মানুষ কীভাবে পারে শিশুকে ধর্ষণ করতে? ধর্ষক কি তাহলে মানুষের পর্যায়ে পড়ে? মানুষরূপী এই অমানুষদের ভয়ানক থাবা থেকে রেহাই পাচ্ছে না তিন থেকে ত্রিশ, কোনো মেয়েশিশুই। দূরের মানুষ তো বটেই, নিস্তার মেলে না বাড়ির কাছের মানুষদের থেকেও।
ধর্ষণের পরে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে বহু নারীকে। এসব নৃশংসতার পেছনের কারণ কী? পুরুষের বিকৃত মানসিকতা, সেই সঙ্গে ক্ষমতা প্রদর্শন, কর্তৃত্ব প্রয়োগ করার মনোবৃত্তি থেকে এমন ঘটনা ঘটায়। বিশ্বখ্যাত ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট এ নিকলাস গ্রথ ১৯৭৭ সালে আমেরিকান জার্নাল অব সাইকাইয়াট্রিতে এই আচরণকে ব্যাখ্যা করে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেন। যেখানে ধর্ষণের কারণ বৈজ্ঞানিকভাবে ব্যাখ্যা করা হয়। প্রবন্ধের শুরুতে লেখক বলেছেন, ক্ষমতা প্রদর্শন, ক্রোধ ও যৌনতা বেশির ভাগ ধর্ষণের মূল কারণ। এখানে ১৩৩ জন অপরাধী ও ধর্ষণের শিকার ৯২ জনের ওপর চালানো সমীক্ষায় দেখা যায়, তারা কর্তৃত্বপরায়ণ মনোভাব থেকে ধর্ষণ করেছে। একটা হলো পাওয়ার রেপ, যেখানে অস্ত্র, শারীরিক শক্তি, ভয়ভীতি দেখানো হয়। আরেকটি হলো অ্যাঙ্গার রেপ—ভিকটিমকে মারধর করা, যৌন নির্যাতন করা এবং তাকে বিভিন্ন অপমানজনক কাজ করতে বাধ্য করা। এ ক্ষেত্রে ভিকটিমদের সারা শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন থাকে।
এবার আরও গভীরে গিয়ে দেখা যাক মনোবিদেরা কী বলেছেন। স্বভাবগতভাবেই বেশির ভাগ পুরুষ নারীর ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়। ধর্ষণ তা প্রকাশের একটা ভয়াবহ নমুনা। একেক ধর্ষকের পারিবারিক পরিবেশ, সামাজিক শ্রেণি, বেড়ে ওঠা, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য একেক রকম। পরীক্ষণ ও গবেষণায় দেখা গেছে, ধর্ষকেরা ধর্ষণকে তাদের পুরুষত্ব প্রমাণ করার একটা উপায় বলে মনে করে। আসলে ধর্ষণের মাধ্যমে তারা নিজেদের হীনম্মন্যতা প্রকাশ করে। যদি জোর করতে না পারে, তাহলে নিজেকে ব্যর্থ মানুষ হিসেবে ধিক্কার দেয়।
কয়েকজন ধর্ষকের কেস স্টাডিতে দেখা গেছে, এদের কেউ মাদকাসক্ত, মা-বাবার কোন্দল, বয়ঃসন্ধিকালে কোনো না কোনো যৌন বা মানসিক নির্যাতনের শিকার। দ্বৈত সত্ত্বা (বায়োপোলার ডিসঅর্ডার), ব্যক্তিত্বের সমস্যা (পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার) যাদের আছে, সেই মানুষদের এই প্রবণতা থাকে। বিশেষ করে পরিবারের পুরুষেরা যদি নারীদের সম্মান না করে, তাহলে শিশুর মধ্যে নারীকে সম্মান দেওয়ার বোধ গড়ে ওঠে না।
‘সাইলেন্স অব দ্য ল্যাম্বস’ সিনেমায় একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে, ‘আমরা সেটাই দেখি, যা চোখে দেখা যায়।’ যেকোনো বয়সের নারীকে প্রলোভন দেখিয়ে যদি শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করা হয় এবং সেখানে যদি কোনো জোরাজুরির ব্যাপার আসে, তাহলে তা আইনের চোখে বিশ্বাস করানো কঠিন হয়। সমাজ বলে, মেয়েটারই তো দোষ।
