বিএনপির প্রস্তাব: প্রশ্ন ও প্রত্যাশা

খালেদা জিয়া
খালেদা জিয়া

নির্বাচন নিয়ে নানান অদ্ভুত ঘটনা ঘটে পৃথিবীতে। নির্বাচনকেন্দ্রিক বিরোধে আফ্রিকায় এক দেশে দুই সরকার গঠিত হয়েছে, দেশ ভেঙে গেছে, কখনো গৃহযুদ্ধ বেধে গেছে। অনুন্নত বিশ্বের এসব উদাহরণ অবশ্য ইউরোপ-আমেরিকায় নেই।

ইউরোপ-আমেরিকা বা এশিয়ারও কিছু দেশের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠান। নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তাই এসব দেশে উত্থাপিত হয় না; কালেভদ্রে হলেও তা সংসদ অকার্যকর করে না এবং সরকারকে শত্রু বানিয়ে ফেলে না। সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতি করে তুরস্কে এরদোয়ান, ভারতে নরেন্দ্র মোদি, আমেরিকায় ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচিত হতে পেরেছেন। এসব নির্বাচন নিয়ে জনগোষ্ঠীর একটি বিপুল অংশের গভীর আক্ষেপ থাকা সত্ত্বেও নির্বাচনের ফলাফল সব রাজনৈতিক দল মেনে নিয়েছে। এর কারণ নির্বাচনব্যবস্থার সততা সম্পর্কে মানুষের আস্থা। এই আস্থা কম্বোডিয়া, উজবেকিস্তান বা উগান্ডার মানুষের নেই।

নির্বাচনব্যবস্থা সম্পর্কে মানুষের আস্থা সৃষ্টির প্রয়োজন বাংলাদেশের জন্মলগ্নেই স্বীকৃত হয়েছিল। ১৯৭২ সালের সংবিধানেই তাই নির্বাচন কমিশনকে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা দেওয়া হয়, নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী ও স্বাধীন করার জন্য সহায়ক 

বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, গত ৪৫ বছরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলোর আমলে নির্বাচন কমিশনগুলো জনগণের আস্থা বহুলাংশে অর্জন করতে পারলেও, দলীয় সরকারের আমলে কখনো তা হয়নি। সর্বশেষ ২০১৪ সালে একটি একতরফা নির্বাচন বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হওয়ার পর নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে মানুষের আস্থা আরও বিনষ্ট হয়েছে।

বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়া এমন এক পটভূমিতে গত ১৮ নভেম্বর নির্বাচন কমিশন গঠন বিষয়ে কিছু প্রস্তাব পেশ করেছেন। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ আর মাত্র মাস তিনেকের মধ্যে শেষ হয়ে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে দেশের অন্যতম বৃহৎ দল বিএনপির পক্ষ থেকে এমন প্রস্তাব দেওয়া হবে, তা প্রত্যাশিত ছিল।

অতীতে জাতীয় পার্টির অধীন ১৯৮৮ সালের নির্বাচন ও বিএনপির অধীন ১৯৯৬ সালের নির্বাচন বর্জনের পরও আওয়ামী লীগসহ বর্জনকারী দলগুলো বিভিন্ন দাবি ও প্রস্তাব পেশ করেছিল। পার্থক্য হচ্ছে, এবার খালেদা জিয়া এমন এক পরিস্থিতিতে নির্বাচন কমিশন সংস্কারের দাবি তুলেছেন, যখন রাজপথে আন্দোলনের কোনো উত্তাপ নেই, সমাবেশ করার স্বাধীনতা পর্যন্ত নেই।

এই অবস্থায় এই প্রস্তাবগুলো আদৌ কোনো ভূমিকা রাখতে পারবে কি না, এ নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। বিএনপির প্রস্তাব প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নাকচ করে দিয়েছেন। তবে আগামী নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা এবং এতে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার সদিচ্ছা সরকারের থাকলে এই প্রস্তাবগুলোর আলোকে কিছু সমঝোতা হওয়ার প্রয়োজন আছে। বিএনপির প্রস্তাব কেন গ্রহণযোগ্য নয় এবং এর বিপরীতে শ্রেয়তর কী বিকল্প আছে, তা স্পষ্ট করার দায়িত্বও সরকারের রয়েছে।

২.

বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়ার প্রস্তাবে প্রধানত দুটো দিক রয়েছে। একটি নীতিগত, অপরটি পদ্ধতিগত। তিনি নীতিগতভাবে সবার ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের কমিশনে রাখার কথা বলেছেন। এই নীতির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করার অবকাশ নেই।

তবে এই নীতি বাস্তবায়ন করার কথা বলে খালেদা জিয়া জামায়াতকে অন্তর্ভুক্ত করার ‘কৌশল’ নিয়েছেন বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন কেউ কেউ। আমি মনে করি, এই আশঙ্কা অতিরঞ্জিত। জামায়াতকে বাদ দিয়ে আলোচনা করতে চাইলে তা করার উপায় খালেদা জিয়ার প্রস্তাবেও প্রচ্ছন্নভাবে রয়েছে। নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত দলগুলোর মধ্যে আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখলেই তা করা সম্ভব।

খালেদা জিয়ার প্রস্তাবের অন্যতম নীতিগত দিক হচ্ছে, নির্বাচন কমিশনে এবং কমিশন গঠন করার জন্য বাছাই কমিটিতে নিয়োগসংক্রান্ত। তিনি এসব জায়গায় নিরপেক্ষ, সৎ, অভিজ্ঞ ও প্রাজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়োগ দিতে বলেছেন। প্রবলভাবে বিভক্ত বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও নাগরিক সমাজে এ ধরনের ব্যক্তি খুঁজে বের করা অবশ্যই কঠিন। কিন্তু তিনি কিছু সূত্রের কথা বলেছেন, তা অনুসরণ করা অসম্ভব নয়। যেমন তিনি অবসরের পর লাভজনক পদে থাকা বিচারপতি বা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে চাকরি করা সরকারি কর্মকর্তাদের কমিশনে বা বাছাই কমিটিতে নিয়োগ না দিতে বলেছেন। আমরা সবাই জানি, ক্ষমতাসীন সরকারের বিশেষ ঘনিষ্ঠ বা অনুগত ব্যক্তিরা ছাড়া এসব পদে বাংলাদেশে কেউ নিয়োগ পেতে পারেন না। কাজেই এমন ব্যক্তিদের বাদ দেওয়ার প্রস্তাব অসমীচীন নয়।

বিএনপির প্রস্তাবের দুর্বলতা হচ্ছে এর পদ্ধতিগত দিক। এতে বলা হয়েছে যে নির্বাচন কমিশনারদের নাম প্রাথমিকভাবে প্রস্তাব করবে রাজনৈতিক দলগুলো। তাদের প্রেরিত নামগুলো থেকে বাছাই কমিটি নির্বাচন কমিশনের পাঁচজন সদস্য নিয়োগের জন্য ১০টি নাম রাষ্ট্রপতির কাছে প্রস্তাব করবে। রাষ্ট্রপতি এর মধ্য থেকে একজন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং চারজন কমিশনার নিয়োগ দেবেন। বিএনপির প্রস্তাবে প্রথম দুটো প্রক্রিয়াতেই ব্যাপক আলোচনার কথা বলা হয়েছে। এক. ‘ঐকমত্যের’ ভিত্তিতে বাছাই কমিটির সদস্যদের নিয়োগের জন্য রাষ্ট্রপতি সব দলের সঙ্গে আলোচনা করবেন। দুই. ‘সর্বসম্মতভাবে’ কমিশনার পদে ১০টি নাম চূড়ান্ত করার জন্য বাছাই কমিটি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করবে। বাছাই কমিটির এই আলোচনায় সর্বসম্মত ১০টি নাম না পাওয়া পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে বলা হয়েছে। এই সুদীর্ঘ ও অনিশ্চিত আলোচনা প্রক্রিয়ার প্রস্তাবে প্রথম আলোর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। এটি আসলেও বিএনপির প্রস্তাবের একটি বড় দুর্বলতা।

বিএনপির প্রস্তাবের তৃতীয় দিকটি হচ্ছে আইন সংস্কারমূলক। প্রস্তাবে অতিরিক্ত ব্যালট বাক্স প্রকাশ্যে রাখা, পরিপূর্ণ ব্যালট বাক্স সংশ্লিষ্ট বুথে রাখা, প্রিসাইডিং কর্মকর্তা কর্তৃক স্বাক্ষরিত ফলাফল পোলিং এজেন্ট না দিয়ে ভোটকেন্দ্র ত্যাগ না করার যে প্রস্তাবগুলো করা হয়েছে, তা বাস্তবসম্মত।

