জেদের কারণে লিবিয়ার এই বিপর্যয়

দুপক্ষের লড়াইয়ে অশান্ত লিবিয়া।রয়টার্স

লিবিয়ার সংকট নিরসনের জন্য মিসরে আবার আলোচনা হয়েছে। লিবিয়াকে নিয়ে এ ধরনের আলোচনা বা বৈঠক কয়েক বছর ধরে হচ্ছে, কিন্তু সমাধান খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সমাধান আসলে পাওয়ার কথাও না। লিবিয়ার বিবদমান দলগুলোর মধ্যে সংঘাতের মূল কারণ হচ্ছে তেলের নিয়ন্ত্রণ। এই তেলের অধিকার কেউই ছাড়তে রাজি না। বিভিন্ন দেশ, যারা লিবিয়ার সংকটে যুক্ত হয়ে সমাধানের জন্য মরিয়া হওয়ার ভান করছে, তাদেরও মূল লক্ষ্য নিজস্ব পক্ষ দিয়ে লিবিয়ার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে স্বল্পমূল্যে তেল কেনা।

লিবিয়ার তেলক্ষেত্রগুলো এই মুহূর্তে কোনো সরকারের হাতেই নেই। ত্রিপোলির সরকার বা বিদ্রোহী খলিফা হাফতারের পূর্বাঞ্চলের সরকার লড়াই করছে বটে, কিন্তু কমবেশি সব কটি তেলক্ষেত্রই রাশিয়ার মার্সেনারি বাহিনীর দখলে। এরা যুদ্ধবিমান ও মিসাইলের অধিকারী। সম্ভবত রাশিয়ার সরকারের কাছ থেকে যুদ্ধবিমান ও মিসাইল পেয়েছে। যদিও বরাবরই রাশিয়া তা অস্বীকার করে আসছে। রাশিয়ার ভাড়াটে যোদ্ধারা খলিফা হাফতারের পক্ষে ত্রিপোলি সরকারের বিরুদ্ধে লড়ছে। কিন্তু লড়াই শেষ হলে তেলক্ষেত্রগুলোর অধিকার ফিরিয়ে দেবে বলে মনে হয় না। খলিফা হাফতারের পক্ষে এককভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব নয়। রাশিয়া, মিসর ও আমিরাতের শিখিয়ে দেওয়া বুলিই তিনি আওড়ে থাকেন। রাশিয়ার পাশাপাশি সিরিয়ার মার্সেনারিদের নিয়ে এসেছে তুরস্ক। এর পাশাপাশি সামরিক সরঞ্জামাদিও পাঠিয়েছে তুরস্ক।

অগণতান্ত্রিক শাসন দিয়ে গাদ্দাফি লিবিয়াকে বিভক্ত ও ভঙ্গুর করে ফেলেছিলেন। সেই লিবিয়া তাঁর ওপর ধসে পড়ল, দেশটাও ছন্নছাড়া হলো। স্বৈরাচারীরা এভাবে নিজেদের জেদের কারণে দেশেরও বিপর্যয় ডেকে আনেন, যেমন এনেছিলেন ইরাকের সাদ্দাম হোসেন।

সুশাসন ও গণতন্ত্রকে এক পাশে সরিয়ে রেখে ইদানীং বিভিন্ন দেশে জোর করে উন্নয়ন চাপিয়ে দেওয়ার এক ধরনের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। পর্যাপ্ত উন্নয়ন হচ্ছেও বটে। নতুন নতুন ধনিক শ্রেণির বিকাশও ঘটছে। ভোগ্যপণ্যের পসার তুমুল চকচকে জীবনকেই তুলে ধরে। কিন্তু মাঝেমধ্যে জীবনের তাল কেটে যায়। মনে হয় কোথায় যেন ঘাটতি থেকে যায়। এই ঘাটতি হচ্ছে গণতন্ত্রের ঘাটতি, সুশাসনের ঘাটতি। এ রকম শাসনব্যবস্থা গত শতকের সত্তরের দশকে বিভিন্ন দেশে দেখা যেতে শুরু করে।

