মন্দির বা হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলা চালানো কত সহজ!

কত সহজে উত্তেজনা ছড়িয়ে দেওয়া যায়, মন্দিরে বা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে হামলা চালানো যায়, তা আবার আমরা টের পেলাম ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনায়। এর আগে দেখেছি কক্সবাজারের রামুতে। আমরা আরও দেখছি এসব ঘটনাকে দীর্ঘায়িত করা বা ছড়িয়ে দেওয়ার কাজটিও কঠিন নয়। তা না হলে ঘটনা শুরুর পাঁচ দিন পরও নতুন করে হামলার চেষ্টা হতো না। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনার জের হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা বা নওগাঁয় পড়ত না।
ঘটনার সূত্রপাত কীভাবে, তা আমরা সবাই জানি। রসরাজ নামে পড়াশোনা না-জানা এক দরিদ্র জেলের ফেসবুক পাতায় একটি ছবি দেখা গেছে, যেখানে ধর্মীয় অবমাননাকর বিষয় রয়েছে। এরপর যা ঘটেছে, তা যে পরিকল্পিতভাবেই হয়েছে বা এখনো হচ্ছে, সেটা অনেকেই বলছেন এবং ঘটনার ধরন থেকেও তা পরিষ্কার।
মন্দির ও হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলা কেন ঠেকানো গেল না, সেই প্রশ্ন উঠেছে এবং এই ব্যর্থতার দায় খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রশাসনের ওপর গিয়ে পড়েছে। দুটি ধর্মীয় সংগঠনকে সভা করতে দেওয়া, সেখানে ইউএনওর বক্তব্য রাখা এবং পরিস্থিতি খারাপের দিকে যেতে পারে তা আঁচ-অনুমান করতে না পারা—এসব বিবেচনায় নিলে ঘটনার দায় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেই নিতে হবে।
এগুলো সবই রসরাজের ফেসবুক পাতায় কথিত ধর্মীয় অবমাননাকর ছবি আপলোড হওয়ার পরের ঘটনা। আমাদের আসলে এখন এই ছবি আপলোডের আগের ঘটনার দিকে নজর দেওয়া জরুরি। কারণ, এই ‘আগের ঘটনাটি’ বের করে এবং সে অনুয়ায়ী বিহিত করার উদ্যোগ নেওয়া না গেলে সামনে এমন আরও বিপদের ঝুঁকির মধ্যেই থাকতে হবে।
প্রথম আলোর প্রতিবেদক শরিফুল হাসান রসরাজের সঙ্গে কথা বলেছেন। কথা বলে তাঁর ধারণা হয়েছে যে প্রায় নিরক্ষর রসরাজের ফেসবুকে ছবি আপলোড করার মতো জ্ঞান থাকার কথা নয়। তাঁর এই ফেসবুক আইডিটিও খুলে দিয়েছেন আরেকজন। পুলিশ বা প্রশাসনের লোকজনের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলেছেন শরিফুল। তাঁরাও বিশ্বাস করেন না যে এই কাজ রসরাজের পক্ষে করা সম্ভব। যদি তা-ই হয়, ফেসবুক পাতায় ছবিটি তবে দিল কে?
কয়েকটি পত্রিকার অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে এর সঙ্গে সরকারি দল আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল জড়িত। বলা হচ্ছে, গত ইউনিয়ন পরিষদের প্রার্থী মনোনয়নকে কেন্দ্র করে দলটির মধ্যে যে বিরোধের সূচনা হয়েছে, তার প্রতিশোধ এই কায়দায় নিয়েছে একটি পক্ষ। এগুলো ধারণা বা অনুমান মাত্র। কিছুই এখনো প্রমাণিত হয়নি।
রসরাজের ফেসবুক পাতায় ছবিটি কীভাবে অথবা কে বা কারা আপলোড করল, সেটা বের করাই এখন সবচেয়ে জরুরি কাজ। কারণ, হতদরিদ্র ও প্রায় নিরক্ষর এক জেলের ফেসবুকের একটি ছবিও কতটা বিপদ ঘটাতে পারে বা বিপদ ঘটানোর কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে, তা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনায় আমরা দেখলাম।
কারও নাম ও ছবি ব্যবহার করে ফেসবুকের একটি অ্যাকাউন্ট খোলা কোনো কঠিন কাজ নয়। এমনকি কারও অ্যাকাউন্ট হ্যাক করাও অনেকের কাছে তেমন জটিল কিছু নয়। ফলে বিপদের আশঙ্কা এবং সেই বিপদ কতটা ভয়াবহ হতে পারে, সেটা আমাদের গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে। আগুন লাগানোর জন্য কারও নামে একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট এবং সেখানে একটি উল্টো-পাল্টা পোস্টই তো যথেষ্ট!
আমাদের মনে আছে, কক্সবাজারের রামুর ঘটনাটিও ঘটানো হয়েছিল হুবহু একই কায়দায়। একটি সমাজে স্বার্থান্বেষী নানা গোষ্ঠী থাকবেই। তারা সরকারে, সরকারি দলের মধ্যে বা বিরোধী দলে—সবখানেই থাকতে পারে। এসব গোষ্ঠী যাতে সুযোগ নিতে না পারে, তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু সমস্যা হয় যখন সরকারের ভেতরে থাকা স্বার্থান্বেষীদের পক্ষে সরকার অবস্থান নেয়। রামুর ঘটনার পর প্রায় চার বছর কেটে গেছে, ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি নিশ্চিত করা যায়নি। উত্তম কুমার বড়ুয়া নামের যে ব্যক্তির ফেসবুক পাতায় ধর্ম অবমাননাকর ছবি পাওয়া গেছে বলে এত তাণ্ডব ঘটে গেল, সেই ব্যক্তি আসলেই ছবি দিয়েছিলেন কি না, তা এখনো নিশ্চিত করা যায়নি। এমনকি ঘটনার পর সেই উত্তম বড়ুয়ার আর কোনো খোঁজও মেলেনি। সেই ঘটনার একটি বিহিত হলে এবং ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তি নিশ্চিত করতে পারলে হয়তো আমরা যাকে পরিকল্পিত বলে মনে করছি, সেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনাটি ঘটত না।
আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা বিভাগগুলো এখন প্রযুক্তিতে যথেষ্ট এগিয়ে। রসরাজের ফেসবুক পাতায় কোথা থেকে কীভাবে ছবি আপলোড করা হয়েছে, তা বের করা সম্ভব। রসরাজের মোবাইল ফোনটি ঢাকায় সিআইডির ফরেনসিক বিভাগে আনা হয়েছে বলে পত্র-পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে। তবে আশঙ্কাটি হচ্ছে, এর পেছনে যদি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী জড়িত থাকে এবং শক্তি-সামর্থ্যে যদি তারা জোরদার হয় অথবা সত্য বের হলে যদি সরকার বা সরকারি দলের বিব্রত হওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়, তবে গোয়েন্দাদের উন্নত প্রযুক্তি ‘কাজে’ না-ও দিতে পারে।
কিন্তু এ ধরনের ঘটনার সত্য প্রকাশ না পাওয়া বা সত্য প্রকাশ করতে না দেওয়া অর্থ হচ্ছে সত্যিই আগুন নিয়ে খেলা। আর এই আগুন খুব সামান্যতেই জ্বালানো যায় এবং এর পোড়ানোর ক্ষমতাটিও ভয়ংকর। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনাটিকে যদি আমরা একটি শিক্ষা হিসেবে বিবেচনায় না নিই, যদি যথাযথ তদন্ত করতে ব্যর্থ হই বা যারা এর পেছনে ছিল, তাদের চিহ্নিত করতে ও শাস্তি নিশ্চিত করতে না পারি, তবে ভবিষ্যতে আরও বড় বিপদের জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে।

এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক
[email protected]