতত এই দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের হাতেই থাকছে। আপাতত, অর্থাৎ কিছু আইনি জটিলতা দেখা দেওয়ায় উদ্যোগে যে খানিকটা ভাটা পড়েছে, সেগুলো মিটে যাওয়া পর্যন্ত। জটিলতাটি এ রকম: জাতীয় পরিচয়পত্র সেবার কার্যক্রম সুরক্ষাসেবা বিভাগের হাতে দেওয়ার লক্ষ্যে ১৯৯৬ সালের রুলস অব বিজনেসের সংশ্লিষ্ট ধারাটি সংশোধনের প্রস্তাব আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু আইন মন্ত্রণালয় সেই প্রস্তাবে সম্মত হয়নি। কারণ, এর জন্য জাতীয় নিবন্ধন আইন ২০১০-এর সংশোধনী আনতে হবে এবং এই সংশোধনীতে মন্ত্রিসভার অনুমোদন নিয়ে আইনটি জাতীয় সংসদে তুলতে হবে। সংসদে গৃহীত হলে উদ্যোগটি বাস্তবায়ন করা যাবে।

এর আগে ২০০৯-১০ সালে সরকার এ রকম একটি উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু সেবারও আইনি ও বাস্তব কিছু সমস্যার কারণে উদ্যোগটি জোর পায়নি। গত মে মাসে নতুন করে হস্তান্তরের উদ্যোগ নেওয়ার পর সংবাদমাধ্যমে যে প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে, তা থেকে বোঝা যায় জনমতও এর পক্ষে নয়। প্রথম আলো পরিচালিত পাঠক জরিপে দেখা গেছে, ৯০ শতাংশ পাঠক এই উদ্যোগের বিপক্ষে। নির্বাচন কমিশন জানাচ্ছে, গত দুই মাসে জাতীয় পরিচয়পত্র পাওয়ার জন্য আবেদন জমা পড়ার হার উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। মানুষ চাইছে সেবা কার্যক্রমটি স্থানান্তরের আগেই পরিচয়পত্র পেয়ে যেতে। অর্থাৎ কার্যক্রমটি বর্তমানে যেভাবে চলছে, জনমত সেভাবেই চলার পক্ষে। মানুষের ভয়, সুরক্ষাসেবা বিভাগের হাতে সেটি চলে গেলে ভোগান্তি বাড়বে।

নির্বাচন কমিশন নিয়ে মানুষের মধ্যে আস্থার অভাব রয়েছে, আছে অনেক অভিযোগ। কিন্তু জাতীয় পরিচয়পত্র সেবা শাখা নিয়ে সেই তুলনায় অভিযোগ অনেক কম। সেই ২০০৭-২০০৮ থেকে যখন সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ছবিসহ পরিচয়পত্র দেওয়ার কাজ শুরু হয়, শৃঙ্খলা ও নিয়মনিষ্ঠার সঙ্গেই শাখাটি তার কাজ করে আসছে। ২০২০ সাল পর্যন্ত ১২ কোটি নাগরিকের হালনাগাদ তথ্যভিত্তি বা ডেটাবেইস তৈরি করে জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়া হয়েছে। যখন স্মার্ট কার্ডের প্রচলন হলো, দেখা গেল ভালোভাবেই এই বিশাল কর্মযজ্ঞ চলল। খোঁজখবর নিয়ে জানা গেল, এই শাখায় পর্যাপ্ত জনবল নেই। ৮০-৮৫টির মতো পদের মধ্যে ৩৩টিই শূন্য। সেনাবাহিনী থেকে ডেপুটেশনে কিছু কর্মকর্তা সেই ২০০৮ সাল থেকে জাতীয় পরিচয়পত্র সেবা কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত। এ জন্য অনেক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও কাজটি স্বচ্ছভাবেই চলছে, মানুষের আস্থাও তৈরি হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি ১৫৬টি প্রতিষ্ঠানকেও এই শাখা পরিচয়পত্রসংক্রান্ত সেবা দিচ্ছে, যাদের মধ্যে আছে মোবাইল ফোন কোম্পানি, ব্যাংক এবং সরকারের বিভিন্ন সংস্থা। তথ্য-উপাত্ত যাচাই করার ক্ষেত্রে এই সহযোগিতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

যদি ধরে নেওয়া হয় পরিচয়পত্র তৈরি প্রক্রিয়াটি ঠিকই আছে, কিন্তু তথ্যভিত্তি তৈরিতে সমস্যা আছে, তাহলে তো ভোটার তথ্যভান্ডার নতুন করে সুরক্ষাসেবা বিভাগ, অর্থাৎ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে করতে হবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কি সেই কাজ করতে পারে?

