নওয়াজ না ইমরান?

নওয়াজ শরিফ, ইমরান খান
নওয়াজ শরিফ, ইমরান খান

সব মিলিয়ে এখনই জোর দিয়ে বলা যাবে না যে পাকিস্তানে গণতন্ত্রের সুবাতাস বইছে। তবে এটুকু বলা যায়, রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা, জঙ্গিবাদ ও অব্যাহত সহিংসতার মুখেও দেশটিতে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা রক্ষার সুযোগ তৈরি হয়েছে। সাধারণ মানুষ সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে নেতৃত্বে পরিবর্তন আনতে চাইছে। তারা এমন এক নেতাকে বেছে নেবে, যিনি সঠিক পথের দিশারী হবেন। গণতন্ত্রের পথে উত্তরণে আরেকটি ইতিবাচক দরজা খুলে দিয়েছে সাবেক স্বৈরশাসক পারভেজ মোশাররফের আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়ানোর ঘটনা। তিনিই দেশের প্রথম স্বৈরশাসক, যাঁকে একাধিক মামলার আসামি হিসেবে এখন বন্দীজীবন কাটাতে হচ্ছে।

প্রায় চার বছরের স্বেচ্ছানির্বাসন শেষে গত মার্চে যে আশা নিয়ে মোশাররফ দেশে ফিরেছিলেন, এখন সে আশায় গুড়েবালি। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর হত্যা মামলাসহ তিনটি মামলা চলছে তাঁর বিরুদ্ধে। একই সঙ্গে আদালত তাঁর নির্বাচনে লড়ার যোগ্যতার ওপর স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন। বিচারে মোশাররফের সাজা কী হবে, তা পরের ব্যাপার। তবে পাকিস্তানের মাটিতে স্বৈরশাসক বা ক্ষমতা লুটে নেওয়া ব্যক্তির সেই সুদিন যে আর নেই, মোশাররফের বর্তমান অবস্থানে তা স্পষ্ট।

এ পর্যন্ত নির্বাচন-পূর্ব বিভিন্ন জনমত জরিপের ফলাফলে আভাস পাওয়া গেছে, যে তিনটি দলের মধ্যে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে, সেগুলো হচ্ছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান মুসলিম লিগ (পিএমএল-এন), ক্ষমতা থেকে সদ্য বিদায় নেওয়া দল পিপিপি এবং ক্রিকেট তারকা থেকে পুরোদস্তুর রাজনীতিক বনে যাওয়া নেতা ইমরান খানের নেতৃত্বাধীন তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই)।

জরিপ অনুযায়ী, ভোটারদের এক-চতুর্থাংশের বেশি সমর্থন নিয়ে এগিয়ে আছে নওয়াজের পিএমএল-এন। পিপিপি পেতে পারে এক চতুর্থাংশ ভোটারের সমর্থন। তাদের পেছনে রয়েছে ইমরানের পিটিআই। তবে কোনো দলের পক্ষেই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করা সম্ভব হবে না। সে ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে ভালো অবস্থানে থাকা মাঝারি ও ছোট দলগুলোর ওপর নির্ভর করতে হবে।

তালেবানের রোষের মুখে থাকায় নির্বাচনী প্রচারণায় পিপিপি এবার তেমন সুবিধা করতে পারেনি। কট্টরপন্থী তালেবান উদারপন্থী বলে পরিচিত পিপিপি, মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট ও আওয়ামী ন্যাশনাল পার্টির মতো দলগুলোকে শত্রু মনে করে। তালেবানের নির্বাচন-পূর্ব সহিংস হামলায় এবার এসব দলের নেতা-কর্মীরাই লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছেন। গত এপ্রিল থেকে এসব হামলার ঘটনায় নিহতের সংখ্যা শতাধিক ছাড়িয়ে গেছে।

লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, ইমরানের দল পিটিআইয়ের কোনো সমাবেশে এখনো তালেবানের হামলার ঘটনা ঘটেনি। ধারণা করা হচ্ছে, ইমরান দেশের মাটিতে মার্কিন মানববিহীন বিমান (ড্রোন) হামলার প্রচণ্ড বিরোধিতা করায় তালেবান তাঁর প্রতি নমনীয়। কারণ, ড্রোন হামলার মূল শিকার তারাই। ইমরান তালেবানের মতো জঙ্গি গোষ্ঠী অধ্যুষিত উপজাতীয় এলাকায় সামরিক অভিযানেরও বিরোধী। এটিও হয়তো তাঁর প্রতি তালেবানের সদয় হওয়ার কারণ।

সাধারণ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করার পর থেকে প্রচারণা ও জনসমর্থন বিচার করে যে চিত্রটি পাওয়া যায়, এতে পিপিপির অবস্থান এবার নাজুক। ক্ষমতায় তাদের ফিরে আসা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। বাকি থাকে নওয়াজ শরিফ ও ইমরান খানের দল। নওয়াজ নিঃসন্দেহে প্রভাবশালী নেতা। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে অর্থ কেলেঙ্কারি ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। সে তুলনায় ইমরান নিষ্কলুষ। ৬০ বছর বয়সী এই সাবেক ক্রিকেটার ইমরান রাজনীতিতেও অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছেন। অভিজ্ঞজনেরা বলছেন, তাঁর হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়ে একটিবার পরখ করে দেখতেও পারে পাকিস্তানের মানুষ।

সাম্প্রতিক এক নির্বাচনী সমাবেশে ইমরান খান দাবি করেন, পাঞ্জাবে নওয়াজের ভাই শাহবাজের পাঁচ বছরের শাসনামলে ৭০ হাজার লোককে অপহরণ করা হয়। তাঁর কথা আংশিক সত্য হলেও ওই প্রদেশে অপরাধের চিত্রটি যে কতটা ভয়াবহ, তা সহজেই অনুমেয়। ইমরানকে বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে ভোটাররা এসব দিকও বিবেচনা করবেন।

বিভিন্ন নির্বাচনী সমাবেশে ইমরান খান অঙ্গীকার করেছেন, নির্বাচিত হলে তিনি দুর্নীতি দমনে যথাসাধ্য চেষ্টা চালাবেন। বেকারত্ব দূর করবেন। দ্রব্যমূল্যের লাগাম টানবেন। এমন আরও অনেক অঙ্গীকার করেছেন, যা সাধারণ মানুষেরও প্রত্যাশা।

পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে মোট আসন ৩৪২টি। এর মধ্যে কেবল পাঞ্জাবেই রয়েছে ১৪৮টি আসন। এ জন্য বলা যায়, পাঞ্জাবের সাফল্য কোনো দলের ক্ষমতায় যাওয়ার পাঞ্জাকে শক্ত করে তুলবে। পাঞ্জাব নওয়াজ শরিফের পিএমএলের শক্ত ঘাঁটি বলে পরিচিত। এই প্রদেশের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন তাঁরই ভাই শাহবাজ শরিফ।

সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, পাঞ্জাবে নওয়াজের দল ৩৮ শতাংশের বেশি ভোট পেতে পারে। পিটিআই পেতে পারে ৩০ শতাংশের বেশি ভোট। পিপিপি পেতে পারে ১৪ শতাংশের মতো। পিপিপির জন্য শক্ত ঘাঁটি হচ্ছে সিন্ধু। সেখানে রয়েছে ৬১ আসন। তবে এবার ওই প্রদেশেও পিপিপির অবস্থান দুর্বল। তারা সেখানে প্রায় ৩৫ শতাংশ ভোট পাবে বলে আশা করা যাচ্ছে।

পিএমএল-এন ও পিপিপির মতো কোনো প্রদেশেই পিটিআইয়ের এককভাবে মজবুত অবস্থান নেই। তবে সবখানে তাদের মোটামুটি অবস্থান রয়েছে। পিটিআইয়ের মূল ভোটার শহরের মধ্যবিত্ত। নির্বাচনী প্রচারণায় নেমে সম্প্রতি তারা গ্রামেও অনেক ভোটারের মন জয় করেছে।

পাকিস্তানের ভোটাররা আজ সিদ্ধান্ত নেবেন কোন দল আগামী পাঁচ বছর দেশটি শাসন করবে।

l শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া: সাংবাদিক।