দেখা যাচ্ছে, ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, যুব মহিলা লীগ কিংবা স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেউ বড় ধরনের কোনো ঘটনা ঘটালে এবং তা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হলে সংগঠন থেকে বহিষ্কারের নির্দেশ আসে। বিষয়টি এখন এমন হয়ে গেছে, গায়ে ময়লা লেগেছে ধুয়ে ফেললেই ধবল হয়ে গেল! কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ায় গতকাল প্রকাশ্যে তাদের একটি অংশের সশস্ত্র মহড়া করে সংঘর্ষে জড়াতে দেখা গেল। এক্ষেত্রেও হয়তো একটি পক্ষ অপর পক্ষকে ‘অনুপ্রেবশকারী’ বলে তাদের কোনো কোনো জনকে বহিষ্কার করে দেবে।
আগের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলেও একই চিত্র পাওয়া যায়। দেখা যায় এ ক্ষেত্রে তিনটি ধাপ অনুসরণ করা হয়। প্রথমত, সংগঠন থেকে সঙ্গে সঙ্গে বহিষ্কার, তারপর মিডিয়াকে বলা যে তিনি আগে বিএনপি করতেন কিংবা হাওয়া ভবনের ঘনিষ্ঠ, অথবা ‘অনুপ্রবেশকারী’। আর শেষ ধাপটি দুটো ভাগে বিভক্ত হয়—প্রথমটি আসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় বা পুলিশের কাছ থেকে: যেটি প্রায়ই শোনা যায় সেটি হলো, ‘কেউই ছাড় পাবে না।’ শেষেরটি অনিবার্যভাবে আসে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের কাছ থেকে, ‘অপরাধী যে-ই হোক, আইনের আওতায় আনা হবে।’ পাপিয়া, সাহেদ, ইউএনও হত্যাচেষ্টার ঘটনায় কম-বেশি এসব সংলাপই আমরা শুনেছি।
কীভাবে এই ‘অনুপ্রবেশকারীরা’ দলীয় গুরুত্বপূর্ণ পদ পান? কোনো ঘটনা গণমাধ্যমে আসার আগ পর্যন্ত কেউই জানতেন না যে তাঁরা আগে বিএনপি কিংবা অন্য দল করতেন? শুধু দল করা নয়, এঁদের প্রায় সবাইরই আওয়ামী লীগের রথী-মহারথীদের সঙ্গে ছবি আছে, তাঁদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের বিবরণ আছে। সাহেদ তো রাষ্ট্রীয় ও সরকারি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিয়মিত দাওয়াত পেতেন। তখন পর্যন্ত হাওয়া ভবনের সঙ্গে তাঁর সখ্যের গল্প কেউই কেন জানতেন না?
এই ধরনের বিষয় যে এখনই কেবল ঘটছে, তা নয়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ যখন দীর্ঘদিন পর ক্ষমতায় আসে, তখনো একই বিষয় দেখা গিয়েছে। ১৯৯৮ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সে সময়কার ছাত্রলীগের সভাপতি মানিকের বিরুদ্ধে যখন ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে, তখনো বলা হয়েছে মানিক আগে ছাত্রদল করতেন। হ্যাঁ, মানিক ছাত্রদলের নেতা ছিলেন। কিন্তু কী প্রক্রিয়ায় তিনি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন?
এই বেপরোয়া মানুষজন দলীয় লেবাস গায়ে চড়িয়ে, ক্ষমতাবানদের সঙ্গে আঁতাত-সখ্য এবং আরও নানা ধরনের দেন-দরবার করে ক্ষমতার জায়গায় নিজেদের আস্তানা তৈরি করেন, তখন একবারও প্রশ্ন আসে না দলের জন্য তিনি ক্ষতিকর হয়ে উঠছেন কি না। দলের কোনো না কোনো প্রভাবশালী নেতা তাঁদের আশকারা দিয়ে, পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে নিয়ে আসেন দলীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে। সেখানেও হয়তো চলে নানা ধরনের ব্যবসা। তা না হলে কীভাবে আওয়ামী লীগের শত্রু দল বিএনপি করা লেকজন আওয়ামী লীগে এসে রাতারাতি ভিআইপি বনে যান? আর এই ভিআইপি হওয়ার মধ্য দিয়ে তাঁরা দুর্নীতি-জালিয়াতির আরও বিস্তার ঘটাতে থাকেন। কেউ কেউ এগিয়ে যান খুন খারাবিতে। এগুলো যত দিন পর্যন্ত গোপন থাকে অর্থাৎ যত দিন পর্যন্ত গণমাধ্যমে বা সামাজিক মাধ্যমে না আসে, তত দিন পর্যন্ত সাধারণ সম্পাদককে এমন বাণী দিতে হয় না যে তারা আসলে বিএনপির লোক ছিলেন।
ওপরে বলা মুখস্থ হয়ে যাওয়া চারটি প্রক্রিয়া আসলে উৎসাহ দিচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের। তাঁরা জানেন, দুর্নীতি, মাস্তানি এমনকি খুন করলেও শাস্তি বড়জোর দল থেকে বহিষ্কার। এঁদের পৃষ্ঠপোষকদের কথা না-ইবা বললাম। তাঁদের নাম কেউই জানেন না। জানা হয় না, জানানো হয় না।
বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দল আওয়ামীলীগসহ রাজনৈতিক দলগুলের বেশিরভাগেরই নেতৃত্বে যাওয়ার পদ্ধতি স্ব স্ব গঠনতন্ত্রে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে। সেখানে প্রথমে সদস্য হয়ে কী করতে হবে, কীভাবে সেখান থেকে ওয়ার্ড, কমিটি, ইউনিয়ন কমিটি, উপজেলা কমিটি, জেলা কমিটি তারপর বিভাগ থেকে কেন্দ্রে আসবে তা বলা আছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে বড় দুটো রাজনৈতিক দলে এখন আর সেসব বিধিবিধান মানা হয় না। এখন বিভিন্ন কমিটির নেতৃত্ব ওপর থেকেই সিদ্ধান্ত মোতাবেক ঠিক করে দেওয়া হয় এবং সেখানে প্রাধ্যান্য পায় অর্থ, প্রভাব বিস্তার এবং নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা। অর্থাৎ যেখানে দলের সঙ্গে আদর্শ, ত্যাগ, জনমানুষের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতাকে মূল্যায়ন করার কথা, সেখানে প্রাধান্য পাচ্ছে দুর্নীতি–লুন্ঠন আর এলাকা নিয়ন্ত্রণের যোগ্যতা—যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অর্থ ও বলপ্রয়োগ দ্বারাই নির্ধারিত হয়। এই কারনে কমিটিগুলোতে স্থান পাচ্ছে ব্যবসায়ী এবং স্থানীয় প্রভাবশালীরা। আওয়ামীলীগ সাধারণ সম্পাদকও ‘অনুপ্রবেশকারী’দের ওপর জোর দিয়েছেন এবং এটাতেই স্পষ্ট হচ্ছে যে নেতৃত্ব নির্বাচনে আর এখন কোনো কিছু মানা হয়না এবং এ কারনেই বেপরোয়া হয়ে ওঠছে অনেকেই।
*জোবাইদা নাসরীন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক।
[email protected]