আওয়ামী লীগের সম্মেলন: উচ্ছ্বাস ও বাস্তবতা

আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনের রাজকীয় মঞ্চ
আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনের রাজকীয় মঞ্চ

বাংলা টিভি দেখি না আমি বহুদিন। আগে দেখতাম যাঁদের কথা শোনার জন্য, তাঁদের দেখা যায় না কোথাও। আকবর আলি খান, আসফউদ্দৌলা, ব্যারিস্টার রফিক-উল হক টিভিতে আসেন না বহুদিন। এবিএম মূসা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। আমার অন্য দুজন প্রিয় আলোচক দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য ও নূরুল কবীরকে টিভি অনুষ্ঠানে দেখা যায় খুবই কালেভদ্রে। টক শো, আলোচনা অনুষ্ঠানের মতো সংবাদও আমার একঘেয়ে, একতরফা ও মূল্যহীন লাগে অনেক ক্ষেত্রে।
আওয়ামী লীগের এবারের কাউন্সিল উপলক্ষে বহুদিন পর টেলিভিশন দেখা হলো আমার। এই কাউন্সিল নিয়ে আমারও আগ্রহ ছিল। এ​ই কাউন্সিল আয়োজনে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার ছাপ ছিল সর্বত্র। প্রধান প্রধান সড়কে কয়েক দিন ধরে চলে আলোকসজ্জা, বিলবোর্ড, ফেস্টুন, ব্যানার ও পোস্টারে ছেয়ে যায় শহর, বিশাল টেলিভিশন বসানো হয় প্রায় মানবশূন্য কোনো কোনো সড়কে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শনিবারের ক্লাস স্থগিত করা হয়, বহু স্কুল রোববার বন্ধ করে দেওয়া হয়, শহরের অন্য প্রান্তের অফিসযাত্রীরা ছুটি নিয়ে নেন অনিশ্চয়তায়। অধিকাংশ নগরবাসীকে প্রায় গৃহবন্দী করে রেখে এই কাউন্সিল কী অর্জন করতে যাচ্ছে, তা নিয়ে আগ্রহ সবারই থাকার কথা।

আমি নিন্দুক প্রজাতির মানুষ। তাই সম্মেলনের অর্জন বোঝার জন্য বহুদিন পর টিভির আলোচনা অনুষ্ঠান দেখি। সম্মেলন ভালো হয়েছে, মানুষ সুশৃঙ্খল ছিল, সম্মেলনে বিদেশিরা এসেছেন, প্রশংসাও করেছেন আওয়ামী লীগের, সাধারণ সম্পাদক পদে ওবায়দুল কাদের এসেছেন, সৈয়দ আশরাফ নিজেই তাঁর নাম প্রস্তাব করেছেন, ভিশন ২০৪১ দেওয়া হচ্ছে, আওয়ামী লীগের কাউন্সিলররা চাইলেও সজীব ওয়াজেদ জয়কে নেতৃত্বে আনা হয়নি। এসব ভালো কথা আলোচকেরা মুগ্ধ হয়ে বলেছেন। এসব আলোচনা করতে গিয়ে সুযোগ পেলে বিএনপিকে কষে গালমন্দও করেছেন।

সম্মেলন নিয়ে নির্মোহ সমালোচনা হয়নি কোথাও বলতে গেলে। কোনো কোনো বেয়াড়া উপস্থাপক অপ্রিয় কিছু প্রসঙ্গ তোলার চেষ্টা করেছেন। যেমন প্রশ্ন তোলা হয়েছে আওয়ামী লীগের ভেতর গণতন্ত্র কোথায়, কেন কোনো নির্বাচন হলো না, এমনকি সাধারণ সম্পাদক পদেও? অধিকাংশ আলোচক এর উত্তরে বলেছেন: এটাই গণতন্ত্র। ওবায়দুল কাদেরের বিরুদ্ধে কেউ না দাঁড়ালে কী করার আছে? বিভিন্ন কমিটির নেতা নির্বাচনের দায়িত্বও সভানেত্রীর হাতে কাউন্সিলররাই তুলে দিলে কার কী বলার আছে?

