রাষ্ট্রপতি কি আসলেই কিছু করতে পারেন

.
.

বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতির স্থান দেশের অন্য সবার ঊর্ধ্বে। দেশের সংবিধানে তাই বলা আছে। আমরা অবশ্য রাষ্ট্রপতিকে খুব একটা দৃশ্যমান দেখি না, তাঁকে নিয়ে তেমন কোনো আলোচনাও হয় না। তবে সম্প্রতি নির্বাচন কমিশন গঠন ইস্যুতে রাষ্ট্রপতি সক্রিয় হওয়ার কারণে তাঁর ক্ষমতা নিয়ে নানান কথাবার্তা-আলোচনা হচ্ছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতা বলছেন, নির্বাচন কমিশন রাষ্ট্রপতি যেভাবে গঠন করবেন সেভাবেই হবে। বিএনপিসহ বিরোধী দল এ বিষয়ে আগ্রহ নিয়ে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপের দিকে তাকিয়ে আছে। এতে মনে হতে পারে বিষয়টি রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাধীন বিষয়, তিনি চাইলেই তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করে দিতে পারবেন। অন্যদিকে সমাজে এমন কথাও আছে যে রাষ্ট্রপতির আসলে কিছুই করার নেই। তাঁকে সংবিধান অনুসারে চলতে হয় প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নিয়ে। কাজেই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তিনি যে আলোচনা করছেন, তা দেখতে যত ভালোই লাগুক, এতে কাজের কাজ কিছুই হবে না।
আসলে কি তাই? তিনিই কি সব নির্ধারণ করতে পারবেন নাকি নির্বাচন কমিশন গঠনের বিষয়ে তাঁর ভূমিকা একদমই গৌণ? বাংলাদেশের সংবিধান এবং সাংবিধানিক রীতিনীতি অনুসারে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা আসলে কতটুকু? বিষয়টি নিয়ে কিছু যৌক্তিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের প্রয়োজন রয়েছে। এটি হলে রাষ্ট্রপতির কাছে আমাদের প্রত্যাশার জায়গাটি সঠিকভাবে অনুধাবন করা যাবে। শুধু নির্বাচন কমিশন গঠনসংক্রান্ত বিষয় নয়, সুশাসন প্রতিষ্ঠা, রাজনৈতিক বিরোধ নিষ্পত্তিসহ আরও বহু ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার পরিধি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে।

২.
বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রপ্রধান, কিন্তু সরকারপ্রধান নন। সংসদীয় সরকারব্যবস্থার এই মডেলটি ভারতের সংবিধানপ্রণেতা আম্বেদকারের ভাষ্য অনুসারে ব্রিটেন থেকে নেওয়া। ব্রিটেনে সব হয় রানির নামে, কিন্তু ক্ষমতা আসলে মন্ত্রিসভার বা সংসদের। ভারতের সংবিধানে রাষ্ট্রপতির অবস্থা অনেকটা এমনই, বাংলাদেশেও অনেকাংশে তাই। কিন্তু ভারতে রাষ্ট্রপতি বা সাংবিধানিক প্রধানের ক্ষমতা নিয়ে আইন আদালতে যেভাবে আলোচনা হয়েছে, ভারতের উচ্চ আদালতে এই ক্ষমতার যে সম্প্রসারিত ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে (যেমন: মধ্যপ্রদেশ স্পেশাল পুলিশ এস্টাবলিশমেন্ট মামলা ২০০৪) বাংলাদেশে তা হয়নি। বাংলাদেশের দু-একটি মামলায় বরং রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাকে আরও সংকীর্ণভাবে দেখা হয়েছে বলে মনে হতে পারে (যেমন: বাংলাদেশ বনাম মো. হাবিবুর রহমান ১৯৭৯)।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির যে ক্ষমতা তা ভারতের রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার চেয়েও কম। কিন্তু তারপরও রাষ্ট্রপতির যে ক্ষমতা রয়েছে তা প্রয়োগ করে বহু কিছু করা সম্ভব। যেমন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির, সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে, বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি কে হবেন, তা নির্ধারণের এবং তাঁকে নিয়োগ করার ক্ষমতা রয়েছে। তিনি সত্যিই এই ক্ষমতা প্রয়োগ করে একজন সুযোগ্য, ব্যক্তিত্ববান এবং স্বাধীনচেতা প্রধান বিচারপতিকে নিয়োগ দিতে পারেন। এমন একজন প্রধান বিচারপতি গোটা বিচার প্রশাসনকে বিশেষ করে উচ্চ আদালতকে সুচারুভাবে পরিচালনা করে দেশে আইনের শাসন ও মানবাধিকার পরিস্থিতির ব্যাপক উন্নয়ন করতে পারেন। এমন একটি বিচারব্যবস্থা এমনকি নির্বাচনের শুদ্ধতা ও সরকারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে। মোট কথা, রাষ্ট্রপতি শুধু নিজের সুবিবেচনাবোধ থেকে একজন আদর্শ প্রধান বিচারপতিকে নিয়োগ দিয়েই বহু অন্যায় নিরসনে সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখতে পারেন।
বাংলাদেশের সংবিধান অনুসারে রাষ্ট্রপতি স্বাধীনভাবে দেশের প্রধানমন্ত্রীও নিয়োগ করেন। সংসদ নির্বাচনে কোনো দল সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হলে আবশ্যিকভাবে সেই দলের নেতাকেই প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করতে হয় বলে রাষ্ট্রপতির এই ক্ষমতাটি আসলে আলংকারিকমাত্র। তবে কোনো দলই সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী না হলে একাধিক দলের জোট থেকে কার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ পাওয়া উচিত, এটি তখন রাষ্ট্রপতিই নির্ধারণ করেন। ১৯৯১ সালের নির্বাচনের পর এমন পরিস্থিতি হয়েছিল। তখন রাষ্ট্রপতিকেই নিজ বিবেচনাবোধ থেকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল।
রাষ্ট্রপতির উপরিউক্ত দুটি ক্ষমতা সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে ৪৮ (৩) অনুচ্ছেদে উল্লিখিত রয়েছে। অন্যদিকে সংবিধানের একই অনুচ্ছেদের ৫ নম্বর পরিচ্ছেদে রাষ্ট্রপতির আরও একটি পরোক্ষ ক্ষমতার উল্লেখ রয়েছে, যা আমরা সচরাচর আলোচনা করি না। সেখানে বলা আছে যে রাষ্ট্রপতি অনুরোধ করলে যেকোনো বিষয় মন্ত্রিসভায় বিবেচনার জন্য প্রধানমন্ত্রী পেশ করবেন। ঠিক এই বিধান অনুসারেই বর্তমান নির্বাচন কমিশনসংক্রান্ত বিষয়ে রাষ্ট্রপতির ভূমিকা পালনের অবকাশ রয়েছে বলে আমি মনে করি।

