২৭ পুলিশি শর্তে দ্রুত জনসভা আইন চাই!

বিএনপির কার্যালয় ঘিরে রাখে পুলিশ
বিএনপির কার্যালয় ঘিরে রাখে পুলিশ

বিএনপিকে সমাবেশ করতে না দেওয়ায় দেশের অন্যতম প্রধান একটি রাজনৈতিক দলের নেতা–কর্মীদের গণতান্ত্রিক অধিকার ক্ষুণ্ন হয়েছে। সমাবেশে বিএনপি কী বলত, বা বিএনপির প্রতিক্রিয়া কী, তা এখানে গুরুত্বপূর্ণ নয়। অনেকেই মনে করেন না যে বিএনপি একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনে একটি নির্ভরযোগ্য রাজনৈতিক শক্তি। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে তাদের জনসভা করার অধিকারও খর্ব করতে হবে। অথবা তাদের কার্যালয় পুলিশ দিয়ে অবরুদ্ধ করে রাখতে হবে।
আমাদের পুলিশ বাহিনীকে ধন্যবাদ। স্বীকার করতেই হবে যে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির দিক থেকে তারা একটি উল্লেখযোগ্য নজির স্থাপন করেছে। জনসভায় বিধিনিষেধ আরোপ নতুন নয়। কিন্তু তা বেশির ভাগ সময় অলিখিত ছিল। জানাই যেত না যে প্রকৃত কারণটা কী। যা প্রকৃত কারণ, তা বলা হতো না। যাঁরা জনসভা করতে পারতেন না, তাঁরা বলতেন, জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে আড়াল করতে কিংবা প্রকৃত সত্য আড়াল করতে ‘সাফাই বক্তব্য’ দেওয়া হয়েছে। দুই পক্ষের পরস্পরবিরোধী বক্তব্যে আমজনতা বিভ্রান্ত হতেন, কাকে রেখে কাকে বিশ্বাস করবেন। পুলিশ সূত্র সাংবাদিকদের এটা-ওটা বলে দিত। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সেসবই ছেপে দেওয়ার নজির ভূরি ভূরি। আমরা এ নিয়ে আক্ষেপ করতাম। স্বচ্ছতা দাবি করে আমরা কত–না গলা ফাটিয়েছি! এবার আর যা-ই হোক, নিন্দুকও বলতে পারবে না যে তারা অস্বচ্ছ। বরং পুলিশ যেন এবার একটু বেশিই স্বচ্ছ। জনগণের তথ্য জানার অধিকারের প্রতি ‘শ্রদ্ধাশীল’ থেকে পুলিশ নিজেদের উজাড় করে দিয়েছে।
আমরা আশা করব, পুলিশ এখন থেকে দলনির্বিশেষে এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখবে। তারা এ রকম কাণ্ড যখন যার বেলাতেই করবে, তা লিখে প্রকাশ করবে। ক্ষমতাসীন দলের হলেও করবে। ক্ষমতার মিত্রদের বেলাতেও করবে। ক্ষমতার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সঙ্গেও করবে। আমরা বিশ্বাস করতে চাই, যে পুলিশ অফিসারের স্বাক্ষরে এটা ঘটেছে, সেটা তাঁর মনগড়া নয়। তিনি আদিষ্ট হয়েছেন। তাঁর ওপরের মহল আছে; যার একটি প্রশাসনিক, অপরটি রাজনৈতিক। আবার দুইয়ের মিশেলও হতে পারে। একসময় গুরুত্বপূর্ণ কোনো দুর্ঘটনা বা নাশকতা ঘটলে তথ্যবিবরণী নামের একটি বস্তু সংবাদপত্রে প্রকাশ পেত। সুশাসন ও জবাবদিহির জন্য কিংবা রাষ্ট্রের যে একটি বিশেষ দায় আছে, সেটার একটি স্বীকৃতি ছিল এই সরকারি ঘোষণা। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এত বড় সংঘাত হয়ে গেল, কিন্তু আমরা কোনো তথ্যবিবরণী পেলাম না। মন্ত্রীরা বিভিন্নজন বিভিন্ন কথা বলেছেন।
সেদিক থেকে বিএনপি ভাগ্যবান। নেতাদের ও দলের যে লেজেগোবরে অবস্থা, তাতে তারা যে এতখানি গুরুত্ব পেয়েছে, সে জন্য তারা নিজেদের ধন্য মনে করতে পারে। তাদের প্রতি একটি নয়, দুটি নয়, ২৭টি ব্রহ্মাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়েছে। বোঝা গেল, পুলিশ বিভাগ অন্তত এখনো তাদের গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। অবশ্য সম্প্রতি আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে ইংরেজি ভাষায় দলের যে ঐতিহাসিক ইতিবৃত্ত প্রকাশ করেছে, সেখানে বেশ খোলামনে একটি সত্যের প্রকাশ দেখে একটু অবাকই হয়েছি। সেখানে ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপির কাছে ভোটে পরাজয়কে তারা সমীহভরে মেনে নিয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়।