তাঁদের মতে, এটাই নাকি বাংলাদেশের রাজনীতির বাস্তবতা। উদাহরণ হিসেবে বিশদভাবে বিএনপির কথা এসেছে। বিএনপি কত অনিয়মিত কাউন্সিল করে, বিএনপির নেত্রী কতটা স্বৈরাচারী দলের ভেতর, কতগুলো পদে এখনো ঠিক করা হয়নি নেতা—এসব প্রসঙ্গ এসেছে। সবচেয়ে সুস্বাদু আলোচনার বিষয় হয়েছে কীভাবে তারেক রহমানের মতো এত ‘খারাপ ও অযোগ্য’ একজন মানুষ উড়ে এসে বিএনপির নেতা বনে গেছেন এর বয়ান! 

.

এই ট্রেন্ডটা চলছে বহুদিন ধরে। আওয়ামী লীগের কোনো ত্রুটির কথা তুললেই শুরু করা হয় বিএনপি কত খারাপ এই আলোচনা। কখনো কখনো তা হয়ে ওঠে একতরফা, যুক্তিহীন ও অন্যায্য। আওয়ামী লীগের সম্মেলন নিয়ে আলোচনার সময়ও তা বাদ থাকেনি। উদাহরণ দিয়ে বলি। সম্মেলন উপলক্ষে একটি আলোচনা অনুষ্ঠান চলাকালে টেলিফোনে আমার মন্তব্য চাওয়া হয়। আমি অন্য কিছু বিষয় বলে নাগরিক ভোগান্তির কথা তুলি। বাম মোর্চার মতো প্রগতিশীল একটি সংগঠন যখন রামপালবিরোধী ছোট্ট একটা মিছিল করেছিল, পুলিশ তাদের পিটিয়ে ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছিল। পুলিশের বক্তব্য, তারা নাকি রাস্তায় মিছিল করে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করেছিল। আমি তাই অনুষ্ঠানে প্রশ্ন করি: রাজধানীর ব্যস্ত সড়কগুলো বন্ধ করে দিয়ে লাখ লাখ মানুষের দুর্ভোগ সৃষ্টি করে, স্কুল বন্ধ করে দেওয়ার পরিবেশ সৃষ্টি করে সরকারি দল তাহলে সম্মেলন করে কীভাবে?

টেলিফোনে আমাকে উপস্থাপিকা বিদায় জানানোর পর সাগ্রহে এই প্রসঙ্গে আলোচকদের বক্তব্য শোনার জন্য বসি। দেখি আমারই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপিকা বলছেন: শনিবার মানুষের কাজ কি বের হওয়ার? তা ছাড়া সরকার তো বলে দিয়েছে এই এই রাস্তা বন্ধ! মানুষের তো বরং উপকার করা হয়েছে এটা আগে বলে! তিনি এরপর রেগে আগুন হয়ে বলেন, এ রকম নাকি সব সময়ই হয়, খালেদা জিয়া যখন হজ করে ফিরেছেন রাজপথে দুর্ভোগ হয়নি? তিনি এরপর বিশদভাবে সেই দুর্ভোগের বর্ণনা দিতে লাগলেন। উপস্থাপিকা সম্ভবত বলার সুযোগই পেলেন না যে খালেদা জিয়া হজ করে ফিরবেন দেখে পুলিশ তো বিভিন্ন সড়কে বিএনপি বাদে অন্যদের জন্য বন্ধ করে দেয়নি, সারা শহরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তো বন্ধ করে দিতে হয়নি।

