'মা, এবার মনে হতিছে আমরা বাঁইচে গেলাম'

‘মা, এবার মনে হতিছে আমরা বাঁইচে গেলাম’
‘মা, এবার মনে হতিছে আমরা বাঁইচে গেলাম’

কোনো দিন যাইনি সুন্দরবন। তারে আমি দেখেছি কুয়াকাটার ওপারে, খুলনার প্রান্ত থেকে তার কুয়াশাঘেরা সবুজের বাঁধ দেখেছি, বাগেরহাট-ফকিরহাটে ছুঁয়েছি তার ধূসর রূপ। একদিন যাব, একদিন যাব তার কাছে; এই আশা পুষে রেখেছিলাম। তার হলদে কালো নদীগুলো, তার আন্ধারমানিকের আলেয়ার আলো, তার ভেজা মাটি ফুঁড়ে ওঠা বায়ুভুক বল্লমের মতো সুন্দরী শিকড়, তার চিরল চিরল গোলপাতা, হঠাৎ উড়াল দেওয়া বকের ঝাঁক, বনের গহিনে কোনো খালের বাঁকে নৌকা থামিয়ে মোহগ্রস্ত কল্পনায় কত যে বুঁদ হয়ে থেকেছি। জাতীয় কমিটির সদস্যসচিব আনু মুহাম্মদ সুন্দরবনকে বলেছেন, মায়ের মতো মহাপ্রাণ। শোনামাত্রই ভুলে যাওয়া দূরে থাকা সেই মায়ের সজল সন্ধ্যার মতো রূপ ভেসে উঠল। ভালোবাসা কখনো হাহাকার জাগায়। সে রকম এক হাহাকার নিয়ে হাজার হাজার মানুষ সুন্দরবনের কাছে যাচ্ছে; এর থেকে সুন্দর আর কী হতে পারে! গাইবান্ধার ছাত্র, মাগুরার বৃদ্ধ চাষি, ঢাকা-রাজশাহী-বরগুনা-চট্টগ্রাম—কোথাকার মানুষ নেই সেখানে! বিদেশবিভুঁইয়ের দ্যাশের দেশিও বাদ নেই। তারা একে বলছে লংমার্চ; সরকার বলছে নাটক। হ্যাঁ, নাটকীয়ই তো ঘটনাটা। মাতৃমুখী সন্তানদের মায়ের কাছে ফেরার থেকে আবেগ উথলানো নাটকীয়তা আর কী হতে পারে!
সুন্দরবনের ধার ঘেঁষে বাস করা একটি কিশোরী বাবার ডিঙিটা নিয়ে একা একা বড় খালের ভেতর হারিয়ে গিয়েছিল। নির্জন এক খাঁড়ির মুখে কী মনে করে নেমেও পড়েছিল। ‘বারো বছরের ফুলি নদীর ওপরের উজ্জ্বল রোদের দিকে চেয়ে ভীষণ ছায়াময়, খুব ঠান্ডা, দুদিকে কাদাভরা খাঁড়ি ধরে হেঁতাল আর বেতবনে খসখস আওয়াজ করতে করতে অনেকটা ভিতরে ঢুকে পড়ল...সবই নিবিড় ছায়া আর ঘন নিবিড় চুপ। এই মহাপৃথিবীতে নিঃশব্দই মূল সংবাদ, সেটাই বাস্তবতা এখানে, এই সুন্দরবনে...তাই একটা পাতা গাছ থেকে খসে পড়ে বাজের শব্দে, কেন্নো চলে কিরকির করে, ন্যাড়া শিমুলের ডালে নিথর মাছরাঙা—জমাট স্থির—একবার বিষাদখিন্ন ডেকে উঠলে অতল শূন্যতা হাহাকার করে ওঠে আর মাটিতে মুখ লাগিয়ে ডোরাকাটা গর্জন করলে মাটি চৌচির হয়ে যায়।’
