নব্য জাতীয়তাবাদ বিপদ বয়ে আনবে

ভোটের আগে ডোনাল্ড ট্রাম্প যে যুক্তরাষ্ট্রকে আবারও মহান বানানোর সংকল্প করেছিলেন, তার মধ্য দিয়ে ১৯৮০ সালে রোনাল্ড রিগ্যানের নির্বাচনী প্রচারণা প্রতিধ্বনিত হয়েছে। রিগ্যানের আগে কার্টার সরকার ব্যর্থ হয়েছিল। ফলে ভোটাররা নতুন করে সব শুরু করতে চাচ্ছিলেন। ট্রাম্পও রিগ্যানের মতো পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, এটা হবে ভোটারদের জীবদ্দশায় এক ঐতিহাসিক পরিবর্তন।
কিন্তু দুটি বিষয় এক নয়। পৃথিবীকে নিরাপদ করার জন্য কী কী করা যায়, রিগ্যান তার তালিকা দিয়েছিলেন। তিনি এমন এক দেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন, যেটি ‘ভেতরমুখী নয়, বাহিরমুখী হবে’। এর বিপরীতে ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকেই প্রথম অগ্রাধিকার দেওয়ার শপথ নিয়েছেন। তিনি দাবি করেছেন, পৃথিবীর যে দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের বদৌলতে উপকৃত হচ্ছে কিন্তু মার্কিন নেতাদের বেকুব মনে করছে, তাদের উচিত যুক্তরাষ্ট্রকে শ্রদ্ধা করা। ট্রাম্প বলে দিয়েছেন, তিনি ‘যুক্তরাষ্ট্র ও তার নাগরিকদের বিশ্বায়নের মিথ্যা স্লোগানের বলি হতে দেবেন না।’ বিষয়টা হচ্ছে, রিগ্যানের যুক্তরাষ্ট্রে আশা ছিল, কিন্তু ট্রাম্প রাগে গজগজ করছেন।
পাঠক, আপনাদের নব্য জাতীয়তাবাদে স্বাগত জানাই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই প্রথম দেখা গেল, বড় ও উদীয়মান শক্তিগুলো নানা রকম জাত্যভিমানের খপ্পরে পড়ছে। ট্রাম্পের মতো আরও কিছু দেশ যেমন, রাশিয়া, চীন ও তুরস্কের নেতারা এক নৈরাশ্যবাদী ধারণার বশবর্তী হয়ে ভাবছেন, পররাষ্ট্রনীতির দরকার নেই। কারণ, এতে নাকি এক দেশ যতটা লাভবান হয়, আরেকটি দেশ ঠিক ততটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যেখানে বৈশ্বিক স্বার্থ জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হয়। পরিবর্তন হিসেবে এটা বেশ বড়ই, এ কারণে পৃথিবী আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।
জাতীয়তাবাদ একটি পিচ্ছিল ধারণা। সে কারণে রাজনীতিকেরা সহজেই এটাকে নিজ স্বার্থে কাজে লাগাতে পারেন। খুব বেশি হলে জাতীয়তাবাদ কিছু অভিন্ন মূল্যবোধকে কেন্দ্র করে এমন লক্ষ্য অর্জনে দেশকে একত্র করতে পারে, যা মানুষ কখনো একা করতে পারে না। তবে ‘উদার জাতীয়তাবাদ’ ঐক্যের কথা বলে, যার দৃষ্টি থাকে সামনের দিকে। এর দৃষ্টান্ত হিসেবে পিস কোরের জাতীয়তাবাদ, কানাডার অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতন্ত্র কিংবা ২০০৬ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলে স্বাগতিক দেশ হিসেবে জার্মানদের নিজ দলকে সমর্থন করার ঘটনা উল্লেখ করা যায়। উদার জাতীয়তাবাদ কিছু সর্বজনীন মূল্যবোধের কথা বলে, যেমন স্বাধীনতা ও সমতা। অন্যদিকে ‘নৃতাত্ত্বিক জাতীয়তাবাদ’ আগ্রাসী। এতে একজন যতটুকু লাভবান হয়, আরেকজন ততটুকুই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই জাতীয়তাবাদ ইতিহাস ও জাতিগোষ্ঠীভিত্তিক, যার কারণে মানুষ জাতিতে জাতিতে বিভক্ত হয়েছে।
কথা হচ্ছে, ট্রাম্পের এই জনপ্রিয়তা উদার জাতীয়তাবাদের জন্য বড় এক ধাক্কাই বটে। যুদ্ধ-পরবর্তীকালে তাঁর উত্তরসূরিদের দেশপ্রেম নিয়ে কেউই প্রশ্ন তুলতে পারবে না। তা সত্ত্বেও এরা সবাই যুক্তরাষ্ট্রের সর্বজনীন মূল্যবোধ অনুমোদন করেছেন, দেশের বাইরে তার প্রচারণা চালিয়েছেন। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে কিছুটা ব্যতিক্রম ভেবে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট (আইসিসি) ও ইউএন কনভেনশন অন দ্য ল অব সি (ইউএনক্লোস)-এ স্বাক্ষর করা থেকে বিরত থাকলেও সব সময় নিয়মভিত্তিক ব্যবস্থাকে সমর্থন জানিয়েছে। এ ছাড়া বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সমর্থন জানিয়ে সে নিজেকে ও পৃথিবীকে নিরাপদ রেখেছে, যার কারণে পৃথিবীতে কামড়াকামড়ি শুরু হয়নি। এতে পৃথিবী সমৃদ্ধ হয়েছে।
ওদিকে রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিন বিশ্বজনীন উদার মূল্যবোধ বিসর্জন দিয়ে একদম নিজস্ব রুশ ধারায় ফিরে গেছেন। তিনি সেখানে গোঁড়া খ্রিষ্টানধর্মের সঙ্গে স্লাভিক ঐতিহ্যের মিশ্রণ ঘটিয়েছেন। তুরস্কের রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান একদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নমুখী যাত্রা মাঝপথে থামিয়ে দিয়েছেন, অন্যদিকে সংখ্যালঘু কুর্দিদের সঙ্গে আলোচনাও ভেস্তে দিয়েছেন। তিনি এখন কট্টর ইসলামি জাতীয়তাবাদের নৌকায় উঠে বসেছেন। ভারতের নরেন্দ্র মোদি বহির্মুখী, তিনি আধুনিকায়নের পক্ষের মানুষ। কিন্তু তাঁর সঙ্গে কট্টর নৃতাত্ত্বিক-জাতীয়তাবাদী হিন্দু গোষ্ঠীগুলোর সম্পর্ক আছে, যারা জাত্যভিমান ও অসহিষ্ণুতার কারবার করে।
আবার চীনের জাতীয়তাবাদ এতটা ক্রুদ্ধ ও প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠেছে যে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি তা নিয়ন্ত্রণের পরামর্শ দিয়েছে। চীন উন্মুক্ত বাজারের ওপর নির্ভরশীল, যে কিনা আবার কয়েকটি বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানের অংশীদার। সে যুক্তরাষ্ট্রের কাছাকাছি থাকতে চায়। কিন্তু ১৯৯০-এর দশক থেকে চীন শিশুদের ‘দেশপ্রেমমূলক’ শিক্ষা দিয়ে আসছে, যার লক্ষ্য হচ্ছে এক শতক কালের অবমাননাকর দখলদারির স্মৃতি মন থেকে মুছে ফেলা। আর সেখানকার মানুষদের খাঁটি চীনা হতে গেলে হান হতে হবে। বাকিরা সবাই দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক।
নৃতাত্ত্বিক জাতীয়তাবাদ সমৃদ্ধিশালী হলেও ‘উত্তর-জাতীয়তাবাদ’ নিয়ে পৃথিবী যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিল, তা ব্যর্থ হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রবক্তারা ভেবেছিলেন, ইউরোপে তো জাতীয়তাবাদ প্রভাবিত দুটি বিশ্বযুদ্ধ হয়েছে। তাই জাতীয়তাবাদ শুকিয়ে মরে যাবে। ধারণা ছিল, ইউরোপীয় জাতিগত বিভেদ কাটিয়ে উঠে একই সঙ্গে ক্যাথলিক, ফরাসি ও ইউরোপীয় হয়ে উঠবে। তবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অনেক দেশেই এটা কখনো ঘটেনি। ব্রিটিশরা তো গণভোট করে ইউনিয়ন ছেড়ে গেল। আর সাবেক কমিউনিস্ট দেশ যেমন, পোল্যান্ড ও হাঙ্গেরিতে বিদেশিদের সম্পর্কে আতঙ্ক সৃষ্টিকারী অতি জাতীয়তাবাদী সরকার ক্ষমতায় এসেছে। এমনও হুমকি আছে যে ফ্রান্স ইউনিয়ন ছেড়ে চলে যাবে। অর্থাৎ ইউনিয়ন ধ্বংস হবে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র সর্বশেষ বহির্বিশ্ব থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল। এর পরিণতি হয়েছিল বিপর্যয়কর। ট্রাম্পের জাতীয়তাবাদ দেশের ভেতরে অসহিষ্ণুতা ও সংখ্যালঘুদের গুণাবলি ও আনুগত্য নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি করছে। ফলে বিগত কয়েক দশকের মধ্যে এই প্রথম মার্কিন রাজনীতির রক্তধারা সেমিটীয় বিরোধিতার দ্বারা দূষিত হয়ে গেছে বলে যে অভিযোগ উঠেছে, তা কোনো দুর্ঘটনা নয়। এখন ট্রাম্প যদি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের মিত্ররা তাঁর কাছ থেকে যে নিরাপত্তা পায় তার মূল্য এরা দিতে পারছে না, তাহলে এই ছোট দেশগুলো কঠিন ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতির মুখে পড়বে।
ট্রাম্পকে বুঝতে হবে, সবকিছু থেকে সরে এলে সমস্যার সমাধান হবে না। এতে বরং তিনি নব্য জাতীয়তাবাদ উদ্ভূত নানামুখী জটিলতার মধ্যে পড়বেন। বিশ্বরাজনীতি বিষিয়ে উঠছে, যার অভিঘাতে একদিকে যুক্তরাষ্ট্র দরিদ্র হবে, অন্যদিকে তার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাবে। ফলে ট্রাম্প প্রতিশোধ ও শত্রুতার এক দুষ্টচক্রের মধ্যে পড়তে পারেন। এখনো সময় আছে, তিনি নিজের অশুভ লক্ষ্য থেকে সরে আসতে পারেন। নিজের দেশ ও পৃথিবীর জন্য ট্রাম্পের উচিত হবে, পূর্বসূরিদের পদাঙ্ক অনুসরণ করা।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, দ্য ইকোনমিস্ট থেকে নেওয়া।