দীর্ঘ মেয়াদে এ ধরনের শাসনব্যবস্থা রাষ্ট্র ও নাগরিক কারও জন্যই মঙ্গল বয়ে আনতে পারে না। বরং রাষ্ট্রে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। এতে শাসক ও রাষ্ট্র উভয়েরই পতন ঘটতে পারে। সমসাময়িক ইতিহাসে এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে লিবিয়া ও এর সাবেক লৌহ শাসক মুয়াম্মার গাদ্দাফি। মাত্র ৩০ বছর বয়সে লিবিয়ার শাসনক্ষমতা দখল করেন গাদ্দাফি। জাতীয় মুক্তি, সমাজতন্ত্র ও ঐক্যের ডাক দিয়ে উন্নয়নে ঝাঁপিয়ে পড়েন গাদ্দাফি। বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু হয় লিবিয়াজুড়ে। তেলসমৃদ্ধ লিবিয়ায় বিদেশি শ্রমিকেরা ভিড় জমাতে শুরু করেন। বিদেশি চিকিৎসক, প্রকৌশলী ও শিক্ষকেরা দলে দলে লিবিয়া চলে যান চাকরি নিয়ে।

লিবিয়ার উন্নতি হয়েছিল, এ নিয়ে সন্দেহ নেই। তবে গাদ্দাফি লিবিয়াবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারেননি বোধ হয়। ২০১১ সালের অক্টোবরেই নিজের জন্মশহর সিরতেতে বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হন গাদ্দাফি। অপমান, অপদস্থ করে গাদ্দাফিকে যখন হত্যা করা হচ্ছিল, তখন তাঁকে রক্ষার জন্য কেউ ছিল না। গাদ্দাফির সাজানো বাগানে এখন গোলাবারুদের গন্ধ। গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রশ্নে লিবিয়ার মানুষ গাদ্দাফির সময়ও ভালো ছিল না। এখনো ভালো নেই।

মুয়ান্মার গাদ্দাফি
ফাইল ছবি

২০১১ সালে জাতিসংঘের যোগসাজশে ন্যাটো বাহিনী লিবিয়া আক্রমণ করলে গাদ্দাফি লিবিয়াবাসীকে পশ্চিমাদের বিশ্বাস করতে না করেছিলেন। গাদ্দাফি সরাসরিই বলেছিলেন, ‘গণতন্ত্র না, ওরা আমাদের তেল চুরি করতে এসেছে।’ শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে দেশকে রক্ষার আহ্বান জানিয়েছিলেন গাদ্দাফি।

গাদ্দাফি হচ্ছেন গল্পের সেই রাখাল বালক। জাতীয় শত্রু, ষড়যন্ত্রকারী বিভিন্ন মিথ্যা অভিযোগে গাদ্দাফির আমলে এত মানুষকে হত্যা ও সাজা দেওয়া হয়েছে যে, আসলেই যখন জাতীয় শত্রুরা দেশ দখল করতে চলে এল, তখন তা প্রতিরোধের মতো কেউ নেই। বরং অনেকেই সেই জাতীয় শত্রুদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। লিবিয়াবাসী গাদ্দাফিকে বিশ্বাস করেননি। বিশ্বাস না করার কারণও ছিল না। বিশ্বাস গাদ্দাফি নিজেই ভেঙে দিয়েছিলেন। গাদ্দাফির আমলে লিবিয়ার নাগরিকদের সচ্ছলতা ছিল, বাহুল্য ছিল। সঙ্গে দমবন্ধ করা এক পরিবেশও ছিল। গাদ্দাফির শাসনব্যবস্থা নিয়ে দ্বিমত করার সুযোগ ছিল না। বিরোধী মতের লোকজনকে জাতীয় শত্রু বলে গুম করে দেওয়া ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।

