দিন কয়েক আগে এক সামাজিক অনুষ্ঠানে কথা হচ্ছিল ২০১৬ সালের আলোচিত ঘটনাবলি নিয়ে। এক সাংবাদিক বন্ধু জিজ্ঞেস করলেন, বিদায়ী বছরের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা কী? একজন বললেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প। পাশ থেকে আরেকজন ফোঁড়ন কাটলেন, বাংলাদেশের ডোনাল্ড ট্রাম্প কে? তৃতীয়জনের ত্বরিত জবাব, বাংলাদেশে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সম্ভাবনা আপাতত নেই। ২০১৯ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তখন দেখা যাবে, ‘ডোনাল্ড ট্রাম্প’ আসবেন, না ‘হিলারি ক্লিনটন’ থাকবেন।
বাংলাদেশে নানা ঘটন-অঘটনে কেটে গেছে ২০১৬। বছরের শুরুতে ঘটে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনা, আর বছরটি শেষ হলো জঙ্গি আস্তানায় পুলিশের অভিযানের মধ্য দিয়ে। এ বছরই কুমিল্লায় সেনানিবাসের ভেতরে কলেজছাত্রী ও নাট্যকর্মী সোহাগী জাহান তনু ও চট্টগ্রামে এসপিপত্নী মাহমুদা খানম মিতু হত্যাকাণ্ড দেশব্যাপী আলোড়ন তুললেও অপরাধীদের চিহ্নিত করা যায়নি।
রাজনীতির দিকে তাকালে দেখব, দেশের বৃহৎ দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির জাতীয় সম্মেলন হয়েছে এ বছরেই। ২০১৩ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং ২০১৪ সালে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের পর গেল সেপ্টেম্বরে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সফরটি যেমন বাংলাদেশের কূটনৈতিক সাফল্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তেমনি এই ঘটনা ভারতের সঙ্গে মধুর সম্পর্কে কিছুটা ছেদ ঘটাতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বিশ্লেষকদের মতে, ২০১৬ সালে সংঘটিত দুটি ঘটনা আমাদের আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে দীর্ঘস্থায়ী নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। একটি হলো হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলা, অপরটি রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন। সুন্দরবনের কাছে রামপালে বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ নিয়ে দেশে সারা বছরই আন্দোলন ও প্রতিবাদ হয়েছে। ইউনেসকোও রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে সুন্দরবনের ব্যাপক ক্ষতি হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছে। কিন্তু সরকার সব পক্ষের প্রতিবাদ ও আপত্তি উপেক্ষা করে রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। আন্দোলনকারীদের কেউ বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের বিরোধী নন, তাঁরা বলছেন সুন্দরবনের কাছে না করে অন্য কোথাও করা হোক। তেল-গ্যাস–খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ–বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি বলেছে, সরকার প্রকল্প বাতিল না করলে আগামী ২৬ জানুয়ারি অর্ধদিবস হরতাল পালন করবে। সেটাই হবে সম্ভবত নতুন বছরের প্রথম হরতাল।
বাংলাদেশে জঙ্গি হামলার ঘটনা আগেও ঘটেছে। বলা যায় গত দেড় দশক ধরেই আমরা জঙ্গি ছায়ার নিচে আছি। সাম্প্রতিক বৈশ্বিক রাজনীতি, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে বিশ্বমোড়লদের দ্বৈত ও আগ্রাসী নীতি পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে। কিন্তু ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজানে ‘হোম গ্রোন’ জঙ্গিগোষ্ঠী যে নৃশংসতা দেখিয়েছে, তা নজিরবিহীন। তারা সেখানে ২২ জন নিরীহ ও নিরপরাধ মানুষকে শুধু হত্যাই করেনি, বাংলাদেশ রাষ্ট্র, সমাজ, সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রতিও চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। আগের জঙ্গি হামলার সঙ্গে এর পার্থক্য হলো, সেগুলো ছিল গুপ্তহত্যা বা আত্মঘাতী হামলা। এবারই প্রথম প্রকাশ্যে মানুষ জিম্মি করে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। এই জঙ্গিদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসের সম্পর্ক আছে কি নেই, তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো হামলার প্রস্তুতি ও ধরন প্রায় অভিন্ন।
তবে আশার দিক হলো, এই হামলার বিরুদ্ধে গণমানুষের জাগরণ ও প্রতিবাদ। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আমাদের বৈরী ও বিদ্বিষ্ট রাজনীতি সেই জাগরণকে কাজে লাগিয়ে মানবতাবিরোধী জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে পারছে কি না? সরকার বিষয়টি আইনশৃঙ্খলাজনিত সমস্যা হিসেবে নিয়ে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমেই তাদের নির্মূল করতে চাইছে। সেটি যে অসম্ভব, বছর শেষে নতুন নতুন জঙ্গি আস্তানার সন্ধান এবং নারী জঙ্গির আত্মঘাতী হওয়ার প্রবণতা তারই প্রমাণ। জঙ্গিদের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগ করতে হবে ঠিকই, কিন্তু তাদের শক্তি নিঃশেষ করতে হলে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে রাজনৈতিক লড়াইটা জারি রাখতে হবে।
বাংলাদেশে ২০১৬ সালটি অনেক অঘটনের জন্ম দিলেও বছর শেষের দুটি ঘটনা মানুষের মনে কিছুটা হলেও আশা জাগিয়েছে। প্রথমত, নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের আলোচনার উদ্যোগ, যেটি বিরোধী দল বিএনপির দাবি ছিল। যেসব দল ইতিমধ্যে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে দাবিনামা পেশ করেছে, তাদের মধ্যে মৌলিক ফারাক নেই। সবাই চায় জাতীয় নির্বাচনটি অবাধ ও সুষ্ঠু হোক। আর সেটি করতে হলে একটি শক্তিশালী ও স্বাধীন নির্বাচন কমিশন প্রয়োজন। সরকারি দলের নেতাদের মনে কী আছে জানি না, তবে ইদানীং কথাবার্তায় সমঝোতার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, রাষ্ট্রপতি যে সিদ্ধান্ত নেন, তাঁরা মেনে নেবেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, আগামী জাতীয় নির্বাচন নারায়ণগঞ্জের নির্বাচনের মডেলে হবে।
রাষ্ট্রপতির সাংবিধানিক ক্ষমতা যত সীমিতই হোক না কেন, তিনি রাষ্ট্রের অভিভাবক। তাঁর এই উদ্যোগ সফল হলে নির্বাচনকেন্দ্রিক চলমান সমস্যার একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান হতে পারে বলেই সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে। যেকোনো আলোচনায় একাধিক পক্ষ থাকে। এর মধ্যে যদি কোনো পক্ষ এই ধারণা পোষণ করে থাকে যে তাদের দাবি পুরোটা মানতে হবে, তাহলে সেই আলোচনা কখনোই সফল হবে না। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বিএনপির উদ্দেশে বলেছেন, ‘তালগাছটি আমার’ এই মনোভাব ত্যাগ করতে হবে। কিন্তু বিএনপি তো এখন ‘তালগাছটি আমার’ বলার অবস্থায় নেই। ক্ষমতায় আছে আওয়ামী লীগ। তাদেরই তালগাছটি আমার মনোভাব ত্যাগ করে আলোচনায় বসতে হবে। উভয়কে মনে রাখতে হবে, তালগাছের মালিক আসলে আওয়ামী লীগ বা বিএনপি নয়—জনগণ। সেই জনগণের প্রতি ভরসা করলে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
বহুল আলোচিত নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সঙ্গে অন্যান্য নির্বাচনের পার্থক্য হলো, সেখানে সংশ্লিষ্ট সবাই (প্রতিদ্বন্দ্বী দল, প্রার্থী, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী) জনগণের ওপর ভরসা করেছে। কিন্তু নিকট অতীতে ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা ও উপজেলা পরিষদ নির্বাচন কিংবা অতিসম্প্রতি পরোক্ষ ভোটে অনুষ্ঠিত বিরোধী দলবিহীন (সরকারের শরিক জাতীয় পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, ন্যাপও এই নির্বাচনে অংশ নেয়নি) জেলা পরিষদ নির্বাচনও সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ না হওয়ার কারণ জনগণ বা ভোটারের ওপর আস্থা রাখা হয়নি। বিভিন্ন স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচনে যে যথেচ্ছ, টাকার খেলা হয়েছে, তা এখন সরকারি দলের নেতা-মন্ত্রীদের কণ্ঠেই শোনা যাচ্ছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার নেপথ্যেও ছিল বিগত ইউপি নির্বাচনে মনোনয়ন-বাণিজ্য। যেখানে মনোনয়ন নিতে হয় উৎকোচ দিয়ে, সেখানে সুষ্ঠু নির্বাচন আশা করা যায় না।
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কে জয়ী হয়েছেন, তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো নির্বাচনটিকে সবাই নির্বাচন হিসেবেই নিয়েছিলেন। সেভাবেই প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছেন। আগামী নির্বাচনগুলোতে ক্ষমতাসীনেরা যদি এই বিষয়টি মনে রাখেন, তাহলে নির্বাচন নিয়ে যে রাজনৈতিক ক্যাচাল চলে আসছে, তা থেকে বের হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যেতে পারে। আর যদি ভোটারদের ওপর আস্থা না রেখে আগে থেকে ফলাফল নিজের পক্ষে আনার কোশেশ চলতে থাকে, তাহলে দেশের ভঙ্গুর নির্বাচনী ব্যবস্থাটির প্রতি জনগণ পুরোপুরি অনাস্থা প্রকাশ করবে। তখন নির্বাচন হওয়া না-হওয়ার মধ্যে কোনো পার্থক্য খুঁজে পাবে না তারা।
সাধারণ নাগরিক নয়, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ভোটে অনুষ্ঠিত জেলা পরিষদ নির্বাচনে যে টাকার খেলা হয়েছে, সে কথা অস্বীকার করতে পারেননি খোদ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকও। প্রথম আলোয় গতকাল সহকর্মী আনোয়ার হোসেনের প্রতিবেদন থেকে আমরা জানতে পারি, বিভিন্ন পর্যায়ের স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচনে ৭৪ শতাংশ আসনে জয়ী হয়েছে আওয়ামী লীগ। বিএনপি মাত্র ১১ শতাংশ। অন্যান্য যে ১৫ শতাংশ জয়ী হয়েছে তার মধ্যেও বেশির ভাগ বিদ্রোহী আওয়ামী লীগ। এই তথ্য-উপাত্ত এটাই প্রমাণ করে যে স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচনগুলোতে টাকার খেলা হয়ে থাকলে তার লেনদেনকারী মূলত আওয়ামী লীগ। আর সেসব সংস্থায় নির্বাচিত ব্যক্তিদের মধ্যে ভালো লোকের সংখ্যা বেশি হলে তার কৃতিত্ব যেমন আওয়ামী লীগ দাবি করতে পারে, মন্দ লোক বেশি হলে তার বদনামও তাদের নিতে হবে। স্থানীয় সরকার সংস্থার এই চিত্র আশা না জাগিয়ে বরং উদ্বেগ বাড়িয়ে দেয়। সরকার বা সংস্থা পরিচালনার জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা প্রয়োজন, কিন্তু অতিরিক্ত সংখ্যাগরিষ্ঠতা সব সময়ই বিপদ ডেকে আনে। ১৯৭৩ সালের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ১৯৩টি আসন লাভ, কিংবা ২০০১ সালে বিএনপির দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জয়ী হওয়া এবং ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের তিন-চতুর্থ আসনে জয়ী হওয়া দেশে সুশাসন দিতে পারেনি।
নারায়ণগঞ্জের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের নেতারা বেশ ফুরফুরে মেজাজে আছেন। এই নির্বাচন তাঁরা বেশ আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছেন। কিন্তু এ-ও তো সত্য যে একজন সেলিনা হায়াৎ আইভী ছিলেন বলেই আওয়ামী লীগ নেতারা সেখানে ‘স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু’ নির্বাচন নিয়ে বেশ বড়াই করছেন। কিন্তু জাতীয় সংসদে ৩০০ আসনের জন্য ‘বিপুল জনপ্রিয়’ দলটির ৩০০ দূরের কথা, তিনজন আইভীও আছেন কি না সন্দেহ। তাই বিএনপির অস্তিত্ব সংকট নিয়ে বেশি মাথা না ঘামিয়ে দলের প্রতি নজর দিন। নারায়ণগঞ্জের মতো সারা দেশে পরিচ্ছন্ন প্রার্থী তৈরি করুন। নির্বাচনের দুই বছর আগে থেকে নির্বাচন নিয়ে ক্ষমতাসীন শিবিরে যে উত্তেজনা-উৎকণ্ঠা, তা অনেকটাই প্রশমিত হবে। প্রতিপক্ষকে গালাগাল করে ভোট পাওয়ার দিন সম্ভবত শেষ হয়ে গেছে।
বহুল পরিচিত বাংলা প্রবাদ আছে ‘যায় দিন ভালো, আসে দিন খারাপ।’ আমাদের নেতা–নেত্রীরা অনেক আশার কথা শোনান। কিন্তু তঁারা যদি প্রবাদটি উল্টে দিয়ে ‘আসে দিন ভালো, যায় দিন খারাপ’ নিশ্চিত করতে পারেন, তবেই তাঁদের শতবার অভিবাদন জানাব।
সবাইকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।