গত কয়েকটি নির্বাচন নিয়ে তা জাতীয় হোক বা স্থানীয়, যত গুরুতর অভিযোগ উঠছে, ভোটার তথ্যভিত্তি নিয়ে ততটা আসেনি। তথ্যভিত্তি যেহেতু এমন একটি পদ্ধতির মধ্য দিয়ে তৈরি হয়, যাতে কারও কোনো আপত্তি থাকলে তা আমলে নেওয়ার সুযোগ থাকে, তাতে ভুল কম থাকে। এই তথ্যভিত্তির ওপর ভিত্তি করেই জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি হয় এবং এই দুটি কাজই করে নির্বাচন কমিশন। সুরক্ষাসেবা বিভাগ যদি এখন পরিচয়পত্র সেবা দেওয়ার দায়িত্ব পায়, তাকে নির্ভর করতে হবে নির্বাচন কমিশনের তৈরি তথ্যভিত্তির ওপর। তাহলে দুটি প্রশ্ন অবধারিতভাবে উঠবে। ধরে নিতে হবে, নির্বাচন কমিশনের তথ্যভিত্তি ঠিকই আছে, কিন্তু তথ্যের ভিত্তিতে দেওয়া পরিচয়পত্র তৈরি, যাচাই-বাছাই করা এবং বিতরণের কাজে গুরুতর ত্রুটি অথবা ব্যর্থতা আছে, তা না হলে কেন এই দায়িত্ব হস্তান্তরের প্রয়োজন দেখা দিল? আর যদি ধরে নেওয়া হয় পরিচয়পত্র তৈরি প্রক্রিয়াটি ঠিকই আছে, কিন্তু তথ্যভিত্তি তৈরিতে সমস্যা আছে, তাহলে তো ভোটার তথ্যভান্ডার নতুন করে সুরক্ষাসেবা বিভাগ, অর্থাৎ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে করতে হবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কি সেই কাজ করতে পারে?

আর যদি এ রকম হয় যে ভোটারের তথ্যভিত্তি মোটামুটি গ্রহণযোগ্য, পরিচয়পত্র তৈরির ব্যাপারটিও ভালোই চলছে, তাহলে এই অনর্থক উদ্যোগের কী কারণ? যদি বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটারদের যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করে নাগরিক তথ্যভিত্তি তৈরি হয়ে থাকে, আর এর ওপর ভিত্তি করে বায়োমেট্রিক তথ্য, ছবিসহ জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি হয় এবং এ নিয়ে গুরুতর কোনো অভিযোগ না ওঠে, তাহলে কেন এই উদ্যোগ? তা ছাড়া যে প্রক্রিয়ার সঙ্গে দেশের এক বিপুলসংখ্যক নাগরিকের প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতা রয়েছে, সেই প্রক্রিয়া সম্পর্কে এ রকম একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে তাদের মতামত নেওয়ার তো একটা প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। সীমিত হলেও প্রথম আলোতে জনমতের একটি জরিপ তো হয়েছে। তাতে জনমত কোন দিকে, তা তো দেখাই যাচ্ছে।