আওয়ামী লীগের সম্মেলনের প্রসঙ্গে বিএনপির সম্মেলনের তুলনা আসতে পারে। প্রাসঙ্গিক ও যৌক্তিক হলে এটা মোটেও অন্যায্য নয়। কিন্তু আওয়ামী লীগের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং অহংয়ের কথা বিবেচনা করলে দলটির কোনো ব্যর্থতার জবাব কি ‘বিএনপি আরও খারাপ’ এটি বলে তা সব সময় এড়িয়ে যাওয়া উচিত? আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা গণতান্ত্রিকভাবে, জন্মের পর বহু বছর এই দলে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রচর্চা হয়েছে এবং আওয়ামী লীগের দাবি হচ্ছে শুধু তারাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবাহী দল। আর কিছু না হোক, এই দলের কাউন্সিল কি তাহলে বিএনপি বা জাতীয় পার্টির মতো দলগুলো থেকে গুণগতভাবে বেশি মানসম্পন্ন হওয়া উচিত নয়? কাউন্সিল নিয়ে মূল্যায়নে আমাদের কি এই দিকটিও ভাবা উচিত নয়?

.

রাজনৈতিক দলের কাউন্সিল দলের জন্য বিরাট গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। কাউন্সিল দলের নেতাদের জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা করে, এতে শীর্ষ পর্যায়ে নেওয়া বিভিন্ন সিদ্ধান্তের প্রেক্ষাপট ও ভবিষ্যৎ ভাবনা তৃণমূলের নেতাদের কাছে ব্যাখ্যা করা হয় এবং কাউন্সিলরদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন করা হয়।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বকালে অতীতের কাউন্সিলগুলোতে কিছুটা হলেও কাউন্সিলররা দলের ভালো-মন্দ বলার এবং শীর্ষ নেতাদের সমালোচনা করার সুযোগ পেয়েছেন। দলের সাধারণ সম্পাদকেরা তাঁদের দায়িত্বে থাকার সময়ের রিপোর্ট পেশ করেছেন এবং তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। দলের সভানেত্রীর সমালোচনা করার মতো পরিবেশ না থাকলেও সেখানে দলীয় বিভিন্ন সিদ্ধান্ত এবং কোনো কোনো নেতার কর্মকাণ্ড নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এমনকি কারও না কারও পক্ষ থেকে সাধারণ সম্পাদক পদে প্রার্থী হওয়ার আগ্রহ পোষণ করা হয়েছে। এবারের সম্মেলনে এর কিছুই হয়নি।

এবারের সম্মেলনে অনুপস্থিত ছিল নেতৃত্ব নির্বাচনের বিষয়টি। শেখ হাসিনা ত্যাগ, সাহসিকতা, বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে দলে একটি অনন্য অবস্থায় পৌঁছেছেন। তিনি সভানেত্রী থাকাবস্থায় অন্য কারও সে পদে দাঁড়ানোর ইচ্ছে হবে না, এটি স্বাভাবিক। কিন্তু দলের দ্বিতীয় শীর্ষপদে (সাধারণ সম্পাদক) ওবায়দুল কাদের আসতে চাইলে তাঁর সিনিয়র, জুনিয়র অন্য কারও এ ইচ্ছে আর হবে না, এটি কি স্বাভাবিক? জনাব কাদের সম্মেলনের আগে থেকেই তাঁর প্রতি নেত্রীর সম্মতির ইঙ্গিত দিয়েছেন। এতে অন্য কাউকে না দাঁড়ানোর মেসেজই কি আগেভাগে দিয়ে দেওয়া হয়নি?

ওবায়দুল কাদেরের সাধারণ সম্পাদক হওয়া তারপরও অনেকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। তৃণমূলের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ বেশি, তিনি সম্ভবত দলের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডেও বেশি মনোযোগ দেবেন। কিন্তু তাঁর এই অধিষ্ঠান বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে শক্তিশালী ও অংশগ্রহণমূলক করতে কোনো ভূমিকা রাখবে কি? তিনি এ পদে এসেছেন সম্পূর্ণভাবে নেত্রীর ইচ্ছায়। সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর তিনি নেত্রীর প্রতিই শুধু আকণ্ঠ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন, কাউন্সিলরদের কথা বলেননি। এভাবে নির্বাচিত একজন নেতা দলের সাংগঠনিক গতিশীলতা বাড়াতে পারেন, কিন্তু দেশের রাজনীতিতে অচলাবস্থা দূর করতে স্বতন্ত্রভাবে কোনো ভূমিকা পালন করতে পারেন কি?