এমনকি ২০১৪ সালের নির্বাচনী ইশতেহারেও তারা গণতন্ত্রের পথে থাকার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে। তারা বলেছে, ‘গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সমুন্নত এবং নিরবচ্ছিন্ন উন্নয়ন নিশ্চিত করার মতো মৌলিক প্রশ্নে সব রাজনৈতিক দল, শ্রেণি ও পেশাজীবী সংগঠন, সিভিল সমাজসহ দলমত-নির্বিশেষে জাতীয় ঐকমত্য গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।’ ওই ইশতেহারেই আছে, ‘সবার জন্য আইনের সমান প্রয়োগ করা হবে।’ এই অঙ্গীকার অসত্য, পুলিশের অন্তত তা ধরে নেওয়া উচিত নয়।
পুলিশ কি বিএনপির প্রতি তার ২৭ শর্তের রচনা তৈরি করতে গিয়ে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের ২৭ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত একটি ঘোষণা মনে রেখেছে? ওই ঘোষণা কিন্তু বলেছে: ‘পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দলীয় প্রভাবমুক্ত রাখা হবে।’ এখন কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতাদের একটা দায়িত্ব এসে গেছে, ২৭ শর্তকে এমনভাবে ‘সবার জন্য সমানভাবে ব্যবহার’ করার, যাতে কেউ বলতে না পারে যে তাঁরা তাঁদের ওই সংকল্প থেকে সরে এসেছেন।
কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায় ৮ নভেম্বরে রাষ্ট্রের পাঠশালায় ‘গণতন্ত্র শিখুন’ শীর্ষক একটি নিবন্ধ লিখেছেন। তাঁর ভাষ্য, ‘ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির সভাপতি অমিত শাহ গোয়ায় ‘গণতন্ত্র, উন্নয়ন, ভিন্নমত’-সংক্রান্ত এক আলোচনা সভায় অমিয়বাণী দিয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘মানুষের স্বাধীনভাবে কথা বলার অধিকার নিশ্চিত করাই গণতন্ত্রের কাজ, কিন্তু ক্রমাগত প্রতিবাদ জানিয়ে চলা ঠিক নয়, কারণ তাতে উন্নয়ন ব্যাহত হবে। নরেন্দ্র মোদি দেশের সব মানুষের উন্নয়নের চেষ্টা করছেন, তাঁর যত খুশি সমালোচনা করুন, কিন্তু দেশের বিরোধিতা করলে—মার্জনা করবেন—সেটা সহ্য করা হবে না, কারণ তা যথার্থ বাক্স্বাধীনতার প্রতিকূল।’
নিবন্ধকারের সঙ্গে একমত না হয়ে উপায় নেই যে অমিত শাহর ওই মন্তব্য সেই জর্জ অরওয়েলের কণ্ঠস্বরের প্রতিধ্বনি। অরওয়েল বর্ণিত সেই ‘ডাবলস্পিকের’ এক ধ্রুপদি দৃষ্টান্ত। আড়িপাতা রাষ্ট্রের রূপকার অরওয়েলের চরিত্রগুলো এখন দেশে দেশে প্রগলভ। অনির্বাণ চমৎকার বলেছেন, ‘অমিত শাহ ব্যক্তিমাত্র নন, অমিত শাহ একটি মানসিকতা, যে মানসিকতা এখন দিল্লির মসনদে বসেছে। তার কাছে ভিন্নমতের কোনো মর্যাদা নেই, সে কেবল আনুগত্য চায়। ক্ষমতার প্রতি আনুগত্য। ক্ষমতা তার নিজের মতামত শোনাবে এবং প্রশ্ন করবে, “ঠিক কি না?” সবাই সমস্বরে বলবে, “ঠিক, ঠিক।” ক্ষমতা আহ্লাদিত হবে।’
তবে অমিত শাহ-সিনড্রম শুধু দিল্লিতেই নয়, প্রশান্ত থেকে আটলান্টিক, ভোলগা থেকে ভারত মহাসাগর, এর দুই তীরের বহু রাজধানীতে এখন ডাবলস্পিকই বাস্তব ও জোরালো। কান পাতলেই শোনা যায়। বাংলাদেশে জনসভা করা নিয়ে কম কাণ্ড হয়নি। ১৯৪৭ সাল থেকে পরের ২৩ বছর কিংবা ১৯৭১ থেকে ৪৫ বছর, কত কিছুই না ঘটে গেল জনসভা করা নিয়ে। কিন্তু মনে পড়ছে না কখনো ২৭টি শর্ত দেওয়া হয়েছে। জনসভা সম্পর্কে আমাদের সংবিধানেই কিছু শর্ত রয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘জনশৃঙ্খলা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হইবার এবং জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।’