আইনি জটিলতার একটি হচ্ছে, সংবিধান অনুযায়ী ভোটার তথ্যভান্ডার তৈরি করতে পারে শুধু নির্বাচন কমিশন। তাহলে সুরক্ষাসেবা বিভাগকে তথ্য-উপাত্ত নিতে হবে নির্বাচন কমিশন থেকে। এই তথ্য-উপাত্ত থেকে শুরু করে পরিচয়পত্র করার জন্য বিদ্যমান অবকাঠামো ও জনবলও নিতে হবে নির্বাচন কমিশন থেকে। তাহলে নির্বাচন কমিশনের পরিচয়পত্র শাখা যে কাজটি ভালোভাবে করছে, তারা তো তা-ই করে যেতে পারে। আর যদি নতুন করে জনবল তৈরি করতে হয়, তাহলে সময় লাগবে, তহবিল লাগবে। দুই প্রতিষ্ঠানে তথ্য ঘোরাফেরা করলে এই তথ্যের সুরক্ষা কে দেবে? যেসব শর্ত মেনে বর্তমানে ব্যবহৃত ভোটার নিবন্ধন সফটওয়্যারসহ নানা সফটওয়্যার লাইসেন্স কেনা হয়েছে, সে অনুযায়ী এই সফটওয়্যারগুলো ব্যবহার করতে পারে শুধু নির্বাচন কমিশন। এখন সুরক্ষাসেবা বিভাগের পক্ষে সেসব লাইসেন্স নতুন করে কিনতে গেলে যে অর্থ খরচ হবে, তা হবে নিছক অপচয়।

নির্বাচন কমিশন বলছে, পরিচয়পত্র কার্যক্রম সুরক্ষাসেবা বিভাগের হাতে গেলে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএমে ভোট গ্রহণে জটিলতা হবে। এতে এসব যন্ত্রপাতির পেছনে খরচ হওয়া চার হাজার কোটি টাকা গচ্চা যাবে। ইভিএম নিয়ে অনেক রাজনৈতিক দলের আপত্তি ছিল, তারপরও সেগুলো কেনা হয়েছে। এখন এই টাকা পানিতে গেলে দেখা যাবে, নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষার কারণে অপচয়ই বাড়ল।

জাতীয় পরিচয়পত্র সেবা নিয়ে মানুষের অভিযোগ অবশ্যই আছে। পরিচয়পত্রে ভুল থাকলে তা সংশোধনের সময় যে ভোগান্তি হয়, সে সম্পর্কে কিছু অভিযোগ আমি নিজেও শুনেছি। এর একটি কারণ, পরিচয়পত্র সেবা শাখার জনবলসংকট। নির্বাচন কমিশন জানাচ্ছে, ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ২০২১ সালের জুলাই পর্যন্ত পরিচয়পত্রের জন্য নিবন্ধন করেছেন ৯১ লাখ নাগরিক। হারানো কার্ডের বিকল্পের জন্য আবেদন করেছেন প্রায় আড়াই লাখ, সংশোধনের জন্য প্রায় সাত লাখ। সরকার প্রয়োজনীয় জনবল বাড়িয়ে, প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিয়ে পুরো কাজ গতিশীল করতে পারে। সেবার মান বাড়ানোই যদি সরকারের উদ্দেশ্য হয়, তাহলে তো এভাবেই তা করা যায়।

সরকারের উচিত হবে সেবা হস্তান্তর উদ্যোগের ইতি টানা অথবা স্পষ্ট করে বলা কেন এ রকম সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এ রকম যুক্তির অবর্তমানে এ বিষয় নিয়ে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত মন্তব্য, বিশ্লেষণ ও মতামত কলামে উদ্বেগ উঠে এসেছে যে এর পেছনে রাজনৈতিক কোনো উদ্দেশ্য আছে। মানুষ উন্নত সেবা চায়, তা সে অনলাইনে ট্রেনের টিকিট কাটা, টিকা, পাসপোর্ট বা জাতীয় পরিচয়পত্র পাওয়ার ক্ষেত্রেই হোক। এত দিন যে সংস্থাটি পরিচয়পত্র দেওয়ার কাজটি ভালোভাবেই করছে, তাকে আরও ভালো করে কাজটি করার জন্য সরকার সব
ধরনের সহায়তা দিতে পারে। তা না করে নতুন একটি সংস্থাকে সে দায়িত্ব দিলে সেবার মান যে বাড়বে, তার নিশ্চয়তা কোথায়?

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম কথাসাহিত্যিক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক