কাদের মোল্লা, পাকিস্তান ও তালেবান

কাদের মোল্লা, পাকিস্তান ও তালেবান
কাদের মোল্লা, পাকিস্তান ও তালেবান

গণজাগরণ মঞ্চের বিক্ষোভকারীরা পাকিস্তান হাইকমিশনের কাছে যাওয়ার অনেক আগেই পুলিশ তাঁদের আটকে দিয়েছে। ভদ্রভাবে নয়, ‘বর্বরভাবে’ বলপ্রয়োগ করে। পুলিশের লাঠিপেটার শিকার নাগরিকদের খুবই মনে হতে পারে যে এই পুলিশ বুঝি স্বাধীন বাংলাদেশের পুলিশ নয়, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ সরকারের নিয়ন্ত্রিত পুলিশ বাহিনী নয়। এই পুলিশ যেন পাকিস্তানের পুলিশ। অবশ্য সত্যি বলতে, কূটনৈতিক এলাকার ভেতরে অবস্থিত পাকিস্তান হাইকমিশনের দিকে বিক্ষোভ মিছিল করে যাওয়ার পথে পুলিশ যে আটকাবে, এতে বিস্ময়ের কিছু নেই। পাকিস্তানের কূটনৈতিক মিশনের পরিপূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আমাদের সরকারের দায়িত্ব। পুলিশ বাহিনী সে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বাড়াবাড়ি করেছে—এটাই আপত্তির বিষয়। দুর্ভাগ্যবশত আমাদের পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের কর্তব্যপালনকালে বাড়াবাড়ি না করার প্রশিক্ষণ বা অভিজ্ঞতা নেই।
গণজাগরণ মঞ্চের পক্ষ থেকে দাবি তোলা হয়েছে, পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থগিত করতে হবে। এই দাবিতে বারবার একটি বিদেশি মিশনকে লক্ষ্যবস্তু করার থেকে অধিকতর সমীচীন হবে যদি বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে লক্ষ্যবস্তু করা হয়। কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থগিত বা ছিন্ন করার দাবি তো পাকিস্তানের কাছে নয়, সে সিদ্ধান্ত নিতে হবে বাংলাদেশ সরকারকে। তাহলে চাপটা কেন বাংলাদেশ সরকারকে লক্ষ্য করেই প্রয়োগ করা হবে না?
তবে তার আগে ভেবে দেখা দরকার, পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থগিত করলে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ও ব্যবসা-বাণিজ্যে আমরা কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারি। আমাদের নৈতিক অবস্থান ও জাতীয় অভিমানের খাতিরে সেই ক্ষতি মেনে নেওয়া বা স্বীকার করাই যথাযথ হবে কি না। দেশে দেশে কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে ও টিকে থাকে ভাবাবেগের ভিত্তিতে নয়, বাস্তবিক প্রয়োজনে। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার আগের দিন পর্যন্ত যে পাকিস্তান বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেনি, সেই পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন ও অব্যাহত রাখার পেছনে ভাবাবেগের প্রশ্ন নেই। থাকলে ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের সরকার গঠনের পরেই পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যেত।

দুই.
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ পাকিস্তানের কাছে অখণ্ড পাকিস্তান রক্ষার লড়াই। কাদের মোল্লার জন্য পাকিস্তানের এত দরদের কারণ বুঝতে আমাদের কষ্ট হওয়া উচিত নয়। তারা বলছে, কাদের মোল্লাকে আমরা ‘হত্যা’ করেছি পাকিস্তানের প্রতি তাঁর ‘আনুগত্যের’ কারণে। কাদের মোল্লার সব মানবতাবিরোধী অপরাধ তাদের কাছে জায়েজ বলে মনে হয়, কারণ তিনি যা কিছু করেছেন, সবই পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার স্বার্থে করেছেন। পাকিস্তানিরা ও একাত্তরে তাদের সহযোগিতাকারী বাঙালিরা এ দিক থেকে সমান: তারা বুঝতেই পারে না যে পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার চেষ্টা নিয়ে আমাদের কোনো অভিযোগ নেই। সেই চেষ্টা করতে গিয়ে তারা যেভাবে নিরীহ সাধারণ মানুষকে হত্যা করেছে, নারীদের ধর্ষণ করেছে, অর্থাৎ মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত সব অপরাধ করেছে, বাংলাদেশে এখন সেসব অপরাধের বিচার চলছে। কাদের মোল্লা সেই বিচার-প্রক্রিয়ায় আইনানুগভাবে দণ্ডিত হয়েছেন, তাঁর ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে আইনানুগভাবেই।
কিন্তু পাকিস্তান বিষয়টিকে এভাবে দেখতে পায় না, সে দৃষ্টি তার নেই। একাত্তরে নিজেদের কৃতকর্মে তারা যেমন কোনো অন্যায় দেখতে পায় না, তেমনি দেখতে পায় না তাদের এদেশীয় সহযোগীদের কৃতকর্মেও। সে কারণেই তারা কাদের মোল্লার ফাঁসিকে ‘হত্যা’ বা ‘বিচারিক হত্যা’ বলে বর্ণনা করে এর নিন্দা জানিয়েছে। এমনকি পাকিস্তানের ইংরেজি ভাষার সংবাদপত্রগুলোতেও কাদের মোল্লার ফাঁসিকে ‘কিলিং’ বলে বর্ণনা করা হচ্ছে। তাই, যুদ্ধের সব নিয়মকানুনের বাইরে গিয়ে বাঙালি বুদ্ধিজীবী নিধনের সুপরিকল্পিত অভিযানসহ নয় মাস ধরে নিরীহ সাধারণ মানুষের ওপর তারা যে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে, সে জন্য পাকিস্তানিদের মনে অনুশোচনা জাগবে এবং তারা বাংলাদেশের জনগণের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করে ক্ষমা চাইবে—এমন প্রত্যাশা মনে জাগে না।
কিন্তু তাই বলে আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানোর সুযোগ তো আমরা তাদের দিতে পারি না। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়; পাকিস্তান এ নিয়ে বাজে কথা বললে তার মুখ বন্ধ করার ব্যবস্থা নিতে হবে। তুরস্কের মৌলবাদী সরকার মিসরের প্রেসিডেন্ট মুরসিকে পদচ্যুত করার সমালোচনা করলে মিসর সরকার কায়রো থেকে তুর্কি রাষ্ট্রদূতকে বের করে দিয়ে কূটনৈতিক সম্পর্কের অবনমন (ডাউনগ্রেড) করেছে। আমরা সে রকম কিছু করতে চাই না; কিন্তু পাকিস্তান সরকারকে ভালোভাবে বুঝিয়ে দেওয়া দরকার যে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে, বিশেষ করে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার-প্রক্রিয়া নিয়ে তারা যেন বাজে বকা বন্ধ করে।

তিন.