>রাষ্ট্রপতি যদি আগামী নির্বাচন কমিশন বা এ-সংক্রান্ত সার্চ কমিটি কীভাবে গঠিত হবে, সে সম্পর্কে কোনো মতামত প্রদান করতে চান, তিনি তা সুস্পষ্টভাবে লিখিত আকারে তাঁর দপ্তর থেকে জাতিকে জানিয়ে দিতে পারেন

রাষ্ট্রপতি এখন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে আলোচনা করছেন। আলোচনা সমাপ্ত হলে তাঁর পক্ষ থেকে যে বিষয়গুলো যৌক্তিক মনে হয়, সেগুলো উল্লেখ করে তা অনুসারে একটি নির্বাচন কমিশন গঠনের বিষয়টি তিনি মন্ত্রিসভায় আলোচনা করার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে বলতে পারেন। বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশন গঠনসংক্রান্ত একটি খসড়া আইন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার শামসুল হুদার নেতৃত্বে করা হয়েছিল। তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এই আইনটি ঠিক কী রকম হওয়া উচিত তার উল্লেখ করে বিষয়টি আলোচনার জন্যও প্রধানমন্ত্রীকে বলতে পারেন।

৩.
বাংলাদেশের সংবিধান অনুসারে প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে কী পরামর্শ দেন, তা নিয়ে এমনকি আদালতেও কোনো প্রশ্ন তোলা যাবে না। এই সুযোগে আমরা রাজনৈতিক মহলকে বহু কিছু রাষ্ট্রপতির নামে চাপিয়ে দিতে দেখি। যেমন অপরাধীদের ক্ষমা বা মার্জনা করার যে ক্ষমতা সংবিধানে রাষ্ট্রপতিকে দেওয়া আছে, সেটি আসলে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে তাঁকে প্রয়োগ করতে হয়। ইতিপূর্বে বিভিন্ন আমলে কয়েকজন কুখ্যাত খুনিকে এমন মার্জনা করা হলেও আমরা জানতে পারিনি কী বিবেচনায় এমন পরামর্শ প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে প্রদান করেছিলেন। আমরা বরং এই দায় রাষ্ট্রপতির ওপর চাপানোর প্রচেষ্টাও কোনো কোনো আলোচনায় লক্ষ করেছিলাম।
নির্বাচন কমিশন গঠন বিষয়ে এ সমস্যার নিরসন সম্ভব। নির্বাচন কমিশন গঠনের বিষয়ে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান ঠিক কী চেয়েছিলেন, তা আগেই সবাইকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল।(বিস্তারিত জানতে দেখুন ‘অনুসন্ধান কমিটি হোক গ্রহণযোগ্য’, বদিউল আলম মজুমদার, ২ অক্টোবর, ২০১৬, প্রথম আলো) ফলে তিনি যেভাবে এবং যাঁদের নিয়ে সার্চ কমিটি গঠন করতে বলেছিলেন, সরকার কর্তৃক প্রণীত গেজেট বিজ্ঞপ্তিতে তা যে শতভাগ অনুসরণ করা হয়নি, এটি সবাই বুঝতে পেরেছিলেন।
এই অবস্থা এবারও হতে পারে। রাষ্ট্রপতি যদি আগামী নির্বাচন কমিশন বা এ-সংক্রান্ত সার্চ কমিটি কীভাবে গঠিত হবে, সে সম্পর্কে কোনো মতামত প্রদান করতে চান, তিনি তা সুস্পষ্টভাবে লিখিত আকারে তাঁর দপ্তর থেকে জাতিকে জানিয়ে দিতে পারেন। সংবিধান বা কোনো আইনে এটি বারিত নয়। সুস্পষ্টভাবে আগেই এটি জানিয়ে দিলে এবং সেই মোতাবেক মন্ত্রিসভায় এটি আলোচিত হওয়ার অনুরোধ করলে এর কোনো বিচ্যুতি ঘটানো নৈতিকভাবে হলেও দুষ্কর হয়ে পড়ে।