এর আগের একটি লেখায় আমি বলেছিলাম, আমরা তাহলে ২০১২ সালে মালয়েশিয়ার সংসদে পাস হওয়া শান্তিপূর্ণ সমাবেশ আইনের আদলে একটি আইন করে নিই। সত্যি বলতে কি, পুলিশের ২৭ শর্ত পড়ে মনে হয়েছে, এর ভিত্তিতেই একটি গাইডলাইন করা যায়। এ ২৭টি শর্ত যে পুলিশ এত কষ্ট করে লিখল, এখন তাদের একটা কেষ্ট মেলা দরকার। এবং সেটি হতে পারে যদি এই গাইডলাইনের আলোকে তাদের জন্য একটি আইন করা হয়।
আহা, সেই সব দিন কোথায় গেল। রাস্তায় রাস্তায় সভা-সমাবেশ ও মিছিল, ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া, লাটিচার্জ, গুলি, কাঁদানে গ্যাস। গাড়ি ভাঙচুর ও গাড়িতে আগুন লাগানো সেই দিনগুলো পুলিশের জীবনে সব থেকে বিভীষিকাপূর্ণ ছিল। কারণ, মার তাদের খেতেই হতো। সমাবেশের জন্য একটি হাইড পার্ক তো লাগবে। জনদুর্ভোগ বাড়িয়ে সড়কে সমাবেশ করতে দেওয়া যাবে না।
ডিএমপির কমিশনারের এক বিশেষ সহকারীর স্বাক্ষরিত ওই অনুমতিপত্রের শর্তের কয়েকটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে এর কোনোটি ‘যুক্তিসংগত বাধানিষেধ’ না হলে সংবিধান বলছে এগুলো বাতিল। এক নম্বর: ‘এই অনুমতিপত্র স্থান ব্যবহারের অনুমতি নয়।’ তাহলে এটা ছিল আসলে একটা রসিকতা। পুলিশ বিএনপির সঙ্গে রসিকতা করেছে। পুলিশের যে এতটা রসজ্ঞান, সেটা জানতে আপনারা ২৭টি শর্ত হেফজ করুন।
দুই নম্বর শর্ত, ‘স্থান ব্যবহারের জন্য অবশ্যই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে।’ মন্তব্য: তার মানে, ২৭ শর্ত মেনে বিএনপি যদি ঢাকার দূষণভরা আকাশের কোনো এক ঠিকানায় সভা করত, তাহলে পুলিশের কোনো আপত্তি থাকত না। কেউ রসিকতা করে বলবেন, বিএনপি ২৭ শর্তকে স্থায়ী গাইডলাইন বিবেচনায় বড় বড় বেলুন আমদানি করতে পারে। বেলুনে চড়ে সমাবেশ করলে যানজট থেকে আমরা বাঁচব।
তিন নম্বর শর্তে বলা হয়েছে, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের অভ্যন্তরে আলোচনা সভার যাবতীয় কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। মিলনায়তনের বাইরে বা সড়কের পাশে মাইক বা সাউন্ডবক্স ব্যবহার করা যাবে না। মন্তব্য: চমৎকার। আন্তর্জাতিক মানসম্মত। এসব প্রস্তাবিত শর্ত আইনে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। যেকোনো ঘরে বা ইমারতে সভা হবে, সেখানে সুনসান নীরবতা ও হান্ড্রেড পার্সেন্ট শৃঙ্খলা থাকবে। বাইরে থেকে লোকে বুঝতেও পারবে না, ভেতরে কী হচ্ছে। চার. আলোচনা সভার নিরাপত্তার জন্য নিজস্ব স্বেচ্ছাসেবক (দৃশ্যমান আইডি কার্ডসহ) নিয়োগ করতে হবে। নিজস্ব ব্যবস্থায় ভেহিকল স্ক্যানার বা সার্চ মিররের মাধ্যমে আলোচনা সভাস্থলে আসা সব যানবাহনে তল্লাশির ব্যবস্থা করতে হবে। মন্তব্য: এই শর্ত দেশের বেসরকারি নিরাপত্তা সংস্থার বিকাশে উপকারী। বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান তৈরি করবে। পাঁচ. স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের নির্দেশনা অনুযায়ী নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় আলোচনা সভা স্থলের ভেতরে ও বাইরে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করতে হবে। মন্তব্য: ডিজিটাল জাতি গঠনের পথে এটা সহায়ক বটে।
এ ছাড়া সাড়ে চারটার মধ্যে সমাবেশ শেষ এবং মিছিলসহকারে ‘আলোচনা সভায়’ না আসার যে শর্ত দেওয়া হয়েছে, তার সঙ্গে জনস্বার্থ ও পরোপকারের চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। কারণ, নাভিশ্বাস ওঠা যানজট সত্ত্বেও ক্ষমতাসীন দল ও তাদের সহযোগী সংগঠনগুলোকে যখন-তখন মিছিল বা ট্রাক মিছিল নিয়ে চলাচল করতে দেখা যায়। তাই আওয়ামী লীগের প্রতি আহ্বান, আপনারা নির্বাচনী ইশতেহারের ২৭ পৃষ্ঠার অঙ্গীকার অনুযায়ী পুলিশের ২৭ শর্তে দ্রুত একটি শান্তিপূর্ণ সমাবেশ আইন তৈরি করুন।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
[email protected]