ঢাকার পাকিস্তান হাইকমিশনের দিকে গণজাগরণ মঞ্চের বিক্ষোভ মিছিল যাওয়ার চেষ্টার খবরের সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তান থেকে একটা খবর প্রচার করা হয়েছে যে পাকিস্তানি তালেবান ইসলামাবাদে বাংলাদেশ হাইকমিশনে সন্ত্রাসী হামলা চালানোর হুমকি দিয়েছে। পাকিস্তানের ইংরেজি দৈনিক দ্য নেশন-এ এই খবরটি ছাপা হয় গত বৃহস্পতিবার। দ্য নেশন-এর সূত্রেই ভারত ও বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমগুলো একই খবর প্রচার করেছে। দ্য নেশনের রিপোর্টটিতে লেখা হয়েছে, পত্রিকাটি গত বুধবার ‘নির্ভরযোগ্য সূত্রে’ জানতে পেরেছে যে আবদুল কাদের মোল্লার ‘হত্যার’ প্রেক্ষাপটে তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) ইসলামাবাদে বাংলাদেশ হাইকমিশনে হামলা চালানোর হুমকি দিয়েছে।
নেশনের রিপোর্টটি লেখা হয়েছে বেশ কায়দা করে। প্রতিবেদক লিখেছেন, ‘যদিও পাকিস্তানে বাংলাদেশি মিশনের চারপাশের নিরাপত্তা অনেক গুণ বাড়ানো হয়েছে এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে নতুন করে নিরাপত্তাবিষয়ক নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, তবু আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো বাংলাদেশ মিশনের ওপর একটা সন্ত্রাসী হামলার আশঙ্কা করছে।’ ‘ওয়েল-প্লেসড সোর্সেস’-এর বরাত দিয়ে প্রতিবেদক আরও লিখেছেন, একটি নিরাপত্তা সংস্থাকে উদ্ধৃত করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে, যেখানে ওই নিরাপত্তা সংস্থাটি বলেছে যে আবদুল কাদের মোল্লার ‘হত্যা’র ঘটনায় তালেবান বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে ক্রোধ প্রকাশ করেছে এবং তারা বাংলাদেশ হাইকমিশনে হামলা চালাতে পারে।
খবরটির সত্যতা নিয়ে সংশয় জাগে। তালেবানের হুমকি সাধারণত গোপনীয় কোনো বিষয় নয় যে তা ‘নির্ভরযোগ্য সূত্র’ থেকে সংগ্রহ করতে হয়। পাকিস্তানি তালেবান সাধারণত একজন মুখপাত্রের পক্ষ থেকে ইন্টারনেটে বিবৃতি আকারে হুমকি, হুঁশিয়ারি ইত্যাদি প্রচার করে, যেমনটি তারা সর্বশেষ করেছিল আমেরিকান ড্রোন হামলায় তাদের প্রধান হাকিমুল্লা মেহসুদ নিহত হওয়ার পর। হুমকি তারা প্রকাশ্যেই দেয়, ষড়যন্ত্র করে গোপনে। খবরটা যদি এমন হতো যে তালেবান ইসলামাবাদে বাংলাদেশ হাইকমিশনে হামলা চালানোর ষড়যন্ত্র করছে আর পাকিস্তানের গোয়েন্দারা সেটা জানতে পেরেছে, তাহলে সেটা কিছুটা বিশ্বাসযোগ্য হতে পারত। কিন্তু খবরটি সেভাবে আসেনি। মনে হচ্ছে, পাকিস্তান বাংলাদেশকে ভয় দেখাতে তালেবানকে জড়িয়ে এ রকম বানোয়াট খবর প্রচার করেছে।
কিন্তু তালেবানের হুমকি যদি সত্য হয়? তালেবান যদি সত্যিই বাংলাদেশ হাইকমিশনে সন্ত্রাসী হামলা চালাতে চায়, পাকিস্তানের সরকারের পক্ষে তা ঠেকানো খুব কঠিন হবে। তবে তা থেকে বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামীকে আরও ভালো করে চেনা যাবে। দলটি দাবি করে, তারা নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাসী নির্বাচনমুখী একটি গণতান্ত্রিক দল; আল-কায়েদা, তালেবান কিংবা বাংলাদেশের স্থানীয় ইসলামি জঙ্গিবাদের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। এ রকম দাবি করে তারা বিশেষত আমেরিকার সুদৃষ্টি পাওয়ার চেষ্টা করে। তাদের একজন নেতার জন্য পাকিস্তানি তালেবান যদি বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশনে সন্ত্রাসী হামলা চালায়, তাহলে জামায়াতের এসব দাবির অসারতা প্রমাণিত হবে। আন্তর্জাতিক ইসলামি জঙ্গিবাদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
মশিউল আলম: সাংবাদিক।