ঢাকা থেকে তেমনি গর্জন আর সংগীত নিয়ে মানুষগুলো দিনে হেঁটেছে, রাতে ঘুমিয়েছে কোনো স্কুলের বেঞ্চিতে, লাইন ধরে খেয়েছে খিচুড়ি (লংমার্চের সৈনিক, খিচুড়ি খায় দৈনিক), গোসল সেরেছে পুকুরে বা নদীতে। মনের মধ্যে ‘বাড়ি যাচ্ছি বাড়ি যাচ্ছি’ ভাব। রাতজাগা গান, বৈঠক, সব যেন দেশের মাটির বুকে পদচিহ্নে লেখা এক সংগ্রামী পথের পাঁচালি।
মানুষের বুকের মধ্যে একটা কলস থাকে। কারও কলসখানি জলভরা, কারওটা ফাঁকা, কারওটার আধেক ভরা। মনে আলোড়ন জাগলে সেই কলসের জল উছলাতে থাকে। যার মধ্যে মানবিক আলোড়ন নেই, সেই রাষ্ট্রযন্ত্রের কলস পুরোটাই ফাঁকা। যতই বাজে, ততই অশান্তি আনে। সাত বছরের অঙ্কন হালদার যখন লংমার্চের হাজার হাজার মানুষ দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে তার মাকে বলল, ‘মা, এবার মনে হতিছে আমরা বাঁইচে গেলাম’; তখন টের পেলাম, ওর বুকের কলসটা কানায় কানায় পূর্ণ এখন। মা তার হাসপাতালের নার্স, থাকেন যশোরে। রামপাল ধ্বংসের আতঙ্ক ওদের পারিবারিক আবহ। লংমার্চ সেই আবহ কাটিয়ে দিয়েছে; ও জেনে গেছে রামপালকে ধ্বংস করা যাবে না। এই যে এত মানুষ ঢাকা থেকে শত শত কিলোমিটার হেঁটে এসেছে, সেটা কি মিথ্যা? জাতীয় কমিটির ডাকে সুুন্দরবন বাঁচাতে ঢাকা-রামপাল লংমার্চের এটাই পরম প্রাপ্তি। সুন্দরবনের লাখো মানুষ জেনে গেছে, তারা একা নয়।
মানুষের মনে এত কথা আছে সুন্দরবন নিয়ে, এত দরদ তাদের বুকে! ঢাকা থেকে মানিকগঞ্জ, মানিকগঞ্জ থেকে আরিচা-দৌলতদিয়া হয়ে ফরিদপুর, মাগুরা, ঝিনাইদহ, যশোর হয়ে লংমার্চ খুলনায় পৌঁছালে সে এক রীতিমতো উৎসব। অঝোর বৃষ্টিতে শহর ডুবে গেছে, তার মধ্যে লংমার্চের পদাতিক বাহিনী নেচেগেয়ে স্লোগানে শহর মাতিয়ে তুলছে। বৃষ্টির জন্য হাদিস পার্কের জনসভা হতে পারেনি, তবু জনসমাগম ছিল দোকানের ছাউনির নিচে, গাছতলায়, ছাতার তলে। এবং মানুষ কথা বলে গেছে। কী হবে সুন্দরবনের, ঠেকানো কি যাবে সরকারের আত্মঘাতী আয়োজন? টক শো থেকে পথসভা, হাটুরে মানুষের কথাবার্তা, ঘরের মধ্যে ভাইবোনের আলাপ; লংমার্চের কদিন দক্ষিণের সুন্দরবন জেগে উঠেছিল দেশজুড়ে মানুষের চেতনায়। মাত্র কয়েক হাজার মানুষ পথ হাঁটছে; অথচ তাদের সঙ্গে ছিল লাখো কোটি মানুষের আশীর্বাদ। চুলকাটি বাজারের পথসভা শেষ করে এগোবার পর সৌদি আরব থেকে জনৈক খোরশেদ আলমের ফোন আসে। শুনি, তিনি কাঁদছেন, বলেছেন, ‘ভাই, মনে পাপ লাগছে, আপনাদের সঙ্গে থাকতে পারছি না।’ অসাধারণ এক সংহতি। তাই ব্যর্থ হওয়ার সুযোগ নেই। ব্যর্থ হলে বাংলাদেশ বাঁচবে না, সাগরের বিনাশী প্লাবন থেকে কেউ আর উপকূলের কোটি মানুষকে আগলে রাখবে না, পৃথিবীর গর্ব হারিয়ে যাবে, বাংলাদেশের গর্ব রাজসিক বাংলা বাঘ কেবল জাতীয় ক্রিকেট দলের জার্সিতেই থাকবে, বাস্তবে তার দেখা আর পাব না।
