অপেক্ষমাণ বাসযাত্রীদের কথা

থমকে গেছে পুরো দেশ। লাখো মানুষ নড়তে-চড়তে পারছে না। আমিও পারছি না। আমার আম্মা রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। অনেক দিন ধরে অসুস্থ। গতকাল একটি মাইল্ড হার্ট অ্যাটাকের পর তাঁর জীবন এখন ঝুঁকিপূর্ণ। আমি তাঁকে দেখতে যেতে পারছি না। রেল যোগাযোগ বন্ধ। বাস ছাড়বে না। বহু দিন পর দেশে একটি হরতাল-অবরোধবিহীন দিন এল। তবু দেশের মানুষ যে যার অবস্থানে, গ্রামে, শহরে বন্দী হয়ে পড়ল। যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসি হওয়ায় সব রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে জামায়াত-শিবির ও তাদের সমর্থকেরা।

রাষ্ট্র কি জামায়াতের রাজনীতি করার এই জঙ্গি পদ্ধতি সম্পর্কে অবগত নয়? বাসওয়ালারা বারবার খবর জানাচ্ছেন, চান্দাইকোনা থেকে শেরপুর—পুরো মহাসড়কের ওপর গাছ কেটে কেটে ফেলে রাখা হয়েছে। মোকামতলা থেকে পলাশবাড়ী, মিঠাপুকুর থেকে দমদমা এলোমেলোভাবে পড়ে আছে লাখো গাছের ‘মৃতদেহ’। সেগুলো সরানোর কেউ নেই। বগুড়ায় সেতু ভেঙে ফেলা হয়েছে, রংপুরে এমনকি সংবাদপত্রও পৌঁছায়নি। ডোমারে ১২টি হিন্দুবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। এক এক যাত্রীর ফোনে এক এক রকম ভয়ানক খবর আসছে আর কল্যাণপুর বাসস্ট্যান্ডে হাজার হাজার মানুষের মুখ শুকনা হয়ে যাচ্ছে। এক যাত্রী মুঠোফোনে জেনেছেন যে মিঠাপুকুরে সড়কের ওপর নারী ও শিশুদের বসিয়ে রাখা হয়েছে, যাতে সড়ক থেকে গাছ কেউ না সরাতে পারে! মহাখালী বাসস্ট্যান্ডে অপেক্ষা করছেন আমার মামা। তিনি জানালেন সেখানকার হাজার হাজার আতঙ্কগ্রস্ত, বিষণ্ন মানুষের কথা। যারা এক দিনে কাজে ঢাকায় এসে আটকে পড়েছিলেন, তাঁদের চোখ জলে ছলছল। হোটেলে থাকতে থাকতে পকেট ফাঁকা হয়ে গেছে। খাওয়ার পয়সাও নেই।

আমার মায়ের মতো কতজনের প্রিয়জনই না মৃত্যুশয্যায়। কিন্তু একটু কাছে যাওয়া যাচ্ছে না! তা হলে রাষ্ট্র কি জনগণের স্বাভাবিক জীবনযাপনের অধিকার নিশ্চিত করতে ব্যর্থ! জনগণের ট্যাক্সের পয়সায় গড়ে ওঠা পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি, সেনাবাহিনী কেউ পারেনি এভাবে বৃক্ষ হত্যা ঠেকিয়ে দিতে, মানুষের জীবনে বিপর্যয় সৃষ্টি করা প্রতিরোধ করতে। একটি অবোধ শিশুও অনুমান করছিল যে একজন যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি হলেই নিবন্ধন অবৈধ ঘোষিত হওয়া রাজনৈতিক দলটি সহিংস হয়ে উঠতে পারে। তাহলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠানগুলো প্রস্তুতি নেয়নি কেন? নাকি এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি করার সুযোগ দেওয়া হলো?

