প্রাতরাশের টেবিলে আওয়ামী লীগের রাজনীতি

চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর বাসভবনে প্রাতরাশের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে এসেছিলেন ওবায়দুল কাদের। দলের একটি নগর শাখার সভাপতির বাসায় কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক এলে রাজনীতির নানা প্রসঙ্গ উঠবে, এটা অবধারিত। কিন্তু এই সাক্ষাৎ যে শুধু হালের রাজনীতির গল্পগুজবের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না, এ রকম ধারণা পাওয়া গিয়েছিল এতে নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সিটি করপোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন, নগর ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং বেশ কজন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তার উপস্থিতির কারণে। অনুমান করি, ওবায়দুল কাদেরের আগ্রহেই তাঁদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল।

সাম্প্রতিক বিএমএ নির্বাচনে চট্টগ্রামে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) দুটি প্যানেল দেওয়া এবং পৃথক দুটি প্যানেলের প্রতি মহিউদ্দিন ও নাছিরের প্রকাশ্য সমর্থন ঘোষণার কারণে দুই নেতার মধ্যে মতবিরোধের ব্যাপারটি জনসমক্ষে এসেছে এবং খবরটি এখনো তাজা। অবশ্য একটি বিষয় তো নয়, চট্টগ্রামের এই দুই নেতার বিরোধের ইতিহাস দীর্ঘ এবং এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে ছাত্রলীগ ও যুবলীগসহ অঙ্গসংগঠনগুলোও। এসব সংগঠন ভ্রাতৃঘাতী সংঘর্ষে জড়িয়ে সংবাদের শিরোনাম হয়েছে বারবার।
প্রাতরাশের টেবিলে এ বিষয়গুলো মীমাংসার চেষ্টা করেছেন ওবায়দুল কাদের। অবশ্য প্রথম উদ্যোগেই বিরোধ নিরসন করা যাবে, এতটা আশাবাদী নিশ্চয় এই অভিজ্ঞ রাজনীতিক ছিলেন না। তবু ‘বরফ-ভাঙার’ প্রাথমিক প্রয়াস হিসেবে হয়তো নাশতার টেবিলটাকে বেছে নিয়েছেন তিনি।
দলের হাইকমান্ডের নির্দেশে যে বাঘে-মোষে এক ঘাটে পানি খায়, এর সাম্প্রতিক উদাহরণ নারায়ণগঞ্জ। সেই উদাহরণ থেকে উৎসাহিত হয়ে সম্ভবত চট্টগ্রামের দুই নেতার উদ্দেশে কাদের বলেছেন, ‘আপনারা নিজেরা যদি কাদা ছোড়াছুড়ি করেন কেমন লাগে? কোনো সমস্যা থাকলে সরাসরি আমাকে জানাবেন। আমি সমাধান করতে পারব। আমি পারব না মনে করলে নেত্রীকে জানাবেন। কিন্তু নিজেরা কাদা ছোড়াছুড়ি করবেন না।’
প্রত্যক্ষদর্শী ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, এ সময় ওবায়দুল কাদেরের দুই পাশে মহিউদ্দিন ও নাছির নিশ্চুপ ছিলেন। নীরবতা সম্মতির লক্ষণ মনে হতে পারে। তবে ‘কাদা ছোড়াছুড়ি’ না হলেও পরস্পরের প্রতি বাক্যবাণ নিক্ষেপ যে বন্ধ হয়নি তার প্রমাণ পাওয়া গেল প্রাতরাশ রাজনীতির মাত্র এক দিন পরই। স্বাচিপের একাংশের সভায় বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে আপস করে স্বাচিপের একাংশ নির্বাচনে জয়লাভ করেছে মন্তব্য করে মহিউদ্দিন চৌধুরী বলেছেন, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে লুটেপুটে খাচ্ছে। সেখানে যারা দুর্নীতি করছে, তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে... ইত্যাদি। ‘সেখানে যারা দুর্নীতি করছে’ বলে মহিউদ্দিন কাদের ইঙ্গিত করেছেন, সেটা তো বোঝাই যায়।

>আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে ক্ষমতাসীন দলটির অনৈক্য ও কোন্দল দূর হলে নগরের সাধারণ মানুষ, শিক্ষাঙ্গনের শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ অনেকেই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলবেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই

মহিউদ্দিন চৌধুরীর বাসভবন থেকে বৈঠক শেষে বেরিয়ে আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগের মধ্যে গ্যাপ নেই, যেগুলো আছে, সেগুলো চিন্তার ভিন্নতা।’ একই দলের রাজনীতি করেও চিন্তার ভিন্নতা থাকতে পারে। কিন্তু সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের মধ্যে সন্দেহ-অবিশ্বাস যে আছে এবং সেই দ্বন্দ্ব মাঠপর্যায়েও বিস্তৃত—এ কথা কি অস্বীকার করতে পারবেন নাছির?
কিছুদিন আগে মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের এক নেতার হাতে একজন সাংবাদিক লাঞ্ছিত হলে সাংবাদিকেরা দল থেকে সেই ছাত্রের বহিষ্কার দাবি করেছিলেন নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের কাছে। আ জ ম নাছির উদ্দীন নিজে প্রেসক্লাবে এসে সাংবাদিকদের কাছে এ ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু ছাত্রলীগ নেতার বহিষ্কার প্রসঙ্গে জনান্তিকে বলেছেন, ‘আমি বহিষ্কার করলে তো অন্য পক্ষ টেনে নেবে।’
এভাবেই দলের শীর্ষ নেতাদের বিরোধ-বিভক্তির সুযোগ নিচ্ছে ছাত্র নামধারী দুর্বৃত্তরা। এতে ক্ষমতাসীন দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। প্রাতরাশ বৈঠকে উপস্থিত একজন পুলিশ কর্মকর্তা তো সরাসরি বলেছেন, ‘প্রতি মাসে একটা দুইটা ঘটনা ঘটাতে না পারলে মনে হয় ছাত্রলীগের ভাত হজম হয় না।’ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, বিশেষত সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের তৎপরতার দিকে চোখ রাখলে পুলিশ কর্মকর্তার এই বক্তব্য কতটা তিক্ত-অভিজ্ঞতাজাত উচ্চারণ, তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। ছাত্রলীগ নেতা দিয়াজের মৃত্যুর ঘটনাটি হত্যা না আত্মহত্যা, তা যতই ‘কনফিউজিং’ বলে উল্লেখ করা হোক না কেন, এর পেছনে ছাত্রলীগের অন্তর্দলীয় কোন্দল এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ৯৫ কোটি টাকার দরপত্র নিয়ে গোলযোগ যে একটা অনুষঙ্গ হিসেবে কাজ করেছে, তাতে খুব বেশি সন্দেহের অবকাশ আছে বলে মনে হয় না।
নাশতার টেবিলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকেও একহাত নিয়েছেন ওবায়দুল কাদের। একটি দলের সাধারণ সম্পাদক হয়েও বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যকে প্রশাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে ‘নন পার্টিজান’ হওয়ার উপদেশ দিতে হলো তাঁকে। তিনি বলেছেন, ‘রাজনৈতিক দল বা আদর্শের প্রতি আপনার সমর্থন থাকতে পারে। সেটা অন্যায় কিছু নয়, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় চালাতে গেলে তো আপনাকে নন পার্টিজান হতে হবে।’ কাদেরের এই মন্তব্য যে ‘মোর ক্যাথলিক দ্যান দি পোপ’ না হওয়ার পরামর্শ, সেটা নিশ্চয় উপাচার্য মহোদয় অনুধাবন করবেন।
প্রাতরাশের টেবিলে সেদিন প্রায় দেড় ঘণ্টার রাজনৈতিক আলোচনাকে ওবায়দুল কাদের যে মোটেই হালকাভাবে নেননি, তা বেশ বোঝা গেল। ওই বৈঠক থেকেই দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন তিনি। সাংগঠনিক সম্পাদক এনামুল হক শামীমকে নিয়ে চট্টগ্রাম সফর করে অন্তর্দলীয় সমস্যা সমাধানের নির্দেশনা দিয়েছেন হানিফকে। কোন্দল মিটিয়ে না নিলে প্রশাসনিক ও সাংগঠনিকভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও স্থানীয় নেতাদের সতর্ক করে গেছেন ওবায়দুল কাদের।
মহিউদ্দিন চৌধুরীর বাসভবনে সেদিন নাশতা কতটা সুস্বাদু হয়েছিল জানি না, কিন্তু বিবদমান স্থানীয় নেতাদের কাছে যে তা উপাদেয় হয়নি, বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
প্রাতরাশ টেবিলের এই রাজনীতি চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনগুলোর জন্য কতটা ফলপ্রসূ হবে, এখনই বলার সময় হয়নি। তবে অন্তত আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে ক্ষমতাসীন দলটির অনৈক্য ও কোন্দল দূর হলে নগরের সাধারণ মানুষ, শিক্ষাঙ্গনের শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ অনেকেই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলবেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কেননা ক্ষমতাসীনদের দলীয় কোন্দলের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ভোগ করতে হয় সাধারণ নাগরিকদেরও।
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
[email protected]