রাষ্ট্রপতির নির্দেশ তাই বলে প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রিসভা মানতে বাধ্য নয়। হতে পারে তাঁর পরামর্শের বিচ্যুতি ঘটিয়েই সরকার নির্বাচন কমিশন বা এটি গঠনের জন্য সার্চ কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্রপতি আগেই তাঁর মতামত জাতিকে জানিয়ে দিলে এই বিচ্যুতির কোনো দায় আর তাঁর ওপর চাপিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে না।

৪.
এই আলোচনায় এটিও দেখার বিষয় যে রাষ্ট্রপতি কোনো কারণে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শকে অগ্রাহ্য করতে পারেন কি না। আমাদের সংবিধান অনুসারে তিনি এটি পারেন না। তিনি যদি তবু তা করেন তাহলে তাঁকে অভিশংসন করে রাষ্ট্রপতি পদ থেকে বাদ দিয়ে দেওয়াও সম্ভব শাসক দলের পক্ষে। কিন্তু আশ্চর্য হলেও সত্যি আমরা সংসদীয় গণতন্ত্রের যুগেও অন্তত একবার রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অগ্রাহ্য করতে দেখেছিলাম। ১৯৯৮ সালে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের যে তালিকা পাঠানো হয়েছিল, তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ তা কিছুটা পরিবর্তন করে দিয়েছিলেন। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন হয়েছিলেন আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা। মূলত তাঁর অসাধারণ উদ্যোগ ও ইচ্ছাতেই সাহাবুদ্দীন আহমদ সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক একজন ব্যক্তি হয়েও আওয়ামী লীগ সরকারের রাষ্ট্রপতি হতে পেরেছিলেন। তারপরও সাহাবুদ্দীন আহমদ নিজ বিচার-বিবেচনা প্রয়োগ করে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ আংশিকভাবে অগ্রাহ্য করেছিলেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এটি নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য না করে আরেকটি অসাধারণ ঘটনার জন্ম দেন।
বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতির স্বাধীন বিচার-বিবেচনাবোধের প্রতি রাজনীতিবিদদের সহিষ্ণুতার শেষ এখানেই। এরপর নির্বাচন কমিশনের প্রণীত নির্বাচনী আইন সই করার কারণে রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ আওয়ামী লীগ কর্তৃক তিরস্কৃত হয়েছেন, বদরুদ্দোজা চৌধুরী প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কবরে ফুল না দিতে যাওয়ার কারণ হিসেবে রাষ্ট্রপতিত্ব হারিয়েছেন এবং নানান হেনস্তার শিকার হয়েছেন।
আমরা মনে করি, সরাসরিভাবে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অগ্রাহ্য করা রাষ্ট্রপতির পক্ষে সাংবিধানিক তো নয়ই, সমীচীনও নয়। তবে তিনি যেকোনো বিষয়ে প্রকাশ্যভাবে তাঁর মতামত আগেই জানিয়ে দিলে তা বিবেচনায় নেওয়ার আবশ্যকতা তৈরি করতে পারেন। নির্বাচন কমিশন গঠনের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রস্তাবে যৌক্তিক কিছু দেখলে এটি করার সুযোগ তাঁর রয়েছে। আমরা আশা করব, প্রয়োজনে তিনি তা করবেন। আগামী নির্বাচন কমিশনের ওপর বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা তৈরি করতে হলে এটি করা জরুরি।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।