সড়কের পর সড়ক কেটে দেশটিকে হাজারো বিচ্ছিন্ন অবরুদ্ধ দ্বীপে পরিণত করার সুযোগ কীভাবে পেল দুর্বৃত্তরা? কল্যাণপুরের ব্যর্থ, অবসন্ন যাত্রীরা চোখ লাল করে পরস্পরকে একটির পর একটি প্রশ্ন করে যাচ্ছেন। নারীরা ভীতসন্ত্রস্ত। শিশুরা যেন কিছুই বুঝতে পারছে না। ঢাকায় যাঁদের আত্মীয়স্বজন নেই, তাঁরা পড়েছেন অকূলপাথারে। অনেকেই টেলিভিশনের দিকে চোখ আটকে রেখে শিউরে শিউরে উঠছেন। সাতক্ষীরা, বগুড়া, লক্ষ্মীপুর, খুলনা, রাজশাহী, মিঠাপুকুর একেকটি বিপর্যস্ত এলাকার ছবি টেলিভিশনের পর্দায়।

১৬ ডিসেম্বর সবকিছু মোটামুটি স্বাভাবিক ছিল। সবাই দেশপ্রেমিক হয়ে উঠেছিলেন। যাত্রীভর্তি বাস পোড়ায়নি। মোড়ে মোড়ে অদৃশ্য হাতে ককটেল ছুড়ে আতঙ্ক তৈরি করেনি। দেশের মাটি, সম্পদ ও মানুষ তছনছ করে দেয়নি। আজ ১৭ ডিসেম্বর থেকে আবার শুরু হচ্ছে অবরোধ। তাহলে এক দিনের জন্য মানুষের স্বস্তি? তাহলে মানুষ কোথায় যাবে? মানুষের প্রশ্নের যেন শেষ নেই। দেশের মানুষ রাজনীতিকদের বিদ্বেষের বিষে আক্রান্ত। একটি স্বাধীন দেশ এতটা বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতিতে কীভাবে পতিত হয়? মানুষ দায়ী করার জন্য কাউকেই খুঁজে পায় না।

কদিন আগে আমাদের এক বন্ধু গুলশানের নিকেতন থেকে অফিস শেষে বাসায় না ফেরায় পরিবার গিয়েছিল গুলশান থানায় সাধারণ ডায়েরি করতে। গুলশান থানা সেটা করতে রাজি হয়নি। কারণ, ঠিক কোন স্থান থেকে ভদ্রলোক নিখোঁজ হলেন, তা উল্লেখ করতে হবে। পরে জানা গেছে যে তিনি অপহূত হয়েছেন। বন্ধুপত্নীর কাছে ফোন করে পাঁচ লাখ টাকা মুক্তিপণ চাওয়া হয়েছে। শেষে তিন লাখ টাকায় রফা হয়েছে।

পুলিশ এখন রাজনৈতিক সহিংসতা সামাল দিচ্ছে। ছোটখাটো অপরাধের দিকে নজর দেওয়ার সময় এখন আর নেই। কিন্তু সহিংসতা থামানো যাচ্ছে না। মানুষ ভীতসন্ত্রস্ত। নিরাপত্তাহীনতায় আক্রান্ত। অসুস্থ বোধ করছে সবাই। কিন্তু সমাধানের সম্ভাবনাও দেখছে না সাধারণ মানুষ। কেন একটি স্বাধীন, দ্রুত প্রবৃদ্ধিপরায়ণ দেশ এভাবে থমকে গেল?

কল্যাণপুরের অস্থির মানুষগুলোর চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হলো, অতিষ্ঠ জনগণ হয়তো এখন রাস্তায় নামবে শান্তির জন্য। রাজনীতির আগুনে প্রতিটি ঘর পুড়ছে। অস্থিরতায় মানুষ অতিষ্ঠ। মানুষ মনে করে, রাজনীতির মধ্যে এমন কোনো উপাদান থাকা উচিত নয়, যা প্রত্যেক ব্যক্তিকে বিক্ষত করে দেয়। নিজের নিজের মতো করে সরব হয়ে উঠতে শুরু করেছে সাধারণ মানুষ। হয়তো একসঙ্গে জ্বলে উঠবে সবকিছু জ্বালিয়ে খাঁটি করতে।

শান্ত নূরুননবী: উন্নয়নকর্মী।