‘...আপনারা সামনে যাঁরা আছেন, পারবেন না তাদের দাবায়ে রাখতে? তাদের বসাইয়া দেবেন। এই যে পায়ের হাড্ডি আছে না, হাড্ডি ভেঙে দেবেন। হাতের কবজি ভেঙে দেবেন।’ একজন রাজনৈতিক নেত্রীর বক্তব্যে তাঁর দলীয় কর্মীদের প্রতি বিশেষ নির্দেশের কিয়দংশ এটি (২১ ডিসেম্বর ২০২১, প্রথম আলো)।
‘...মানব-প্রকৃতির পরিবর্তন হবে না। ভবিষ্যতে যেকোনো জাতীয় সংকটে, আমরা সবল ও দুর্বল উভয়কেই পাব; যেমন পাব মূর্খ ও জ্ঞানীকে; ভালো ও মন্দকে। তাই যে ঘটনায় জ্ঞান অর্জনের দর্শনগুলো থাকে, আমাদের বরং সে ঘটনাগুলো পর্যবেক্ষণ করা উচিত যেন ভুল করার কারণে কারও প্রতি প্রতিশোধ নেওয়ার কিছু না থাকে’ (১৮৬৪ সালের নভেম্বরে আব্রাহাম লিংকন প্রদত্ত বক্তৃতার অংশ)।
ওপরের দু-দুটি বক্তব্যের প্রেক্ষাপট যদিও ভিন্ন, শব্দগুলো পাঠ করার পর মনে শুধু দুরকম অনুভূতিই হয় না, দুজন বক্তার ব্যক্তিত্ব তথা মানসিকতা সম্পর্কেও মনে দুরকম ধারণা তৈরি হয়। দু-দুটি বক্তব্যের কোনটায় কতটুকু শুদ্ধাচার প্রতিফলিত হচ্ছে, তা সহজেই অনুমেয়। বিজ্ঞান বলে, শব্দ বা কথা এক প্রচণ্ড শক্তি। কথা শুধু বাস্তবতার বিবরণই দেয় না, বাস্তবতা সৃষ্টি করে। আর কথা বা শব্দের ভিত্তি হলো ভাষা। ভাষার চমৎকার ব্যবহারে হৃদয়ের ভার যেমন লাঘব হয়, তেমনি এর ভুল ব্যবহারের কারণে হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়।
জাপানি গবেষক মাসারু ইমোতো তার ‘দ্য হিডেন মেসেজেস ইন ওয়াটার’ নামক বেস্ট সেলার বইতে পানি নিয়ে করা গবেষণার ফল তুলে ধরেন। মানুষের চিন্তা, ভাবনা, কথার প্রভাব পানির মলিকুলার স্ট্রাকচারের ওপর কেমন করে পড়ে, তা নিয়ে ছিল তাঁর গবেষণা। বিভিন্ন স্থানের পানি নিয়ে সেটার সামনে ভালো ভালো কথা বলা হয়েছিল, কখনো ইচ্ছা করেই পানিকে মন্দ কথা বলা হয়েছিল, তারপর সেই পানিকে ফ্রোজেন করে এর ক্রিস্টাল স্ট্রাকচারের ছবি যখন তোলা হলো বিশেষ ক্যামেরার সাহায্যে, দেখা গেল দুরকম কথার প্রভাবে ছবিও দুরকম হয়েছে। যে পানি হাতে নিয়ে একে ধন্যবাদ দিয়ে বলা হয়েছিল, তুমি আছ বলেই আমরা পান করতে পারি, তোমাকে ধন্যবাদ, সেটি দেখতে সুন্দর হয়েছে, তার একটি অপূর্ব ক্রিস্টাল স্ট্রাকচার হলো। কাচের ঝাড়বাতি দেখতে যেমন কারুকার্যময় হয়, পানির ক্রিস্টাল চেহারাও হলো সে রকম।