.

এবারের সম্মেলনে দলের পক্ষ থেকে প্রচারিত বক্তব্যও আগের মতো খোলামেলা ছিল না। রূপকল্প ২০৪১ নামে কিছু মূলত স্বপ্নের কথা বলা হয়েছে, তার কোনো কর্মকৌশল তুলে ধরা হয়নি। যেমন বলা হয়েছে, বাংলাদেশকে ২০৪১সালে বৈশ্বিক বিমান চলাচলের হাবে পরিণত করা হবে। আওয়ামী লীগের গত সাত বছরে বিমানের দুরবস্থা দেখার পর স্বভাবতই এ ধরনের আশাবাদের যৌক্তিকতা নিয়ে কিছু ব্যাখ্যার প্রয়োজন ছিল। তা সেখানে ছিল না।

সম্মেলনে এবং এরপর আওয়ামী লীগের নেত্রী কাউন্সিলরদের নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেছেন, আগামী নির্বাচন নিয়ে যেন কোনো প্রশ্ন না ওঠে, সে কথাও বলেছেন। তাঁর এই বক্তব্যে ভবিষ্যতে অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠু নির্বাচনের সম্ভাবনা খুঁজেছেন কেউ কেউ।

আবার তিনি সম্মেলনে বিএনপিকে ক্ষমতায় আসতে দেওয়া হবে না এবং ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আসতেই হবে—এমন কথাও বলেছেন। হতে পারে তিনি যে উন্নয়ন-দর্শন ও অসাম্প্রদায়িক ভাবধারায় বিশ্বাস করেন, সেটি অব্যাহত রাখার গুরুত্ব বোঝাতে গিয়েই এটি বলেছেন। কিন্তু তার এসব বক্তব্যের কারণে বিএনপির নেতারা ভবিষ্যতেও একটি একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠানের আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন। বিএনপিকে যেভাবে সভা-সমাবেশের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে, আগামী নির্বাচনে  জিততে পারেন এমন নেতাদের বিরুদ্ধে যেভাবে গণহারে মামলা দেওয়া হচ্ছে এবং বিএনপির কর্মীদের যেভাবে পাইকারি গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাতে এ ধরনের আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়তো অসংগত নয়।

আমার নিজের কাছে মনে হয়েছে, তাঁর এ ধরনের অনেক বক্তব্যেই আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ ভাবনা পরিষ্কার করে বোঝা যায়নি। সম্মেলনের কাউন্সিলররা এটি বুঝে এলাকায় ফিরে যেতে পারলে ভালো হতো। তিনি আওয়ামী লীগকে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হতে বলেছেন। তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা মনে করছেন যে তিনি নির্বাচনকে আওয়ামী লীগের জন্য প্রস্তুত করছেন। এই অস্বস্তি কাউন্সিলে না হোক, অচিরেই দূর করা প্রয়োজন।

প্রয়োজন কাউন্সিল নিয়ে আওয়ামী লীগের কিছুটা আত্মসমালোচনাও। চারপাশে প্রশংসার বন্যা হয়তো এখনো আছে। কিন্তু তারপরও এই কাউন্সিল যেভাবে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করেছে, দলভিত্তিক বৈষম্য প্রকট করে তুলেছে এবং দলের ভেতর জবাবদিহি ও অংশগ্রহণের অভাব ফুটিয়ে তুলেছে, তা নিয়ে কিছু আত্মসমালোচনা হলে ভালো।

আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়