ফেসবুকে ওরা কিছু লিখবে না!

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর কলেজের ছাত্র-শিক্ষকদের জন্য ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারসংক্রান্ত নির্দেশনা’ জারি করেছে।

আমাদের জীবনের পূর্ণিমায় রাহুগ্রাস চলছে। আমাদের মুক্তি নেই। ইস্যু যায় ইস্যু আসে; পক্ষ-বিপক্ষের দাবড়া–দাবড়িতে ফেসবুক গরম হয়ে যায়।

কী এক আজব কারণে একটি ঘটনা ঘটলে পটাপট একই ধরনের ঘটনা ঘটতে থাকে। রাজনীতির পলিটিকস হয়ে ওঠার মতো খোদ ফেনোমেননও প্রপঞ্চময় হয়ে ওঠে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সরব হয়। পক্ষ–বিপক্ষের কথা, ছবি, ভিডিও চিত্র চালাচালি শুরু হয়। ফেসবুকের কথা চালাচালিতে টয়লেটে ‘হিসু’করার টিস্যুও শেষ পর্যন্ত লম্বা প্যাঁচানো ইস্যু হয়ে দাঁড়ায়।

তারপরও ফেসবুক বা যেকোনো ধরনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমই গণতন্ত্রের ভরসাস্থল। এসব প্ল্যাটফর্ম কাজে লাগিয়ে যেমন অপরাধ ঘটানো হয়, তেমনি অপরাধ ঠেকানোও হয়। এই প্ল্যাটফর্ম থেকে গুজব ছড়ানো যায়, গুজবের জোঁকের মুখে আসল তথ্যের নুনও ঢেলে দেওয়া যায়। প্রাচীন রোমের দ্বিমুখী দেবতা জানুস যেমন একদিকে অতীত, অন্যদিকে ভবিষ্যতের দিকে তাকাতেন, তেমনই এক অঙ্গে দুই বিপরীত রূপ বহন করছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম।

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা নির্দেশনা
ছবি: মাউশির ওয়েবসাইট

এই কারণে ছাত্রছাত্রীদের কথা বলতে দেওয়া এবং তাদের কথা শোনা যখন সবচেয়ে বেশি দরকার, সেই মুহূর্তে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) একটি মর্মান্তিক নির্দেশনা জারি করেছে।

মাউশি বলেছে, কলেজের ছাত্র ও শিক্ষকেরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরকার বা রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় এমন কোনো পোস্ট, ছবি, অডিও বা ভিডিও আপলোড, মন্তব্য, লাইক ও শেয়ার করতে পারবেন না। কলেজের ছাত্র-শিক্ষকদের জন্য ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারসংক্রান্ত নির্দেশনা’ গত বুধবার জারি করা হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা অন্য কোনো সার্ভিস বা পেশাকে হেয়প্রতিপন্ন করে এমন কোনো পোস্ট দেওয়া যাবে না। জাতীয় ঐক্য ও চেতনার পরিপন্থী কোনো রকম তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ করা যাবে না। কোনো সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগতে পারে এমন বা ধর্মনিরপেক্ষতা নীতি পরিপন্থী কোনো তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ করা যাবে না। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট বা আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটতে পারে, এমন কোনো পোস্ট, ছবি, অডিও বা ভিডিও আপলোড, মন্তব্য, লাইক, শেয়ার করা থেকেও বিরত থাকতে হবে। এ ছাড়া জনমনে অসন্তোষ বা অপ্রীতিকর মনোভাব সৃষ্টি করতে পারে, এমন বিষয় লেখা, অডিও বা ভিডিও প্রকাশ বা শেয়ার করা এবং ভিত্তিহীন, অসত্য বা অশ্লীল তথ্য প্রচার থেকেও বিরত থাকতে হবে।

সরকারি কর্মচারীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কী লিখতে পারবেন, কী পারবেন না, তা সরকারের পক্ষ থেকে অনেক আগেই একটি নির্দেশিকার মাধ্যমে জানানো হয়েছে। দশজন সুস্থ লোককে গামলাভর্তি মিষ্টি–মণ্ডা খেতে দিয়ে তাদের পাশে একজন ডায়াবেটিক রোগীকে বসিয়ে দুই পিস নোনতা বিস্কুট খেতে দেওয়ার পর ডায়াবেটিক রোগীর যে দশা হয়, এই নির্দেশিকার কারণে ফেসবুক ব্যবহারকারী সরকারি কর্মচারীদের দশা তা–ই হয়েছে।

সরকারি কর্মচারী এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের যে যে বিষয়ে মন্তব্য, শেয়ার, লাইক করতে বারণ করা হয়, সেগুলো এতটাই বিমূর্ত যে, যে কাউকে যা কিছু লেখার কারণে দোষী হিসেবে সাব্যস্ত করা সম্ভব।