অন্যদিকে, যে পানিটুকু সামনে রেখে তাকে গালমন্দ করা হলো, বলা হলো যে তোমার কারণেই পানিবাহিত রোগ হয়, আমরা অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি, সেই পানির ক্রিস্টাল স্ট্রাকচার শুধু যে সাদামাটা হলো তা নয়, দেখতে লাগল বেশ বিচ্ছিরি। এমনকি বিটোফেনের সুর শুনে পানির ক্রিস্টাল আকৃতি একরকম হয়েছিল, আবার ধুমধাড়াক্কা গান শোনানোর পর হয়েছিল আরেক রকম। এ গবেষণার সারকথা ছিল এই, এক গ্লাস পানি যদি এভাবে সুন্দর বা অসুন্দর কথা দিয়ে প্রভাবিত হতে পারে, মানবদেহের ভেতরে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ পানি থাকে, তাহলে একজন মানুষকে ইতিবাচক কথা বললে, তাকে শুভকামনা জানালে, তার সঙ্গে শুদ্ধাচার করলে কী হবে আর নেতিবাচক কথা বললে, অভিসম্পাত করলে কী হবে, তা সহজেই বোঝা যায়।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি শুদ্ধাচারী জাতি হওয়ার প্রতি কি আমরা মনোযোগ দিচ্ছি? শুদ্ধাচারী না হলে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ধরে রাখা যায়? এ লেখার শুরুতে ব্যবহৃত উদাহরণের কথাগুলোর মতো শিষ্টাচারবহির্ভূত, ভীতিকর, বিপজ্জনক কথাবার্তাকে কি শুদ্ধাচার ভাবার সুযোগ আছে? বিদ্যালয়গামী শিশু-কিশোরেরা এ কথাগুলো যখন শোনে বা পত্রিকায় পাঠ করে, ভাষার ব্যবহারে কী শিক্ষা তারা পায়? প্রাপ্ত বয়সে কী শুদ্ধাচারই-বা তারা অন্যের সঙ্গে করবে?
সুবচন বা সুন্দর কথাকে শুদ্ধাচারের অংশ বলা হয়। সুউচ্চ ইমারত বা বিশাল অট্টালিকা একটি জাতির অর্থনৈতিক প্রাচুর্যের নিদর্শন হতে পারে, কিন্তু শুদ্ধাচার একটি জাতির নৈতিক ভিত্তি তৈরি করে। আদর্শ জাতি হিসেবে তাকে পরিচয় করিয়ে দেয়।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নিয়ে আজ আর প্রশ্নের সুযোগ নেই। যাকে মাত্র কয়েক দশক আগে পশ্চিমারা বলেছিল ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’, ২০২১ সালে ১৫ খাতে সে দেশের অবস্থান বিশ্বের শীর্ষ দশে। বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার এখন ৩৫ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছে। পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ তৃতীয় অবস্থানে। ‘জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে অভিযোজনের ক্ষেত্রে সেরা শিক্ষক হচ্ছে বাংলাদেশ’ (বান কি মুন, জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব)। কিন্তু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি শুদ্ধাচারী জাতি হওয়ার প্রতি কি আমরা মনোযোগ দিচ্ছি? শুদ্ধাচারী না হলে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ধরে রাখা যায়? এ লেখার শুরুতে ব্যবহৃত উদাহরণের কথাগুলোর মতো শিষ্টাচারবহির্ভূত, ভীতিকর, বিপজ্জনক কথাবার্তাকে কি শুদ্ধাচার ভাবার সুযোগ আছে? বিদ্যালয়গামী শিশু-কিশোরেরা এ কথাগুলো যখন শোনে বা পত্রিকায় পাঠ করে, ভাষার ব্যবহারে কী শিক্ষা তারা পায়? প্রাপ্ত বয়সে কী শুদ্ধাচারই-বা তারা অন্যের সঙ্গে করবে?
