পাকিস্তান-ভারত ও শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞতা

সংসদীয় নির্বাচনে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভের জন্য যেকোনো রাজনৈতিক দল চেষ্টা করবে, সেটাই স্বাভাবিক। নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য যেকোনো দলেরই নেতৃত্ব চাইবেন তাঁর দলের প্রতি ভোটারদের নিরঙ্কুশ সমর্থন। কিন্তু কোনো দল বা জোট যখন নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার বেশি, অর্থাৎ সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ আসন লাভ করে, তখন তা কি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য ইতিবাচক ফল বহন করে, নাকি তা দেশের জন্য অভিশাপ হয়ে ওঠে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমরা দক্ষিণ এশিয়ার চারটি দেশ—বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার গত চার দশকের (১৯৭১-২০১১) ৩৫টি নির্বাচনের দিকে মনোনিবেশ করেছি। তাতে দেখা যায়, ১১টি নির্বাচনে কোনো দল বা জোট দুই-তৃতীয়াংশ আসন লাভ করেছে। বাংলাদেশে এই ধরনের দুই-তৃতীয়াংশের সংসদ তৈরি হয়েছে ছয়বার, ভারতে দুবার, পাকিস্তানে দুবার ও শ্রীলঙ্কায় একবার।
ভারতে ১৯৭১ সালে ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বাধীন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস লোকসভায় ৬৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ আসন লাভ করে। এই সুপার মেজরিটির কারণেই ক্ষমতাসীন দলটির পক্ষে সংবিধানের ২৪তম সংশোধনী পাস করা সম্ভব হয়। এই সংশোধনীর সূত্রপাত হয় দেশের বিচার বিভাগের সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের সংঘাত থেকে। সুপ্রিম কোর্ট একটি রায়ে বলে যে সংবিধানের মৌলিক অধিকারবিষয়ক ধারাগুলো সংশোধনের কোনো অধিকার সংসদের নেই। আদালত মৌলিক অধিকারগুলোকে প্রকৃতিগতভাবে ‘ট্র্যানসেনডেন্টাল’ বা অতীন্দ্রিয় বলে বর্ণনা করে এবং রায় দেন যে সংসদ মৌলিক অধিকারগুলো সংক্ষেপিত করার বা তা হরণ করার অধিকার রাখে না। এই রায়ের পর ক্ষমতাসীন কংগ্রেস সংবিধানের ১৩ ও ৩৬৮ অনুচ্ছেদের সংশোধনী পাস করে সংবিধানের ২৪তম সংশোধনীর মাধ্যমে এবং এই অনুচ্ছেদগুলোর সংশোধনীর কারণেই সংসদ মৌলিক অধিকার স্থগিত করতে সক্ষম হয়। ১৯৭১ সালের এই সংশোধনীগুলোকে অনেকেই ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতার প্রসার বলে বিবেচনা করে থাকেন। সংবিধানের সংশোধনীর কারণেই ১৯৭৫ সালের ২৬ জুন দেশে জরুরি অবস্থা জারি করা সম্ভব হয়, যার আওতায় নাগরিক অধিকারগুলো এবং নির্বাচন মুলতবি করা হয়। স্মরণ করা যেতে পারে যে ১৯৭৫ সালের ১২ জুন এলাহাবাদের আদালত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নির্বাচন বাতিল করে দেন এবং তাঁর আসন শূন্য ঘোষণা করেন। আদালত তাঁকে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের অধিকার দেন, কিন্তু তাঁর সংসদ সদস্যপদ বাতিল করে দেন। আদালত তাঁকে পরবর্তী ছয় বছর নির্বাচনে অংশ নেওয়ার অযোগ্য বলেও ঘোষণা করেন। তার ১৫ দিনের মধ্যেই দেশে জরুরি অবস্থা জারির ঘোষণা দেওয়া হয়। ১৯ মাসের এই জরুরি অবস্থার আমলে জাতীয় সংসদ ও রাজ্যপর্যায়ের নির্বাচনগুলো স্থগিত রাখা হয়।
ভারতে দ্বিতীয়বার কোনো দলের দুই-তৃতীয়াংশ আসন পাওয়ার ঘটনা ঘটে ১৯৮৪ সালে। রাজীব গান্ধীর নেতৃত্বাধীন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ৭৫ দশমিক ৮ শতাংশ আসন লাভ করে। এই ব্যাপক বিজয়ের পেছনে ছিল ভোটারদের সহানুভূতি। ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর হত্যাকাণ্ডের পর এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। রাজীব গান্ধীর পাঁচ বছরের শাসনামলকে নেতৃত্বের দুর্বলতায় জরাজীর্ণ বলে অভিহিত করা হয়। এই সময়ে ক্ষমতাসীনেরা বড় ধরনের দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে বলেও অভিযোগ রয়েছে। রাজীব গান্ধী নিজে সুইডিশ এক অস্ত্র সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বোফর্স-এর কাছ থেকে ১৯৮৬ সালে উৎকোচ নিয়েছিলেন বলেও অভিযোগ রয়েছে এবং এখনো এ বিষয়টির কার্যত নিষ্পত্তি হয়নি। কিন্তু এসব সমালোচনার পাশাপাশি এই কৃতিত্ব রাজীব গান্ধীর প্রাপ্য যে দক্ষিণ এশিয়ায় একমাত্র রাজনীতিবিদ, যিনি সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা সত্ত্বেও সংবিধানের পরিবর্তন ঘটাননি বা সংবিধানবহির্ভূতভাবে ক্ষমতার প্রয়োগ করেননি।
পাকিস্তানের ইতিহাসে সুপার মেজরিটির ঘটনা ঘটেছে দুবার, কুড়ি বছরের ব্যবধানে ১৯৭৭ ও ১৯৯৭ সালে। ১৯৭৭ সালের নির্বাচন ছিল বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তানের প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচন। ১৯৭২ সাল থেকে জুলফিকার আলী ভুট্টোর নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) ক্ষমতায় ছিল। কেননা, ১৯৭২ সালে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী তাদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিল। ১৯৭০ সালের নির্বাচনই ছিল তাদের ক্ষমতার ভিত্তি। ইতিমধ্যে পাকিস্তানে নতুন সংবিধান প্রণীত হয়েছে। তার আওতায় প্রথম নির্বাচনে পিপিপি নিরঙ্কুশ ক্ষমতা নিশ্চিত করতে নির্বাচনে জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছে বলে বিরোধীরা অভিযোগ তোলে। সংসদের ৭৭ দশমিক ৫ শতাংশ আসন লাভের ফলাফল বিরোধীদের এই অভিযোগকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলে। ভুট্টো সরকার এই অভিযোগের জবাবে বিরোধীদের কঠোর হাতে দমনের নীতি গ্রহণ করে, অন্যদিকে বিরোধীরা রাজপথে আন্দোলন গড়ে তোলে। এই পটভূমিকায় জনসাধারণের ক্ষোভকে পুঁজি করে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করে। জেনারেল জিয়াউল হকের সেনাশাসন চলে ১৯৮৮ সালের ১৭ আগস্টে এক রহস্যময় বিমান দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত। পাকিস্তানের রাজনীতি ও সমাজে ধর্মের প্রসারের ক্ষেত্রে জিয়াউল হকের শাসনের ভূমিকা অতীতের যেকোনো শাসকের চেয়ে বেশি। সম্ভবত আর কোনো শাসকই পাকিস্তানের রাজনীতি, সমাজ ও আইনি ব্যবস্থাকে বদলে দিতে সক্ষম হননি।
১৯৯৭ সালের নির্বাচনে মিয়া নওয়াজ শরিফের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান মুসলিম লীগ দুই-তৃতীয়াংশ আসনের চেয়ে একটি কম আসন পেয়ে বিজয়ী হলেও একজন সংসদ সদস্যের সমর্থন সংগ্রহ করতে দলকে বেগ পেতে হয়নি। এই আমলেই সংবিধানের ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ সংশোধনী পাস হয়, যা প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতাকে করে তোলে নিরঙ্কুশ। ত্রয়োদশ সংশোধনীর প্রধান বিষয় ছিল প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা হ্রাস। এই সংশোধনীর আওতায় সরকার বরখাস্ত করার ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে নিয়ে নেওয়া হয়। একই সঙ্গে দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রধানদের এবং প্রদেশের গভর্নরদের নিয়োগে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা প্রয়োগ প্রধানমন্ত্রীর ‘পরামর্শ’-নির্ভর করা হয়। এসব পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে সেনা-শাসনামলে প্রেসিডেন্টকে দেওয়া ক্ষমতা হ্রাসের বিধানকে অনেকেই ইতিবাচক বলে মনে করেন। কিন্তু চতুর্দশ সংশোধনীর মাধ্যমে যখন সংসদের সদস্যদের দলবদল বন্ধের নামে প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হলো, তখন বোঝা গেল যে প্রধানমন্ত্রী এখন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়ে পড়েছেন এবং তাঁকে নিয়ন্ত্রণের সাংবিধানিক ব্যবস্থা প্রায় নেই বললেই চলে। এসব ক্ষমতার অধিকারী প্রধানমন্ত্রী দেশের বিচারব্যবস্থার সঙ্গে ইচ্ছা করেই বিরোধে জড়িয়ে পড়েন, যখন তিনি সুপ্রিম কোর্টে পাঁচজন বিচারক নিয়োগের চেষ্টা চালান। একপর্যায়ে নওয়াজ শরিফের বিরুদ্ধে এই মামলার শুনানির সময়ে ১৯৯৭ সালের নভেম্বরে সরকার-সমর্থকেরা সুপ্রিম কোর্ট ভবনে মিছিল করে চড়াও হন। ওই বছরের শেষ নাগাদ প্রধান বিচারপতির বরখাস্ত এবং প্রেসিডেন্টের পদত্যাগের পেছনে প্রধানমন্ত্রী শরিফের হাত ছিল বলেই বোঝা যায়। সব মিলিয়ে বিচার বিভাগ এবং নির্বাহী বিভাগের মধ্যে দ্বন্দ্বের বিষয়টি শাসনের ক্ষেত্রে বড় ধরনের বাধা তৈরি করে। ১৯৯৯ সালে প্রধানমন্ত্রী সেনাপ্রধানকে অপসারণের চেষ্টা করলে জেনারেল পারভেজ মোশাররফ সেনা-অভ্যুথান ঘটিয়ে ক্ষমতা দখল করেন।
শ্রীলঙ্কায় ১৯৭৭ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচন একাধিক কারণে গুরুত্বপূর্ণ; তার মধ্যে অন্যতম হলো যে এই নির্বাচনে জে আর জয়বর্ধনের নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টি (ইউএনপি) সংসদে ৮৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ আসন লাভ করে। প্রধান বিরোধী দল ও সাবেক ক্ষমতাসীন শ্রীলঙ্কা ফ্রিডম পার্টির (এসএলএফপি) পাওয়া আসন ছিল মাত্র ৪ দশমিক ৭৬ শতাংশ। সংসদ ১৯৭৭ সালে দ্বিতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৭২ সালের সংবিধানে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটায়, যার মধ্য দিয়ে তৈরি করা হয় নির্বাহী প্রেসিডেন্টের পদ। অর্থাৎ কার্যত ওয়েস্টমিনস্টার ধরনের সংসদীয় ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে সেখানে রাষ্ট্রপতির শাসনের ব্যবস্থা চালু করা হয়। ১৯৭৮ সালের ৪ ফেব্রুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে গিয়ে জয়বর্ধনে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেন। তারপর নতুন সংবিধান তৈরি প্রণয়ন করা হয়, যাতে ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’-ব্যবস্থা তুলে দিয়ে সেখানে চালু করা হয় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা। এরপর আরেক সংশোধনীর মাধ্যমে (১৯৮২ সালের চতুর্থ সংশোধনী) সংসদ তার মেয়াদ ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত বাড়িয়ে নেয়। উপর্যুপরি সংশোধনের মাধ্যমে বিচার বিভাগকে দুর্বল করে ফেলা হয় এবং প্রেসিডেন্টের দায়মুক্তির পরিধি বাড়ানো হয় ১৯৮৮ সালে চতুর্দশ সংশোধনীর মাধ্যমে। ১৯৭৭ সালের নির্বাচিত সংসদ দেশের রাজনীতি ও শাসনব্যবস্থার এতটাই পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম হয় যে, ১৯৯৭-পূর্ববর্তী শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ১৯৭৮-পরবর্তী শ্রীলঙ্কার ব্যবধান কেবল এক বছরের নয়।
চার দেশের চার দশকের ইতিহাস থেকে আমরা বলতে পারি যে বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতার সংসদগুলো সংবিধানের ব্যাপক পরিবর্তন করেছে এবং প্রধানমন্ত্রীর (শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্টের) নির্বাহী ক্ষমতা বাড়িয়ে দিয়েছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা হয়ে পড়েছে নিয়ন্ত্রণহীন।
কিন্তু অনেকেই বলতে পারেন যে এই সংসদগুলো নির্বাচিত হয়েছে জনসাধারণের ভোটে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অবাধ, প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনের মাধ্যমে। ফলে এগুলো

জনসাধারণের মতামতেরই প্রকাশ। আসলেই কি তা-ই?

আগামীকাল: জনগণের ইচ্ছাতেই সুপার মেজরিটি?

আলী রীয়াজ: গণনীতিবিষয়ক গবেষক, উড্রো উইলসন সেন্টার, ওয়াশিংটন।