নোট বাতিলের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া

অচল নোট বদলাতে গিয়ে ভারতীয় নাগরিকেরা দুুর্ভোগের মধ্যে পড়েন
অচল নোট বদলাতে গিয়ে ভারতীয় নাগরিকেরা দুুর্ভোগের মধ্যে পড়েন

ভারতে সর্বোচ্চ মূল্যমানের দুটি নোট বাতিলের পর ঘরে-বাইরে যেমন প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে, তার দৃষ্টান্ত বিরল। আমাদের প্রজন্মের এবং আরও বয়োজ্যেষ্ঠদের স্মরণে থাকতে পারে, মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় ট্রেজারি ও ব্যাংক লুটের ঘটনা ঘটে, যার বড় অংশই ছিল মুক্তিযুদ্ধের খরচ নির্বাহের জন্য। এই টাকাকে নিষ্ক্রিয় করার জন্য ১৯৭১ সালের জুন মাসে তৎকালীন পাকিস্তানের সামরিক সরকার ১০০ ও ৫০০ রুপির সব নোট বাতিল ঘোষণা করে। সে সময় বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চলে এবং সীমান্তের ওপারে যেসব পাকিস্তানি নোট চলত, সেগুলোর কোনো কোনোটির ওপর ‘জয় বাংলা,’ কিংবা ‘বাংলা দেশ’ অথবা ‘ঢাকা’ (Dacca) সিল মারা থাকত। পাকিস্তান সরকারের ঘোষণায় এ রকম সিল মারা নোটগুলোও বাতিল করা হয়েছিল। এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে পাকিস্তান তথা অবরুদ্ধ বাংলাদেশে কোনো দৃশ্যমান প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। অচল নোট ব্যাংকে জমা দেওয়ার পর তাদের অন্য নোট না দিয়ে প্রাপ্তি রসিদ দেওয়া হয়। যাঁদের কাছে এই নোট ছিল, তাঁদের মধ্যে দেখা দেয় আতঙ্ক। কারণ, ঘোষণায় বলা হয়েছিল যেসব টাকা লুট হয়েছে, সেই টাকার নম্বর যদি জমা দেওয়া টাকার সঙ্গে মিলে যায়, তাহলে সেই নোট জমাদানকারীদের গ্রেপ্তার করা হবে। সে রকম কোনো নোট পাওয়া গেছে কি না কিংবা কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল কি না, জানা যায়নি। তবে সপ্তাহ খানেকের মাথায় নতুন ভিন্ন মূল্যমানের নোট ফেরত দেওয়া শুরু হয়।
বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার পর কয়েক মাস পর্যন্ত পাকিস্তানি মুদ্রা চালু ছিল। ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম যে নোট বাতিল ঘোষণা করা হয়, সেটি পাকিস্তানি ৫০ রুপির নোট, যেটি এত দিন বাংলাদেশের বৈধ মুদ্রা হিসেবে চালু ছিল। এই নোট ব্যাংক কিংবা পোস্ট অফিসে জমা দেওয়ার জন্য তিন দিন সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। দ্বিতীয় দফায় ১৯৭৫ সালের এপ্রিল মাসে বাংলাদেশ সরকার ১০০ টাকার নোট অচল ঘোষণা করে। বস্তুত এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল জাল নোট ও কালোটাকা প্রতিহত করার জন্য। বহুল আলোচিত সেই নোট প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তটি এমন সংগোপনে করা হয় যে মন্ত্রী-সাংসদেরাও জানতেন না। এমনকি স্বয়ং রাষ্ট্রপতির পরিবারের কাছে যে ১০০ টাকার নোট ছিল, সেগুলোও অচল হয়ে যায়। দেশের রাষ্ট্রপতি জানলেও তিনি তাঁর পরিবারের কাছেও খবরটা ফাঁস করেননি।