কোনো কোনো ধর্ষক সমাজে নিজের অবস্থান এমন শক্ত করেছে আর ভালো মানুষের মুখোশ পরে রেখেছে, তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ উপযুক্ত প্রমাণ ছাড়া হালে পানি পায় না। যেহেতু এ ধরনের ক্ষমতাবানেরা আইনের ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে, ফলে অন্যরা এই অপরাধ করার সাহস পায়। নারী যদি কারও নামে অভিযোগ করে, আইন বাধ্য শুরুতেই তা আমলে নিতে।
আরেকটা কারণ হচ্ছে বয়ঃসন্ধিকালে এদের যৌনাকাঙ্ক্ষা আর দশটা মানুষের মতো গড়ে ওঠে না। পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত হয়ে পড়ে অনেকে। সেগুলো দেখেও বিকৃত যৌনাকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়। যারা এমন নির্যাতন করে, তারা স্বাভাবিক যৌন আচরণও করে না। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক আহমেদ হেলাল বলেন, ‘সঠিকভাবে যৌনশিক্ষা নিয়ে আমাদের সমাজে কথা বলার চল এখনো তৈরি করতে পারিনি। সাত বছর বয়স থেকে এ বিষয় নিয়ে অন্য সব কথার মতো আলোচনা করা উচিত। না হলে বিকৃত যৌনাচার শিখতে পারে সন্তান। এটা জীবনের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, কিন্তু অন্যকে অসম্মান করে বা জোর করে এটি করা যাবে না।’
বিয়ের পর অনেক ছেলে মনেই করেন না, সেক্সের জন্য স্ত্রীর অনুমতি নেওয়ার দরকার আছে। বিয়ে যখন হয়েছেই, ফলে স্ত্রীর ওপর এটা তাঁর অধিকার। আহমেদ হেলাল বলেন, ‘কাউকে কাউকে বলতে শোনা যায়, বউরা নিজে থেকে তো কিছু বলে না। লাজুক বউ। তাই আমাকেই এগিয়ে যেতে হয়।’
সাইকোলজি টুডের মনোবিদেরা মনে করেন, মাদক, জিনগত সমস্যা, এমনকি পুষ্টিগত সমস্যাও ধর্ষণের কারণ। মাদক বা বিভিন্ন ওষুধের রাসায়নিক বিক্রিয়ায় যখন ধর্ষণপ্রবৃত্তি জাগে এবং ধর্ষণের ঘটনা ঘটে, তখন সেটাকে অপরাধ হিসেবেই গণ্য করতে হবে। এই ধরনের নির্যাতকেরা যৌন অক্ষমতা বা অকাল বীর্যপাতে ভোগে। এর কারণে তারা হিংস্র নির্যাতনের মাধ্যমে বিকৃত আনন্দ পায়। সাধারণত এরা প্রতিশোধপরায়ণ হয়।
অনেকেই বলেন ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চললে বা আপাদমস্তক পোশাকে ঢাকা থাকলে এ ধরনের নির্যাতনের শিকার হতে হয় না। কিন্তু বাস্তবতা তা বলছে না। কুমিল্লার তনু, চিকিৎসক সামিয়ার ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ড এর উদাহরণ। তাই বোঝা যাচ্ছে, সমস্যাটা নারীর পোশাকে নয়, সমাজব্যবস্থায় ও সন্তান লালন–পালনে। পরিবার যদি বাড়ির ছেলেশিশুটিকে সঠিক শিক্ষা দিয়ে বড় করতে পারে, তাহলে এটা অনেকটা কমানো সম্ভব। বড় হয়ে যাওয়ার পরও তাকে নজরের মধ্যে রাখতে হবে। নিজের সন্তানের অপরাধের জন্য আরেকটি পরিবার যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। যত বেশি প্রতিবাদ হবে, যত বেশি সচেতনতা বাড়বে মানুষের মধ্যে, ততই কমতে পারে ধর্ষণের মতো অপরাধ। সবচেয়ে বড় কথা, সমাজের মানুষেরা যখন ধর্ষণের জন্য নারীকে দায়ী করবে না, তাদের হেয় করবে না, তাদের বর্জন করবে না, তখনই কেবল একদিকে থাকবে সমাজ, অন্যদিকে থাকবে দুর্বল হয়ে যাওয়া কতিপয় ধর্ষক-মানসিকতার পুরুষ।