বিএনপির উচিত আদালতের রায়ের প্রতি সম্মান জানানো
যুদ্ধাপরাধের দায়ে শাস্তি পেলেন বাংলাদেশের রাজনীতির অন্যতম বিতর্কিত এবং‘গডফাদার’ হিসেবে আলোচিত চরিত্র সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী। পাকিস্তানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বজায় রেখে চলার জন্য পরিচিত সাকা চৌধুরী তাঁর একাত্তরের নৃশংসতার জন্য দোষী সাব্যস্ত হলেন এমন একটি দিনে, যেদিন শেরেবাংলা নগরে সরকার সম্মাননা দিচ্ছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা পালনের জন্য পাকিস্তানের কয়েকজন মহান রাজনীতিককে।
সাকা চৌধুরী তাঁর মামলার পুরো শুনানিতে স্বভাবগত নাটকীয়তা ও চমক দেখিয়েছেন। ‘রায় যা-ই হোক’, তিনি শুনানি শেষে আদালতকক্ষে সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছিলেন।আজ মঙ্গলবার রায় ঘোষণার দিনেও তিনি যথারীতি তাঁর অস্বাভাবিক আচরণের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছেন। ইতিমধ্যে একটি ওয়েবসাইটে তথাকথিত রায়ের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ, যা কথিত মতে আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ের কম্পিউটার থেকে মিলেছে বলেও দাবি করা হয়েছে। এ ব্যাপারে অবশ্য বিস্তারিত জানা যায়নি।
তবে সাকা চৌধুরীই হলেন প্রধান বিরোধী দল বিএনপির প্রথম নেতা এবং তিনিই প্রথম সাংসদ, যিনি যুদ্ধাপরাধের দায়ে দণ্ডিত হলেন। বিশ্বের ইতিহাসে হয়তো তিনিই হবেন প্রথম রাজনীতিক, যিনি সাংসদ থাকা অবস্থায় যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড পেলেন।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কেবলই আইনের শাসন ও এক ধরনের রিকনসিলিয়েশনের শর্ত পূরণের জায়গা থেকে যুদ্ধাপরাধের বিচার করছে—নির্বাচন সামনে রেখে সেই দাবি আরও জোরালোভাবে শুনতে চেয়েছিলাম। নির্বাচনী প্রচার থেকে কিন্তু এখন একটি বিরাট রাজনৈতিক ইস্যু দাঁড়াচ্ছে, যুদ্ধাপরাধের রায় কার্যকর করতে হলে আওয়ামী লীগকেই অন্তত আরেক মেয়াদে জয় লাভ করতে হবে। কোনো সন্দেহ নেই, নানা কারণে এ পর্যন্ত যারা ১৯৭৩ সালের আইনে দণ্ডিত হয়েছেন, তাঁদের থেকে সাকা চৌধুরীর দণ্ডাজ্ঞা কার্যকর হওয়ার প্রশ্ন অধিকতর তাত্পর্যপূর্ণ হতে পারে। এর কারণ রায় ঘোষণার সময়। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হবে বলে আশা করা হচ্ছে। আর সাকা চৌধুরীর আপিল সর্বোচ্চ আদালতে আগামী ৯০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি হওয়াটা ক্ষীণ। কেবল আপিল দায়ের করতেই অক্টোবর চলে যাবে। সে কারণে ধরে নেওয়া যায়, প্রধান বিরোধী দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য এবং বিশেষ করে সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস মরিয়ার্টির ভাষায়, বেগম খালেদা জিয়ার ঘনিষ্ঠতম উপদেষ্টা ফাঁসির মঞ্চে যাচ্ছেন না।
এই ফাঁসির রায় প্রমাণ করল, এ দেশের একজন ফাঁসির দণ্ডযোগ্য অপরাধী টানা ছয়বার সংসদের সদস্য নির্বাচিত হতে পারেন। এই রায় একাত্তরের স্বজন-হারানো মানুষের দীর্ঘকালীন পুঞ্জিভূত বেদনা প্রশমিত করবে। তাঁদের কান্না শুকানো চোখ পাবে নতুন ভাষা। তেমনি প্রভাবশালী রাজনীতিকদেরও হয়তো চোখ খুলে দেবে। তাঁরা যেন ভাবেন, অপরাধ করে পার পাওয়া যায় না। বিলম্বিত বিচার মানে দায়মুক্তি নয়। এবং বারবার নির্বাচিত হতে পারাটাই বিচারের ঊর্ধ্বে থাকা বা কারও চিরকালীন দায়মুক্তি নয়।