আবার নোট প্রত্যাহারের শান্তিপূর্ণ ঘটনাও ঘটেছে ২০০২ সালে ইউরো প্রবর্তনের সময়। তখন ইইউভুক্ত দেশগুলো তাদের নিজ নিজ মুদ্রা প্রত্যাহার করে নিয়ে ইউরোতে রূপান্তরিত করে দিয়েছিল।
কিন্তু ভারতে নোট বাতিলের সাম্প্রতিক পদক্ষেপে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে চারপাশে। এই সিদ্ধান্ত-পরবর্তী প্রতিক্রিয়া ও ফলাফল নিয়ে দেশে-বিদেশে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে উঠে আসছে নানা মন্তব্য ও বিশ্লেষণ। ভারতীয় পার্লামেন্টে এই একটি বিষয় নিয়ে প্রায় অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে। সাহসী এই সিদ্ধান্তের পেছনের কারণ হিসেবে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে ভাষণের মাধ্যমে জানিয়েছেন যে কালোটাকা, দুর্নীতি ও জাল নোট রোধে এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে নোট বাতিলের ঘোষণাও নজিরবিহীন। ৫০ দিনের বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে বাতিল করা নোট ব্যাংকে গিয়ে বদলে নেওয়ার পদ্ধতিতে রাখা হয়েছে কিছু জটিল প্রক্রিয়া, যেমন ঊর্ধ্বসীমা বেঁধে দেওয়া, নোট বদলাতে গেলে পরিচিতি কার্ড প্রদর্শন, কিংবা সর্বমোট ২ লাখ ৫০ হাজারের বেশি পরিমাণ রুপি বদলানোর জন্য বাধ্যতামূলকভাবে আয়ের উৎস ও আয়কর সূত্র উল্লেখ করা ইত্যাদি। আয়কর দেওয়ার প্রমাণ দিতে না পারলে রাখা হয়েছে আরোপযোগ্য করের ২০০ শতাংশ জরিমানা আদায় করার বিধান।
এসব পদক্ষেপ প্রকৃত টার্গেট গ্রুপ তথা আয়কর খেলাপি কিংবা অবৈধ অর্থ অর্জনকারীদের ধরার জন্য হলেও সাধারণ মানুষের ভোগান্তি হচ্ছে সীমাহীন। কারণ, অন্যান্য মূল্যমানের নোট চালু থাকলেও এই দুই নোটের মাধ্যমে ভারতের মোট মুদ্রা সরবরাহের ৮৬ শতাংশ আবর্তিত হয়। অর্থাৎ মানুষের হাতে থাকা মুদ্রার এক বিশাল অংশ রাতারাতি অচল হয়ে গেছে। নানা বিশ্লেষণের মাধ্যমে সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনায় লিপ্ত হয়েছেন ভারতীয় অর্থনীতিবিদেরা।
সাধারণত দেশে দেশে ব্যাংক নোট বাতিলের বা প্রত্যাহার করে নেওয়ার বহু কারণ থাকতে পারে, যেমন মুদ্রাস্ফীতি দমন করা, দুর্নীতিলব্ধ অর্থ আটক করা, কালোটাকা উচ্ছেদ করা, নতুন নোট চালু করা ইত্যাদি। তবে কারণ যা-ই হোক না কেন, তার প্রভাবও দেশ ও অর্থনীতিভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়। যেমন ভারতে এবারের পদক্ষেপের পেছনে বাড়তি কারণ ছিল সীমান্তের ওপারের জঙ্গিদের হাতে থাকা জাল নোটসহ ভারতীয় মুদ্রার কার্যকারিতা বিকল করা। ব্রিটিশ ভারতে ১৯৪৬ সালে একবার ১ হাজার এবং ১০ হাজার রুপির নোট বাতিল করা হয়েছিল। তারপর ১৯৭৮ সালে আরেকবার তুলে নেওয়া হয় ১ হাজার, ৫ হাজার ও ১০ হাজার রুপির নোট। এই নজির উল্লেখ করে ভারতীয় অর্থনীতিবিদ প্রভাত পটনায়েক মন্তব্য করেছেন যে অতীতের কোনোবারই এ কারণে সাধারণ মানুষের কোনো সমস্যা হয়নি, কারণ তাঁর ভাষায়, ‘এমন দামি নোট তাঁরা চোখেও দেখেননি, আর হাতে রাখার তো কথাই নেই।’ তিনি ১৯৪৬ সালের নোট বাতিলের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, ‘এর চেয়ে সাম্রাজ্যবাদী সরকারও সাধারণ মানুষের দুর্দশা যাতে না হয়, সেদিকে নজর রেখেছিল। সাধারণ মানুষ ব্যবহার করেন এমন নোট বাতিল না করে তারা বাতিল করেছিল বিপুল ধনীদের ব্যবহার করা নোট।’
নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন আরও কঠোর ভাষায় এই সিদ্ধান্তকে স্বৈরতান্ত্রিক পদক্ষেপ হিসেবে উল্লেখ করে এটিকে বিশ্বাসভঙ্গের শামিল বলে মন্তব্য করেছেন। তবে তাঁর আক্রমণটা ভিন্ন দিকে। তিনি বলেন, কোনো সরকার যদি নোটে প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা প্রত্যাহার করে, তাহলে তা স্বৈরতান্ত্রিক পদক্ষেপ হিসেবেই গণ্য হবে। বলাবাহুল্য, তিনি ভারতীয় ব্যাংক নোটের ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের স্বাক্ষর-সংবলিত প্রতিশ্রুতির দিকে ইঙ্গিত করে এ কথা বলেছেন। যেমন ৫০০ রুপির ব্যাংক নোটের ওপর লেখা থাকে ‘আই প্রমিজ টু পে দ্য বেয়ারার দ্য সাম অব ফাইভ হান্ড্রেড রুপিজ,’ যার অর্থ: এই নোট একটি বৈধ মুদ্রা, এটির বাহককে ৫০০ রুপির সমপরিমাণ অন্য মূল্যমানের নোট দিতে বাধ্য থাকব। বাংলাদেশের নোটের ওপরও গভর্নরের সইয়ের ওপর যেমন লেখা থাকে ‘বাংলাদেশ ব্যাংক চাহিবামাত্র ইহার বাহককে ৫০০ টাকা দিতে বাধ্য থাকিবে।’ অমর্ত্য সেনের মতে, অন্য মানের নোটে বিনিময় মূল্য দেওয়ার প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও সেটি করা না হলে তা হয় বিশ্বাসভঙ্গেরই নামান্তর।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ এবং ভারত সরকারের একসময়ের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা কৌশিক বসুর মতে, নোট বাতিলের ফলে দুর্নীতির কার্যক্রম সাময়িক ধাক্কা খাবে বটে, তবে অর্থনীতিতে বিপর্যয় নেমে আসবে। তিনি মনে করেন, যাঁদের আঘাত করা এই সিদ্ধান্তের লক্ষ্য নয়, তাঁরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন সবচেয়ে বেশি। নিউইয়র্ক টাইমস-এ লেখা নিবন্ধে তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ও দরিদ্রদের ওপরেই বিপর্যয় নেমে এসেছে এবং সবচেয়ে খারাপ সময় এখনো আসেনি। তিনি মনে করেন, চাষিরা এবং ছোটখাটো জিনিস যাঁরা তৈরি করেন, তাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এর প্রভাব গোটা অর্থনীতিতেই ছড়িয়ে পড়বে। তাঁর আশঙ্কা, ভারতের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়তে পারে।