তবে আইন সংস্কারের প্রস্তাবে নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞায় প্রতিরক্ষা বাহিনীকে অন্তর্ভুক্ত করার যে প্রস্তাব বিএনপি দিয়েছে, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। আওয়ামী লীগ এর সমালোচনা করেছে, ব্যারিস্টার রফিক-উল হকও বিএনপির এই প্রস্তাবে তাঁর অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় এটি কোনো অযৌক্তিক প্রস্তাব নয় বলে আমি মনে করি। আমাদের মনে রাখা উচিত যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলগুলোতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হিসেবে নির্বাচনকালে সেনাবাহিনী অত্যন্ত ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছিল। এ ধরনের চারটি নির্বাচনের দুটোতে বিএনপি এবং দুটোতে আওয়ামী লীগ বিজয় অর্জন করেছিল।

২০০৯ সালে নির্বাচনের কাজে প্রতিরক্ষা বাহিনীকে (সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী) বাদ দেওয়ার পর যে নির্বাচনগুলো অনুষ্ঠিত
হয়, তাতে পুলিশ, র‍্যাব, বিজিবির ভূমিকা সমালোচিত হয়েছিল, এসব বাহিনীর প্রধানেরা বিভিন্ন সময়ে সরাসরি রাজনৈতিক বক্তব্যও প্রদান করেছিলেন। তাই সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন করতে হলে, ভোটার ও প্রার্থীদের মনে আস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে নির্বাচনকালে সেনাবাহিনী মোতায়েন জরুরি বলেই আমি মনে করি।

৩.

ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বিএনপির প্রস্তাবে জামায়াত ও সেনাবাহিনী প্রসঙ্গের সমালোচনা করেছেন। আবার এ–ও বলেছেন যে এর অনেকগুলো ভালো বিষয় আছে, যা গণতন্ত্র ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য জরুরি। অন্যদিকে বিএনপির প্রস্তাব তাৎক্ষণিকভাবে নাকচ করতে গিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক একে অন্তঃসারশূন্য ও চর্বিত চর্বণ বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি ও অন্য কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা বলেছেন যে নির্বাচন কমিশন কীভাবে গঠিত হবে, তা সংবিধানে আছে এবং সে অনুসারে রাষ্ট্রপতি নতুন কমিশনার নিয়োগ দেবেন। তাঁদের এই বক্তব্য আংশিক সত্যি, পুরোপুরি নয়। আমাদের সংবিধানে নিয়োগসংক্রান্ত একটি আইন করে নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ প্রদানের কথা বলা হয়েছে। এই আইন এখনো করা হয়নি। এই আইন প্রণয়নকালে বিএনপির এবং অন্য যে কারও ভালো প্রস্তাব বিবেচনা করার সুযোগ সরকারের রয়েছে।

রফিক-উল হক বিএনপির প্রস্তাবের ভিত্তিতে আলোচনার পক্ষে মত দিয়েছেন। এ দেশে প্রকাশ্যে আলোচনার আহ্বানে সাড়া দেওয়াকে বিরাট রাজনৈতিক দুর্বলতা ভাবা হয়। হয়তো সে বিষয়টির দিকে লক্ষ করেই আকবর আলি খান অপ্রকাশ্যে হলেও আলোচনার তাগিদ দিয়েছেন বড় দল দুটোকে।

সিদ্ধান্তটা এখন আওয়ামী লীগ সরকারের। সরকার এখন যতই শক্তিশালী হোক না কেন, এই শক্তি কতটা জনগণের সমর্থনের ভিত্তিতে, তা নিয়ে অনেকের সন্দেহ রয়েছে। ২০১৪ সালের বিতর্কিত সংসদ নির্বাচন এবং পরবর্তী সময়ে স্থানীয় সরকারগুলোর নির্বাচনে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যাপক কারচুপির কারণে এই সন্দেহ অযৌক্তিক বলা যাবে না। ২০১৪ সালে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে ভোটবিহীন ও এক প্রার্থীরনির্বাচনের কারণে সরকারের নৈতিক বৈধতার সংকটও রয়েছে।

এসব সংকট ও সন্দেহ বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী ও বাহাত্তরের সংবিধান প্রণয়নকারী দলের জন্য শোভনীয় নয়। আওয়ামী লীগ এটি অনুধাবন করতে পারলেই কেবল বিএনপির প্রস্তাব একটি ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা করতে পারে। এই প্রস্তাব হুবহু মানতে হবে, এটি বলার কোনোই অবকাশ নেই। কিন্তু এটি বা অন্য যেকোনো দলের প্রস্তাব বিবেচনায় নেওয়া সরকারের দায়িত্ব।

আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।