সরকারি চাকরি করলে বেতন মেলে। তাই কর্মচারীরা জবানে লাগাম দিয়ে ফেসবুকে ঢোকেন এবং কিছু না লিখে শুধু দেখে যান। ‘ফেসবুকে কেস খাব ভুল কিছু লিখলে/তাই ফুল ছাড়া কোনো ফটো দিই না’——এই দর্শনে বিশ্বাসী হতে বাধ্য হওয়া কর্মচারীরা ভুলেও কোনো অনিয়ম নিয়ে কথা বলেন না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে তাঁরা গানবাজনা শোনার মাধ্যম হিসেবে দেখেন আর বউয়ের জন্মদিন এলে কেক কাটাকাটির কিছু কটকটে ছবির নিচে ‘হ্যাপি বার্থ ডে টু জান’ লিখে দাম্পত্যের দায় শোধ করেন।

কিন্তু কথা হলো, বেতনভুক্ত সরকারি কর্মচারীদের সেই ‘নোনতা বিস্কুট’ ছাত্রছাত্রীদের সামনে দেওয়ার মানেটা কী?

নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, ‘জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা অন্য কোনো সার্ভিস বা পেশাকে হেয়প্রতিপন্ন করে এমন কোনো পোস্ট দেওয়া যাবে না। জাতীয় ঐক্য ও চেতনার পরিপন্থী কোনো রকম তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ করা যাবে না।’

এখন কে ‘জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি’? কোন পোস্ট দিলে তাঁকে ‘হেয়প্রতিপন্ন’ করা হবে? কোনো তথ্য–উপাত্ত ‘জাতীয় ঐক্য ও চেতনার পরিপন্থী’—এগুলো ঠিক করবে কে? কারণ এসবের কিছুই মাউশি সংজ্ঞায়িত করে দেয়নি। এসবই বিমূর্ত টার্ম। আর বিমূর্ত টার্ম সাধারণত ব্যবহার করা হয় নিবর্তনের উদ্দেশে। সুস্পষ্ট সংজ্ঞা না থাকায় যে কাউকে যেকোনো পোস্টের জন্য হয়রানি করা সম্ভব হবে।

সরকারি কর্মচারীদের মতো যদি ছাত্রছাত্রীদেরও ‘ধরা যাবে না, ছোঁয়া যাবে না, বলা যাবে না কথা’র মতো পরিস্থিতিতে পড়তে হয় তাহলে দশ বছর পর তো জাতি একটি মেরুদণ্ডহীন নির্বাক প্রজন্ম প্রসব করবে। ইতিহাস ও রাজনীতির নিরিখে বড় বড় ব্যক্তিকে নিয়ে, বিশেষ করে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নিয়ে নানামুখী বিশ্লেষণ হয়ে থাকে। তাদের সমালোচনাও হয়ে থাকে। তাঁদের সার্বিক মূল্যায়নের জন্য এই সমালোচনা জরুরি। মাউশির এ ধরনের নির্দেশনা সেই ঐতিহাসিক মূল্যায়নের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে।

নিবর্তনমূলক নির্দেশ দিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও যদি ছাত্রছাত্রীদের হাত–পা বেঁধে ফেলা হয়, তাহলে তাদের সামনে একের পর এক প্রশ্নপত্র ফাঁস হতে থাকবে, তারা প্রশ্ন করবে না। শেয়ারবাজার-ব্যাংক থেকে লাখো কোটি টাকা লুট হয়ে যাবে, তারা প্রশ্ন করবে না। ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং করা হবে, নির্বাচনে প্রকাশ্যে ব্যালট বাক্স ছিনতাই হবে, তারা প্রশ্ন করবে না। গুম, খুন, ক্রসফায়ার, পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু সূর্যোদয়-সূর্যাস্তের মতো প্রাত্যহিক ঘটনা হয়ে উঠবে, তারা প্রশ্ন করবে না। আন্দোলন-হরতালের নামে মানুষ পুড়িয়ে মারা হবে, তারা প্রশ্ন করবে না।

ছাত্রছাত্রীদের এভাবে ‘বোবা’ বানালে প্রশ্নাতীতভাবেই তারা স্থায়ীভাবে প্রশ্ন করা ভুলে যাবে। কোনো ব্যর্থতার ‘পোস্টমর্টেম’ হবে না। পুরোনো কবরের বুকভাঙা হতাশা নিয়ে আবুল হাসানের কবিতার মতো আমাদের দাপাতে হবে। পরাজয় বত্রিশ দাঁতে হাসবে।


সারফুদ্দিন আহমেদ: সাংবাদিক ও লেখক
[email protected]