ভারতের অর্থনীতির আকার বিশাল, নগদনির্ভর লেনদেনও ব্যাপক, সে কারণে মোট মুদ্রার ৮৬ শতাংশ নোট রাতারাতি অচল হয়ে পড়লে তার প্রতিক্রিয়াও হবে গভীর। এই সিদ্ধান্তের পক্ষে-বিপক্ষে বহু যুক্তি দেখানো সম্ভব, কিন্তু সরকারের যে মূল উদ্দেশ্য কালোটাকা উৎপাটন, সেটি আংশিক সফল হতে পারে মাত্র, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে তার কোনো সুফল পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। প্রথমত, এ কথা সবারই জানা আছে যে প্রকৃত কালোটাকার মালিকেরা নগদ টাকায় তা রাখেন না, জমিজমা, সোনাদানায় রূপান্তরিত করেই রাখেন। তারপরও স্বল্প মেয়াদে কালোটাকা নগদে ঘরে রাখা হয়। সে কারণেই ভারতের আয়কর বিভাগ মাঝে মাঝে আচমকা সন্দেহভাজন কারও বাড়ি তল্লাশি করে। এবারের নোট বাতিলের পরও সর্বশেষ এ রকম অভিযানে এক হুন্ডি ব্যবসায়ীর বাড়িতে পাওয়া গেছে ৩২ কেজি সোনা ও সাড়ে ৬ কোটি রুপি। দ্বিতীয়ত, নতুন নোট চালু হওয়ার পর সবকিছু ধুয়েমুছে পরিষ্কার হয়ে যাবে, এমনটি ভাবার কোনো অবকাশ নেই। আবার যাঁরা ব্যাংকে অচল নোট দিতে ভয় পাচ্ছেন, তাঁদের অনেকেই আলামত ধ্বংস করার জন্য গোপন সঞ্চয়ের সেসব নোট ধ্বংস করে ফেলছেন। পরিত্যক্ত অবস্থায়ও পাওয়া যাচ্ছে বিপুল অঙ্কের বাতিল নোট। এতত্সত্ত্বেও ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংকে জমা পড়া অচল ঘোষিত ১ হাজার ৫০০ কোটি নোট পোড়াতে হবে, সব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে এই মহাযজ্ঞে সময় লাগবে এক বছর।
নোট বাতিলের পক্ষে-বিপক্ষে নানামুখী প্রতিক্রিয়া সত্ত্বেও একটি বিষয় অস্বীকার করার উপায় নেই যে এই সুযোগে নগদ লেনদেনের বিকল্প, কার্ড ও মোবাইল মানি ট্রান্সফার তথা ইলেকট্রনিক লেনদেনের ব্যবহার এবং বাজার দ্রুত বিস্তার লাভ করবে। মাস্টার ও ভিসা কার্ড এ ব্যাপারে বেশ আশাবাদী এবং বাজারটির আরও বড় অংশ দখল করতে প্রস্তুতি নিচ্ছে। নগদের পরিবর্তে ইলেকট্রনিক লেনদেনে ঝুঁকি ও বিপদ যেমন কম, তেমনি আর্থিক লেনদেনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে কর ফাঁকির প্রবণতা রোধ করা যায়। বিভিন্ন আকারের লেনদেনে কিউআর (কুইক রেসপন্স) কোডের মাধ্যমে বিল পরিশোধের ব্যবস্থা দ্রুত ছড়াচ্ছে। অটোরিকশা থেকে শুরু করে রাস্তার পাশের টি স্টল—সবখানেই এটির ব্যবহার সম্ভব এবং সে লক্ষ্যে মাঠে নেমে পড়েছে ডিজিটাল ওয়ালেট সেবাদানকারী কোম্পানিগুলো। লেনদেনের বিকল্প ডিজিটাল পন্থার দ্রুত বিস্তারের মূল চালিকা হিসেবে বড় দুটি নোট প্রত্যাহারের বিষয়টিকে স্বাধীনতা-পরবর্তী ভারতের সবচেয়ে বড় আর্থিক উল্লম্ফন হিসেবে দেখছেন কোনো কোনো বিশ্লেষক। মাস্টারকার্ডের এক কর্মকর্তার মতে, নগদবিহীন ডিজিটাল আন্দোলনের নেতা হওয়ার পথে এটি ভারতের এক ধাপ অগ্রগতি। ভারতের বিরাটসংখ্যক দরিদ্র মানুষ এসব স্মার্টফোন অ্যাপ ব্যবহারের সুযোগ না পেলেও নগদহীন লেনদেনে দেশটির এক ধাপ উত্তরণই হবে এবারের নোট অচল করার দীর্ঘমেয়াদি সুফল।
ফারুক মঈনউদ্দীন: লেখক ও ব্যাংকার৷
[email protected]