এ সূত্রে তারেক রহমানের রূপকল্পের কথা মনে পড়ল, তিনি সুন্দরবনে বিদেশি পর্যটকদের জন্য সাফারি পার্ক বানাতে চান। সুন্দরবন কেমন বন, সেই ধারণাটাও তাঁর নেই! ব্যবসায়ীবন দেখলে বোঝে কাঠ আর পর্যটন ব্যবসা, আর মানুষ দেখে প্রাণ ও প্রকৃতি। সত্য কখনো ক্ষমতার সংসারে থাকতে পারে না। আর ক্ষমতা চিরকালই চেতনানাশক।
জাতীয় কমিটির ডাকে এ নিয়ে ছয়টি লংমার্চ হয়েছে। ২০০২ সালে বিবিয়ানায় গ্যাস রপ্তানি ঠেকাতে, ওই বছরই চট্টগ্রামে বন্দর ইজারার বিরুদ্ধে, ২০০৩ সালে মংলা বন্দর রক্ষার দাবিতে খুলনায়, ২০১০ সালে এশিয়া এনার্জির ফুলবাড়ী ধ্বংসের বিরুদ্ধে। এর আগে ফুলবাড়ীর সেই ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থান—যেখানে বিডিআরের গুলিতে নিহত হয়েছিল তিন কিশোর, আহত হয়েছিল শত শত। ২০১১ সালে ঢাকা-সুনেত্র লংমার্চ। কোনো লংমার্চই বৃথা যায়নি। রামপালের দ্বিগরাজ অভিমুখের ষষ্ঠতম লংমার্চটি এরই ধারাবাহিকতা। লংমার্চ চিনা পদার্থ না, ১৯২১ সালে সুরমা উপত্যকার পাইনকা চা-শ্রমিকেরা লংমার্চ করে তাদের আদিভূমিতে যাওয়ার পথে গোয়ালন্দ ঘাটে গণহত্যার শিকার হন, মেঘনার পানি সেদিন রক্তে লাল হয়ে যায়। বিদ্রোহী সাঁওতালরাও দলে দলে কলকাতামুখী হলে ইংরেজের বর্বরতার শিকার হন। মওলানা ভাসানীর ফারাক্কা লংমার্চ তো ইতিহাস।
ফুলির গল্পটা লিখেছেন বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্পকার হাসান আজিজুল হক। ভাবিনি, সত্যিই ফুলিরা আছে। রামপালে পশুর নদীর এপারে দ্বিগরাজ, ওপারে সুন্দরবন। সেটাই লংমার্চের শেষ ঠিকানা—এর বেশি যেতে দেবে না সরকার। বাজারে ঢোকার মুখে, রাস্তার দুই পাশে বস্তিমতো ঘরবাড়ি। বাগেরহাটের পর থেকেই বাজারে, লোকালয়ে অজস্র মানুষের অপেক্ষা দেখেছি, লংমার্চের গাড়িবহর কিংবা পদযাত্রা চোখের সীমানায় আসামাত্রই তাদের চোখমুখের ঝলকানি দেখেছি। কিন্তু মেয়েদের দেখেছি কম, তারা হয়তো ঘরসংসার, বিদ্যালয়ে আর মাঠে ব্যস্ত। দ্বিগরাজে ওদের নীরব অভ্যর্থনা পেলাম। ওই সব গরিব ঘরের মা এসেছে বাচ্চা কোলে, ভাইটি এসেছে বোনটির সঙ্গে, দল বেঁধে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে অনেকগুলো ছেলেমেয়ে। ওদেরই মধ্যে ফ্রক পরা ফুলিকে দেখি। বাঘ, ফুলি ও শিয়াল গল্পে যে ফুলি শামুক, কাঁকড়া কুড়াতে কুড়াতে সুন্দরবনের খাঁড়িতে হারিয়েছিল, বিকেলের রোদে শ্রান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল বড় এক সুন্দরী গাছের নিচে সবুজ ঘাসের ঢালে। তার মধ্যেই চোখ মেলে সে দেখল, ‘বেতবনের পাশে ঘাসের ভিতর শরীরের অর্ধেকটা ডুবিয়ে তারই মতো মোহঘুমে শুয়ে আছে ডোরাকাটা।’ থাবার ওপর মাথা রেখে সেও অপলক চাহনি ডুবিয়েছে ফুলির চোখে। নয়নভরে এক জীবনের তৃষ্ণা মিটিয়ে নিল তারা, সারা জীবন আর না দেখলেও বাঘটির কিছুই সে ভুলবে না। সেই প্রথম রোমাঞ্চভরা চাহনি দিয়েই ফুলিরা লংমার্চের আগমনও দেখছে। মহাকায় বাঘের দীর্ঘ লেজের মতো মিছিল যেন শেষই হয় না, ওরাও ফুলির মতো অপলক। এই স্মৃতি ওরাও ভুলবে না। যেমন ভুলব না, ‘পশুর নদীর মোহনা, তোমার আমার ঠিকানা’। লংমার্চেআমরা ঠিকানা চিনেছি।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জন্মদিনের দিনই ছিল লংমার্চের শেষ দিন। তিনি যখন নিউইয়র্কে, আনু মুহাম্মদ আর প্রকৌশলী শহিদুল্লাহর নেতৃত্বে লংমার্চ তখন পা রেখেছে সুন্দরবনের এপারের মাটিতে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার জন্ম যেমন শুভ, তেমনি শুভ এই সব ফুলি আর অঙ্কনদের জীবন। প্রকৃতিবিনাশী, অলাভজনক, গণধিক্কৃত কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র করতে গিয়ে আপনি এদের জীবনকে অশুভ করে দেবেন না। যার পক্ষে যুক্তি নেই, সত্য নেই, তা প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে বিশ্বের নিন্দা কুড়াবেন কেন আপনি? বাগেরহাটের ট্রাফিকের মোড়ের চা-ওয়ালা জয়নাল আমাকে একটা কথা বলতে বলেছে সবাইকে। তাঁর হয়ে বলছি, ‘কিসের উন্নয়ন? ভারত দিচ্ছে কয় টাকা আর বাংলাদেশ কয় টাকা? সুন্দরবন কী, তা আমরা জানি না? ছোটবেলা থেহে দ্যাখচি...আমি মুক্তিযোদ্ধা আবার একাত্তরের হাতিয়ার গর্জে উঠপে।’
এ দেশের আর কিছু নেই, সরল সাহসী জনগণ আছে। হতাশার খাদ লাফিয়ে পার হওয়ার মতো তারুণ্য আছে। আর আছে লংমার্চে যাওয়া আজকের মুক্তিযোদ্ধারা। মহাপ্রাণ সুন্দরবন তাদের মা, পশুর নদীর মোহনায় তারা পেয়েছে তাদের জন্মভূমির নতুন ঠিকানা। এই ঠিকানা ধ্বংস হওয়ার নয়।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
[email protected]