সাকা চৌধুরীর দণ্ডাদেশ আইনের শাসনের দাবিকে আরও তীব্রতা দেবে কি না, সেটাও দেখার বিষয় হবে। কারণ, ২০০৮ সালের নির্বাচনকালে সাকা চৌধুরী পাঁচটি মামলা থেকে ‘খালাস’ পেয়েছেন বলে দাবি করেন। এখন সেগুলোর বিষয়ে নতুন প্রজন্মের মনে অনেক প্রশ্ন জাগবে। সাকা চৌধুরীর মতে, তিনি অস্ত্র আইনের ১৯ ধারায় কোতোয়ালি থানায় দায়ের করা ৯২ নম্বর মামলায় খালাস পেয়েছেন। কোতোয়ালি থানার ৮৭ নম্বর মামলা থেকে দণ্ডবিধির ৩০২ ধারার মামলা থেকে তিনি খালাস পেয়েছেন। চান্দগাঁও থানার ২২ নম্বর মামলা থেকে খালাস পেয়েছেন। কোতোয়ালি থানায় দণ্ডবিধির ৩০২/৩৪ ধারায় ১২ নম্বর মামলা থেকে খালাস পেয়েছেন। পাঁচলাইশ থানায় ৩০২ ধারার আরেকটি মামলা থেকে খালাস পেয়েছেন। এসব মামলার ব্যাপারে রাষ্ট্রপক্ষ যথেষ্ট মনোযোগ দিয়েছিল কি?
২০০৮ সালে সাকা চৌধুরীর হলফনামায় ‘হাইকোর্টের নির্দেশে জামিনপ্রাপ্ত’ কথাটি পাঁচবার উল্লেখ আছে। দুটি মামলা হাইকোর্টের নির্দেশে স্থগিত রয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। গত সাড়ে চার বছরে যুদ্ধাপরাধী সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে এসব মামলার অভিযোগগুলো উচ্চ আদালতে প্রমাণ করার ব্যাপারে কী কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, তা জনগণের কাছে পরিষ্কার করার দরকার আছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার হারানোর যন্ত্রণায় কাতর বিএনপি এখন কিংকর্তব্যবিমূঢ়। এই অবস্থাটি এমনই নাজুক যে, বিএনপি মুখ ফুটে আর লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের দাবি তুলতে পারছে না।
আপাদমস্তক বিতর্কিত এই রাজনীতিকের বিরুদ্ধে আইসিটিতে অভিযোগপত্র দাখিল হয় বেশ আগে। তখনই উচিত ছিল বিএনপির স্থায়ী কমিটি থেকে তাঁকে সরিয়ে দেওয়া। বিএনপির অন্তত আজ সেটা করে আদালতের রায়ের প্রতি সম্মান দেখানো উচিত।
সাকা চৌধুরী মরহুম রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের দলের কোনো নিষ্ঠাবান জাতীয়তাবাদীও নন। মুসলিম লীগ, যে দলটি যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে ১৯৭১ সালের গোড়ায় মুজিবনগর সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ হয়েছিল, সেই দল থেকেই তিনি ১৯৭৯ সালে প্রথম সংসদ সদস্য হন। ১৯৮৬ সালের ভোট ডাকাতির সংসদেও তিনি জাতীয় পার্টি থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৯১ সালে তিনি তার দল ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সাল থেকে অব্যাহতভাবে বিএনপির সঙ্গে রয়েছেন। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত তিনি প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা ছিলেন।
প্রসঙ্গক্রমে, আজকের যে ট্রাইব্যুনাল সাকা চৌধুরীকে ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন, সেই ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীর বহুল আলোচিত পঞ্চম সংশোধনী মামলায় হাইকোর্ট বিভাগের অন্যতম বিচারক ছিলেন। সেই বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারক ছিলেন আইন কমিশনের বর্তমান চেয়ারম্যান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক। বিচারপতি ফজলে কবীর ১৯৯২ সালে জেলা জজ, ২০০৩ সালে হাইকোর্টে বিচারক এবং ২০০৫ সালের ২৭ আগস্ট বিচারক হিসেবে স্থায়ী হন।