নিজ দেশের নাগরিকদের শত্রু বানিয়ে কখনোই টিকে থাকা যায় না, বরং জনগণকে সঙ্গে নিয়েই জাতীয় শত্রুর মোকাবিলা করতে হয়। গাদ্দাফির ভরসাস্থলে লিবিয়ার নাগরিকেরা কখনোই ছিলেন না। মিলিশিয়া বাহিনী, অনুগত বাহিনী দিয়ে গাদ্দাফি প্যান আফ্রিকার নেতা হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের আদলে আফ্রিকান ইউনিয়ন গঠনের স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিন্তু পায়ের নিচের ভিত খুব দুর্বল ছিল। জনগণের শাসক ছিলেন না গাদ্দাফি। গাদ্দাফি মনে করেছিলেন, জনসাধারণকে উন্নয়নের মধ্যে ডুবিয়ে রাখলে কেউ কোনো দিন অধিকার নিয়ে প্রশ্ন করবে না। কিন্তু জনসাধারণ যখন কথা বলতে শুরু করে, তখন কোনো বাহিনীই শাসককে রক্ষা করতে পারে না। গাদ্দাফিরও শেষ রক্ষা হয়নি।

অগণতান্ত্রিক শাসন দিয়ে গাদ্দাফি লিবিয়াকে বিভক্ত ও ভঙ্গুর করে ফেলেছিলেন। সেই লিবিয়া তাঁর ওপর ধসে পড়ল, দেশটাও ছন্নছাড়া হলো। স্বৈরাচারীরা এভাবে নিজেদের জেদের কারণে দেশেরও বিপর্যয় ডেকে আনেন, যেমন এনেছিলেন ইরাকের সাদ্দাম হোসেন।

ভুল ও ভ্রান্তির কারণে গাদ্দাফি নিজে ডুবেছেন। লিবিয়াও ডুবতে বসেছে এখন। ৯ বছরের গৃহযুদ্ধে লিবিয়া কার্যত চার ভাগে বিভক্ত। যদিও মূল নিয়ন্ত্রণ রয়েছে লিবিয়ার জাতীয় সরকার ও বিদ্রোহী খলিফা হাফতারে নিয়ন্ত্রণে। এর বাইরেও ইসলামিক স্টেট ও স্থানীয় মিলিশিয়ারা বেশ কিছু অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করে। লিবিয়া আদৌ আবার কারও একক নিয়ন্ত্রণে ফিরে আসবে কি না, তার নিশ্চয়তা নেই। জাতীয় সরকারকে তুরস্ক ও কাতার সমর্থন দিচ্ছে। তুরস্ক সামরিক বাহিনীও পাঠিয়েছে। অন্যদিকে খলিফা হাফতারের প্রতি ফ্রান্স, রাশিয়া, আরব আমিরাত ও মিসরের সমর্থন রয়েছে। লিবিয়ার জনসাধারণের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ গাদ্দাফির আমলে ছিল না। এখনো নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনেক সিদ্ধান্তই বিদেশিরা ঠিক করে দেন।

২০০৮ সালে আরব লিগের দামেস্ক সম্মেলনে গাদ্দাফি আরবের সব নেতার সমালোচনা করেছিলেন। এর দুই বছর আগেই ইরাকের সাদ্দাম হোসেনকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। গাদ্দাফি বলেছিলেন, ‘একদিন আমাদের যে কাউকেই আমেরিকা ঝুলিয়ে দেবে।’ গাদ্দাফি হয়তো অজান্তে নিজের ভবিষ্যদ্বাণীই করে ফেলেছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন আরব রাজনীতিতে কী হতে যাচ্ছে। কিন্তু গাদ্দাফি বুঝতে পারেননি, নিজের পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। গাদ্দাফির মতো উদাহরণ অজস্র দেওয়া যাবে ইতিহাস থেকে। গণতন্ত্র ও উন্নয়নের মধ্যে যদি সমন্বয় সাধন করা সম্ভব না হয়, তবে ওই রাষ্ট্র বিপাকে পড়তে বাধ্য।

ড. মারুফ মল্লিক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক