একটি মৃত্যু ও ৯৫ কোটি টাকার দরপত্র

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি ভবন নির্মাণের ৯৫ কোটি টাকার দরপত্র নিয়ে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের বিরোধ-সংঘর্ষের সঙ্গে দিয়াজ ইরফান চৌধুরীর মৃত্যুর কোনো সম্পর্ক আছে কি না, আমরা জানি না। কারণ, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী দিয়াজের মৃত্যুর কারণ যদি আত্মহত্যা হয়ে থাকে, সেই রহস্যের উদ্ঘাটন হবে তাঁর জীবনের ব্যক্তিগত কোনো দুঃখ-বেদনা-হতাশার উৎস অনুসন্ধান করে। তবে দিয়াজের পরিবার ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে। পরিবার, তাঁর রাজনৈতিক সহকর্মী ও বন্ধুদের দাবি, এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। তাঁদের দাবি সত্য হলে এই মৃত্যুর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯৫ কোটি টাকার দরপত্র নিয়ে বিরোধের যে সম্পর্ক আছে, তা মানতে হবে। কারণ, মাত্র কিছুদিন আগে দরপত্র–সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ নম্বর গেট এলাকায় দিয়াজের বাসভবনে হামলা ও ভাঙচুর চালিয়েছে ছাত্রলীগের কিছু কর্মী। অর্থাৎ দলে দিয়াজের একটি শত্রুপক্ষ আছে।
ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সহসম্পাদক দিয়াজ ইরফান ফাইন্যান্স অ্যান্ড মার্কেটিং বিভাগের ছাত্র ছিলেন। কিছুদিন আগেও ছাত্রলীগ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা কমিটির যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন তিনি। সেই পদ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রজীবন থেকে বেরিয়ে এলেও দলীয় কোন্দল, বিরোধ যে দিয়াজের পিছু ছাড়েনি তাঁর বাসায় হামলার ঘটনাতেই তা বোঝা যায়।
বাসায় হামলার ঘটনার পর নিরাপত্তার জন্য দিয়াজের পরিবার অন্যত্র চলে গিয়েছিল। দিয়াজ একাই থাকতেন। সেই বাসা থেকেই তাঁর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করার পর তাই সন্দেহ দানা বাঁধে। ঠান্ডা মাথায় খুন করে তাঁর লাশ ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে—তাঁর পরিবার ও সতীর্থদের এমন দাবি উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ময়নাতদন্তে এটিকে আত্মহত্যা বলা হলেও এর আগে ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে পুলিশের সুরতহাল প্রতিবেদনে মৃতদেহের বিভিন্ন স্থানে কালচে দাগ ও নখের আঁচড় থাকার কথা বলা হয়েছিল।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদ ভবনের দ্বিতীয় পর্যায়ের ৭৫ কোটি টাকার কাজ ও শেখ হাসিনা হলের ২০ কোটি টাকার নির্মাণকাজের দরপত্রের ফরম কেনার সময় থেকেই ক্যাম্পাস অস্থির হয়ে ওঠে। বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের পছন্দের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্যরা এ দরপত্রের ফরম কিনতে পারেনি বলে অভিযোগ তোলে ছাত্রলীগেরই একটি অংশ। এ নিয়ে অন্তত চার দফা সংঘর্ষে আহত হন ছাত্রলীগের বেশ কয়েকজন। সর্বশেষ ছাত্রলীগের সহসভাপতি তাইফুল হককে কুপিয়ে গুরুতর আহত করে কতিপয় মুখোশধারী। এর জের ধরে দিয়াজসহ ছাত্রলীগের চারজন নেতা-কর্মীর বাসভবনে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে।
এই ঘটনাগুলো ধারাবাহিকভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দিয়াজের মৃত্যুকে আত্মহত্যা হিসেবে নিঃসংশয়ে মেনে নেওয়া কঠিন। তাই ধর্মঘট, অবরোধ, মানববন্ধন ইত্যাদি চলছে। দিয়াজের পরিবারসহ অন্য সতীর্থরা এ ঘটনায় ইন্ধন দেওয়ার অভিযোগে আঙুল তুলেছেন আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতার দিকেও। দিয়াজের মৃত্যুর অব্যবহিত পর চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ
না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নিরপেক্ষ না থাকলে এবং দরপত্রের প্রক্রিয়াতে স্বচ্ছতা না এলে ভবিষ্যতে ক্যাম্পাসে আরও বড় ধরনের সংঘাতের আশঙ্কা রয়েছে।
যখন যে দল ক্ষমতায় থাকবে তার ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের যাবতীয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ঠিকাদারি কাজ থেকে নিজেদের ‘ভাগ’ বুঝে নেবেন, এটা তো আজ প্রায় নিয়মে দাঁড়িয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো বিরোধ-সংঘর্ষ হলে এখন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতারা এসে সমঝোতার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাঁদের কেউ কি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে আশ্বস্ত করতে পারবেন যে উন্নয়ন বা নির্মাণকাজের সঙ্গে কোনো দলীয় নেতা-কর্মীর সম্পৃক্ততা দেখা গেলে তাঁর ছাত্রত্ব বাতিল করার উদ্যোগে তাঁরা কর্তৃপক্ষকে সর্বতোভাবে সহায়তা করবেন? এমনকি অভিভাবক সংগঠন আওয়ামী লীগের স্থানীয় প্রভাবশালী নেতারাও কি তাঁদের অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের এ ধরনের কাজ থেকে বিরত রাখার কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারবেন?
শুধু বিশ্ববিদ্যালয় কেন, যেসব কলেজে ছাত্রলীগের একক কর্তৃত্ব আছে, সেগুলোর আশপাশের এলাকার বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বা দোকানপাটেও তাদের নামে চাঁদাবাজির অভিযোগ আছে। এখানে ছাত্রলীগের কথা আলাদা করে বলছি, কারণ একসময় একই অভিযোগ বিএনপির ছাত্রসংগঠন ছাত্রদল বা জামায়াত-সমর্থিত ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধে থাকলেও আজ তাদের অনেকেই হয় পাততাড়ি গুটিয়েছে, নয়তো ভোল পাল্টে ছাত্রলীগের মিছিল-সমাবেশে অংশ নিচ্ছে।
দিয়াজ লেখাপড়ায় ভালো ছিলেন। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণির সমমানের জিপিএ পেয়েছেন। বিসিএসে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেননি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী পরিচালক পদে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে মৌখিক পরীক্ষা দিয়ে ফলাফলের অপেক্ষা করছিলেন। ভালো বিতার্কিক ছিলেন। স্কুল পর্যায়ে উপজেলার শ্রেষ্ঠ বিতার্কিকের পুরস্কার পেয়েছিলেন। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বইপড়া কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে পুরস্কার জিতেছিলেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী জাহেদা আমিন চৌধুরীর এক জীবনের স্বপ্ন ও সংগ্রাম যখন সাফল্যের দোরগোড়ায়, তখন কেন এমন অনাকাঙ্ক্ষিত পরিণতি নেমে এল তাঁর ছেলের জীবনে?
বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতি থেকে দূরে থেকে একটা স্বস্তির জীবন হয়তো নিজেও চেয়েছিলেন দিয়াজ। তাঁর সেই
ইচ্ছার কথা প্রকাশিত হয়েছিল গত ১১ নভেম্বর ফেসবুকে দেওয়া তাঁর স্ট্যাটাস থেকে। লিখেছিলেন, ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) আমি একজন সাবেক শিক্ষার্থী। চবির সঙ্গে আমার সম্পর্ক এটাই। চবির রাজনৈতিক কোনো বিষয় নিয়ে আমার সঙ্গে যোগাযোগ না করার অনুরোধ রইল। করলে ব্ল্যাক লিস্টে ঢুকবেন, আমাকে আমার মতো করে ভালো থাকতে দেন, সবাই ভালো থাকুন।’ কিন্তু ভালো থাকা আর হলো না দিয়াজের।
বিক্ষোভ, সমাবেশ, মানববন্ধন, সংবাদ সম্মেলন—নানা কিছু হয়েছে দিয়াজের মৃত্যুর ঘটনায়। দিয়াজের পরিবার ও সতীর্থরা বারবার বলছেন, পুরো ঘটনাটিকে আত্মহত্যা প্রমাণের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে একটি মহল। ময়নাতদন্তকে প্রভাবিত করা হয়েছে বলে মনে করেন তাঁরা। তাঁদের এই সংশয় ও আশঙ্কাকে গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া দরকার বলে মনে করি আমরা। প্রয়োজনে পুনরায় ময়নাতদন্ত করা হোক।
৯৫ কোটি টাকার দরপত্র নিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে চলেছে কয়েক মাস ধরে, তা থেকে কি কোনো শিক্ষা নেবে ঊর্ধ্বতন মহল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন ও নির্মাণকাজের সঙ্গে ছাত্রনেতা ও কর্মীদের সম্পৃক্ত থাকার এই রেওয়াজ বন্ধ করা কি একেবারেই অসম্ভব?
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: সাংবাদিক।