এক মা রাগের মুহূর্তে তার সন্তানকে বলেছিলেন, তোকে একটা চড় দেব। সন্তান প্রথমে বোঝেনি চড় জিনিসটা কী? কারণ, এর আগে সে কখনো কাউকে চড় খেতে দেখেনি, নিজেও খায়নি। তবে মায়ের টোন শুনে বুঝেছে যে এটি আর যা-ই হোক, কোনো আদর নয়; কোনো এক ধরনের শাস্তি তো বটেই। পরদিন সে দু-তিনবার বলে উঠল, তোকে একটা চড় দেব। সেটা শুনে তার বাবা জানতে চাইলেন, কী ব্যাপার মা? সে ঝটপট উত্তর করছে, এটা তেলাপোকাকে বলেছি আমি! আজ যেটা তেলাপোকাকে বলতে সে অভ্যস্ত হচ্ছে, কাল সহপাঠীকে, পরশু সহকর্মীকেও নিশ্চয়ই বলতে অভ্যস্ত হয়ে যাবে।
ভাষা দিবসের মাসে ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে আমরা বাংলা ভাষার প্রতি দরদ, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা প্রকাশ করি। কিন্তু অশুদ্ধ ভাষা ব্যবহারে অশুদ্ধ আচরণ করার মাধ্যমে যে সেই ভাষাকেই আমরা অসম্মান করি, সেটা বুঝতে পারি কি?
বাবার রাত করে বাড়ি ফেরা নিয়ে মা যদি সন্তানকে বলেন, তোর বাবা এত রাত করে বাড়ি ফেরে, কোথায় যায়, কী করে। আবার বাবাও যদি সন্তানকে তার মা কত খারাপ, এটা বোঝানোর জন্য অনেক কিছু বলে থাকেন, এই সন্তান মা-বাবাকে সম্মান করতে শেখে না, শ্রদ্ধা করতে শেখে না। মা যদি সন্তানদের বলেন, দেখেছিস তোর দাদি আমার সঙ্গে কী আচরণ করেছে? স্বামী যদি স্ত্রীকে বলেন, তোমাদের বাড়িতে কখনোই আমাকে ঠিকমতো আদর-যত্ন করে না, জামাইকে কেউ এভাবে খাওয়ায়? এই যে পরস্পরের আত্মীয়ের নিন্দা, যে সন্তান এগুলো শুনে বড় হয়, সে কখনো সৌজন্যতাপূর্ণ ভাষার ব্যবহার শিখবে না, শুদ্ধাচারী হবে না।
যে ঘরে যত শুদ্ধাচার, সে ঘরের মানুষ তত প্রশান্তিতেই থাকে। ভাষার রূঢ় ব্যবহারে যেসব কথা পরিবারে শুদ্ধাচারবর্জিত আচরণের সূত্রপাত ঘটায়, তার কিছু উদাহরণ না দিলেই নয়। অবশ্যবর্জনীয় এসব কথার কয়েকটি হলো: ‘তোকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না’, ‘উনি একজন আইনস্টাইন হয়েছেন’, ‘তোমার বুদ্ধিতে কাজ করলে সব শেষ’, ‘তুই মরতে পারিস না’, ‘লজ্জা নেই—এত বয়স বিয়ে হচ্ছে না’, ‘ (বাবা মা-কে) যত বুড়ো হচ্ছ, ভীমরতিতে ধরছে’, ‘ওর সমস্যা ও বাধিয়েছে, আমি কী করব’, ‘নিজেদের পথ নিজেরা দেখো—আমি আর তোমাদের টানতে পারব না’, ‘তোমাদের বুদ্ধিশুদ্ধির এ কী দশা’...ইত্যাদি। এ কথাগুলো না শুনতে ভালো লাগে, না সমস্যার সমাধান আনতে পারে। অনায়াসেই এ কথাগুলো ইতিবাচকভাবে বললে শ্রোতার ভেতরে চিন্তা জাগ্রত হয় এবং শ্রোতা সমস্যার সমাধান নিয়ে ভাবতে পারেন।
জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল ২০১২-এর ভূমিকায় বলা হচ্ছে, শুদ্ধাচার বলতে সাধারণভাবে নৈতিকতা ও সততা দ্বারা প্রভাবিত আচরণগত উৎকর্ষকে বোঝায়। একজন নীতিসম্পন্ন মানুষ যেমন অশালীন-অশুদ্ধ, তির্যক-বিদ্রূপাত্মক কথাবার্তা বলতে পারে না, তেমনি ভাষার শুদ্ধচর্চা তথা সুবচন ব্যবহারে নিজের আচরণগত উৎকর্ষ অর্জন করা যায়। শুদ্ধাচার কৌশল প্রণয়নের পাশাপাশি এ কৌশল বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর কর্তৃক নেওয়া সিদ্ধান্তটি প্রশংসার দাবি রাখে। ২০২০ সালের ২৫ মার্চ জারিকৃত আদেশে লুপ্তপ্রায় কিছু শিষ্টাচার-বাণীর বাংলা ভাষার সংকলন ‘শুদ্ধাচার’ বইটি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের সব অফিস ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গ্রন্থাগারে রাখার কথা বলা হয়েছে। একই কথা শুধু বলার ধরনের কারণে কীভাবে মনে দুই রকম প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, তা খানিকটা দেখা যাক—
একবার এক রাজা জ্যোতিষীকে ডাকালেন হাত দেখার জন্য। জ্যোতিষী রাজার হাত দেখার পর মুখ কালো করে বললেন, মহারাজ, আপনার মতো হতভাগা আর কেউ নেই। রাজা জিজ্ঞাসা করলেন, কেন? জ্যোতিষীর উত্তর: মহারাজ আপনার সামনে আপনার স্ত্রীর মৃত্যু হবে, আপনার সামনে আপনার ছেলের মৃত্যু হবে, আপনার সামনে আপনার নাতির মৃত্যু হবে, তারপরও আপনি মারা যাবেন না, আপনি বেঁচে থাকবেন। এদের সবার মৃত্যুযন্ত্রণা আপনাকে স্বচক্ষে দেখতে হবে।
রাজা খেপে গেলেন এবং মুহূর্তে জল্লাদকে নির্দেশ দিলেন জ্যোতিষীর কল্লা কেটে ফেলার জন্য। জ্যোতিষীর কল্লা কেটে ফেললেও তিনি যে স্বস্তিতে ছিলেন তা নয়। চিন্তাগ্রস্ত রাজা আরেক রাজ্য থেকে জ্যোতিষীকে আমন্ত্রণ করলেন। জ্যোতিষী এসে হাত দেখে একটা চমৎকার হাসি দিয়ে বললেন, ‘আপনার আয়ু ঈর্ষা করার মতো। আপনি আপনার স্ত্রী, আপনার সন্তান, আপনার নাতি, এদের সবার চেয়েও দীর্ঘায়ু হবেন।’ রাজা তাঁকে তাঁর নিজের গলার মালাটা খুলে দিয়ে দিলেন এবং অনেক উপঢৌকনের ব্যবস্থা করলেন। দুটোই কিন্তু সত্য। প্রথম জ্যোতিষী যা বলেছেন তা সত্য, দ্বিতীয় জ্যোতিষী যা বললেন তা-ও সত্য। একভাবে বলে প্রথম জ্যোতিষীর গর্দান হলো আর দ্বিতীয় জ্যোতিষী গলায় মালা নিয়ে চলে গেলেন।
ভাষা দিবসের মাস চলে গেলেও সুবচন ব্যবহারের মাধ্যমে শুদ্ধাচারী হওয়ার অনুশীলন করা যায় বছরজুড়েই। বেরিয়ে আসা যায় হাড্ডি ভাঙাভাঙির সংস্কৃতি থেকেও।
ড. ইশরাত জাকিয়া সুলতানা সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, সদস্য, সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ, নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়।