১৯ জুন ২০২১ শনিবার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর কাছে অস্ত্র বিক্রি না করতে জাতিসংঘভুক্ত দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়ে একটি প্রস্তাব পাস হয়েছে ১১৯-১ ভোটে। প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট প্রদানকারী একমাত্র দেশ বেলারুশ। চীন, রাশিয়া, ভারত এবং আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোসহ অনেক দেশ ভোটদানে বিরত থাকে। তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।
প্রথমেই বলে রাখা ভালো, এমন একটি প্রস্তাব কার্যকর করার ক্ষমতা সাধারণ পরিষদের নেই। এটা মেনে চলার বাধ্যবাধকতাও তাই নেই। এরূপ অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করার ক্ষমতা আছে শুধু নিরাপত্তা পরিষদের। আর যেহেতু নিরাপত্তা পরিষদে চীন ও রাশিয়ার ভেটো ক্ষমতা আছে, তাই এরূপ কোনো সিদ্ধান্ত সেখানে পাস হবে না। অস্ত্র সংগ্রহে মিয়ানমার তাই কোনো সমস্যায় পড়বে না। বলা বাহুল্য, মিয়ানমারে মূল অস্ত্র বিক্রেতা দুই দেশ হচ্ছে চীন ও রাশিয়া। এই প্রস্তাব শুধু একটা নৈতিক চাপ সৃষ্টি করে, যে চাপে মিয়ানমারের নত হওয়ার কোনো কারণ বা সম্ভাবনা নেই।
অস্ত্র নিষেধাজ্ঞার আহ্বানসংক্রান্ত সাধারণ পরিষদের প্রস্তাবের ভোটাভুটিতে বাংলাদেশ ভোটদানে বিরত থাকায় অনেকেই বিভ্রান্ত হতে পারেন। মনে হতে পারে, বাংলাদেশ সামরিক জান্তার প্রতি নমনীয় আচরণ করছে। বাস্তবতা হচ্ছে, প্রস্তাবটি হুট করে পাস হয়নি। ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি সামরিক অভ্যুত্থানে অং সান সু চি ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকেই এ নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলো কাজ করছিল। জাতিসংঘে কিছু তো আর তড়িঘড়ি করে হয় না। এর পক্ষে সমর্থনকে সর্বজনীন করার জন্য প্রচুর দর-কষাকষি হয়েছে এবং প্রস্তাবের ভাষাও অনেক নমনীয় করা হয়েছে। এ পর্যায়ে বাংলাদেশ মিয়ানমারের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রসঙ্গে রোহিঙ্গাদের নিজ ভূমিতে প্রত্যাবর্তনের গুরুত্ব প্রস্তাবের উদ্যোক্তাদের অনুধাবন করানোর চেষ্টা করেছে।
প্রস্তাবে ভোটদানে বিরত থাকা তাই বাংলাদেশের জন্য খুব অযৌক্তিক হয়েছে বলে মনে হয় না। এ বিষয়ে স্থায়ী প্রতিনিধির দেওয়া ব্যাখ্যা যেকোনো ভুল–বোঝাবুঝি নিরসনে সহায়ক হবে বলেই আমার মনে হয়।
দুঃখজনকভাবে পশ্চিমা দেশগুলো তা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয় এবং প্রস্তাবের কার্যকর অনুচ্ছেদে (অপারেটিং প্যারা) রোহিঙ্গা প্রসঙ্গ আদৌ উল্লেখিত হয়নি। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের দিক থেকে পক্ষে ভোটদান, মিয়ানমারে তথাকথিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাই একমাত্র বিষয় বলে স্বীকার করে নেওয়া বলে বিবেচিত হতে পারত এবং প্রকারান্তরে রোহিঙ্গা সমস্যাকে অন্তরালে ঠেলে দেওয়া হতো। প্রস্তাবে ভোটদানে বিরত থাকা তাই বাংলাদেশের জন্য খুব অযৌক্তিক হয়েছে বলে মনে হয় না। এ বিষয়ে স্থায়ী প্রতিনিধির দেওয়া ব্যাখ্যা যেকোনো ভুল–বোঝাবুঝি নিরসনে সহায়ক হবে বলেই আমার মনে হয়।
আন্তর্জাতিক মানবিক সহায়তা সংস্থা ‘মেদসাঁ সঁ ফ্রন্তিয়েখ’ (ইংরেজিতে ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস)–এর হিসেবে ২০১৭ সালের আগস্টের বর্বর ও নিষ্ঠুর অভিযানে অন্তত ১ হাজার শিশুসহ কমপক্ষে ৯ হাজার অসামরিক রোহিঙ্গাকে হত্যা করেছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। বিপুলসংখ্যক নারী নির্যাতিত হয়েছেন। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়ে আট লাখ মানুষকে বাস্তুচ্যুত করে বাংলাদেশে ঠেলে দিয়েছে তারা। জাতিসংঘের মহাসচিব একে বলেছেন ‘এ টেক্সট বুক কেস অব এথনিক ক্লিঞ্জিং’। অত বড় হত্যাযজ্ঞের পরও মানবাধিকার প্রশ্নে উচ্চকিত পশ্চিমা বিশ্ব মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা দেওয়া বা আর কোনো কঠিন পদক্ষেপ নেওয়ার কোনো উদ্যোগ নেয়নি। তাদের অনেকেই তখন রাখাইন রাজ্যে বিনিয়োগ পরিকল্পনায় ব্যস্ত।
এই চরম নিষ্ঠুরতা যখন চলছিল, সু চি তখন রাষ্ট্রক্ষমতায়। তিনি একটি আঙুলও তোলেননি এই অপরাধ ঠেকাতে, বরং গাম্বিয়ার মামলায় সেনাদের পক্ষে সাফাই গাইতে গেছেন আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে। আজ ক্ষমতা থেকে সু চির অপসারণে এ দেশগুলো খুবই পেরেশান।
অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ দানা বেঁধে ওঠার পর থেকে সামরিক জান্তা এ পর্যন্ত আট শতাধিক বিক্ষোভকারীকে হত্যা করেছে। এই অপরাধীদের বিরুদ্ধে অবশ্যই কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে, শুধু নির্বিষ প্রস্তাব পাস করে কোনো ফলদায়ক কিছু হবে না। তবে একই সঙ্গে এর চেয়ে বড় যে অপরাধ তারা করেছে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে, যেকোনো পদক্ষেপের ক্ষেত্রে তাকেও বিবেচনায় রাখতে হবে।
ভুলে গেলে চলবে না, ‘রোহিঙ্গা লাইভস অলসো ম্যাটার’। সেনা নির্যাতনের আজকের ভুক্তভোগীদের উপলব্ধি করতে হবে যে অপরাধীদের অপকর্মের অংশীদার হয়ে তারা ঠিক কাজটি করেননি। এ উপলব্ধি তাদের কতটা হয়েছে, তা বলা মুশকিল। তবে সম্প্রতি যে প্রবাসী সরকার গঠিত হয়েছে মিয়ানমারে, সে সরকার রোহিঙ্গাদের প্রতি নির্যাতনকে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং ন্যায়বিচারের আশ্বাস দিয়েছে। ঘটনা কোন দিকে গড়ায় সেদিকে নজর রাখতে হবে বাংলাদেশকে এবং সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
মো. তৌহিদ হোসেন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব