টিভি কলাকুশলীদের আন্দোলন: ভ্রান্তি দূর হোক

এক মাসেরও বেশি সময় ধরে গণমাধ্যমে শিল্পী-কলাকুশলীদের বিভিন্ন দাবিদাওয়ার প্রশ্নে ফেডারেশন অব টেলিভিশন প্রফেশনালস অর্গানাইজেশনের (এফটিপিও) আন্দোলন নিয়ে নানা কথা এবং বিশিষ্টজনদের অভিমত লক্ষ করা যাচ্ছে। এসব আলোচনায় একটি কথা বারবার ঘুরেফিরে আসছে যে এফটিপিও দর্শকদের কথা ভাবছে না, একতরফা নিজেদের স্বার্থকে বড় করে দেখছে। আর যাঁরা বিশ্লেষণ করছেন, তাঁদের অনেকের লেখায় তথ্যের বিভ্রাট আছে। কেউ লিখেছেন আন্দোলনের আগে সরকার ও চ্যানেলের মালিকদের সঙ্গে আলোচনায় বসা উচিত ছিল। এফটিপিওর পাঁচটি দাবির মধ্যে একটি দাবি ছিল—ডাউনলিংকের মাধ্যমে বিদেশি চ্যানেলে দেশীয় বিজ্ঞাপন প্রচার বন্ধ করতে হবে। অন্য দাবিগুলো চ্যানেল কর্তৃপক্ষ ও সরকারের কাছে। প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে বিদেশি চ্যানেলে দেশি বিজ্ঞাপনের প্রচার বন্ধ হয়েছে। আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার এফটিপিওর প্রতিনিধি নিয়ে একটি কমিটি গঠনেরও ঘোষণা দেয়।
এখন বাকি দাবিগুলো সম্পর্কে আলোকপাত করা যাক। পৃথিবীর সব দেশেই জাতীয় স্বার্থ এবং সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকে বড় করে দেখা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গ্লোবালাইজেশন ও বাজার অর্থনীতির উদ্যোক্তা। কিন্তু যখন তার বাজার চীন দখল করে ফেলল তখন কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র নিজস্ব বাজার রক্ষায় তৎপর হয়ে উঠল এবং বিদেশি পণ্যের ওপর উচ্চ আমদানি কর নির্ধারণ শুরু করল। রাষ্ট্রীয় এই তৎপরতা সবার চোখে পড়েছে। আমাদের দেশে টিভির ক্ষেত্রে অনুষ্ঠান আমদানির সুস্পষ্ট নীতিমালা থাকলেও তার প্রয়োগ নেই। ১৯৮৮ সালে ও ২০০৬ সালে সরকার দুটি আইন প্রণয়ন করে, যাতে বিদেশ থেকে অনুষ্ঠান আমদানি ও প্রচারের ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট নীতিমালা এবং তা লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান আছে। এসব আইনে সরকারের পক্ষ থেকে নির্দিষ্ট সেন্সর এবং অনুমতির বিষয়ের উল্লেখ আছে। আইনে স্পষ্ট বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মূল্যবোধ, সংস্কৃতি ও জীবনধারাকে আঘাত করে এমন কোনো বিষয় প্রচার করা যাবে না এবং যেকোনো বিদেশি সিরিয়াল/ডাবিং সিরিয়াল গণমাধ্যমে প্রচারের আগে সরকারের সুনির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে এবং নিয়মকানুন মেনে চলতে হবে। বিদেশ থেকে কলাকুশলী-শিল্পী নিয়ে আসার ক্ষেত্রেও ওয়ার্ক পারমিটের নিয়মাবলি মেনে চলতে হবে।
সম্প্রতি বাংলায় ডাবিংকৃত একটি বিদেশি সিরিয়াল জনপ্রিয়তা পেয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন চ্যানেলে এক বা একাধিক ডাবিং সিরিয়াল চালু হয়েছে। সবগুলোই জনপ্রিয় নয়, কিন্তু কীভাবে এই সিরিয়ালগুলো আমদানি হয়েছে তার তথ্য জানা যায়নি। সিরিয়ালগুলো যতটা জানা যায় খুব অল্প মূল্যে কেনা হয় এবং ডাবিং করে তা প্রচার করা হলেও তার খরচ এখানে নির্মিত সিরিয়ালের এক-চতুর্থাংশ। অনুষ্ঠান কেনার ক্ষেত্রে
এই অসম প্রতিযোগিতায় দেশের বিপুলসংখ্যক কলাকুশলীর বেকার হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া সরাসরি ডাউনলিংকের মাধ্যমে যে চ্যানেলগুলো বাংলাদেশে প্রদর্শনী হচ্ছে, তাও এক অসম প্রতিযোগিতার সম্মুখীন। ভারতে আমাদের চ্যানেল দেখতে হলে সরকারকে আট কোটি টাকা ডাউনলিংক ফি দিতে হয় আর ভারতীয় চ্যানেল দেখতে হলে এখানে দেড় লাখ টাকা ফি দিলেই তা সম্ভব হচ্ছে। ফলে আমাদের চ্যানেল ভারতে দেখানো সম্ভব হচ্ছে না। বিপুলসংখ্যক দর্শক থেকে আমরা বঞ্চিত হচ্ছি। সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে বাংলাদেশের চ্যানেল এখনো জনপ্রিয়।

>মিডিয়ার দায়িত্ব কি শুধু অবিশ্বাস বা ঈর্ষার জন্ম দেওয়া, নাকি মানুষের প্রতি বিশ্বাস রাখা, মানবিক মূল্যবোধকে সমুন্নত করা?

আরেকটি সমস্যা হলো আমাদের চ্যানেলগুলোতে রয়েছে অসহনীয় বিজ্ঞাপনের চাপ। দর্শকেরা অনুষ্ঠান দেখতে গিয়ে বিরক্ত হচ্ছেন। বিজ্ঞাপন সহনীয় মাত্রায় চললে আমাদের অনুষ্ঠান আগের জনপ্রিয়তায় ফিরে আসবে। সেই সঙ্গে অনুষ্ঠান নির্মাণের জন্য যে অর্থ দেওয়া হয়, তা দিয়ে মানসম্মত অনুষ্ঠান করা প্রায় অসম্ভব। এর মধ্যে ঢুকে পড়েছে মধ্যস্বত্বভোগী, যাঁরা চ্যানেল ও বিজ্ঞাপনদাতাদের মধ্যে বিপণনের কাজটি করে থাকেন। তাঁরা বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে নির্মাতাদের বঞ্চিত করে বেশি মুনাফা অর্জন করেন।
সবটা মিলিয়ে একটা বিশৃঙ্খলা চলছে বহুদিন ধরেই। অতীতেও একসময়ে ১৭টি ডাবিং সিরিয়াল বাংলাদেশ টেলিভিশনে চালু হয়েছিল। আমাদের দাবির মুখে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা (বর্তমানেও তিনি প্রধানমন্ত্রী) নির্দেশ দিয়ে সেসব বন্ধ করে দেন। মূলত সেই সময় থেকেই আমাদের শিল্পে গতি সঞ্চার হয়। আমাদের পরিষ্কার বক্তব্য, আকাশ সংস্কৃতিতে খিল আটার আন্দোলন এটি নয়। পৃথিবীর তাবৎ মহৎ শিল্প বা অনুষ্ঠান দেখার অধিকার দর্শকদের রয়েছে। বিটিভির কথা বারবার উচ্চারিত হচ্ছে। হ্যাঁ, বিটিভিতে আমরা মহৎ চলচ্চিত্র দেখেছি। উৎকৃষ্ট মানের ঐতিহাসিক সিরিয়াল দেখেছি। বিটিভিতে সব সময় একটি অভ্যন্তরীণ সেন্সর কমিটি আছে, যারা প্রতিনিয়ত অনুষ্ঠানের প্রিভিউ করে। প্রাইভেট চ্যানেলে এই প্রিভিউর নিশ্চয়তা কোথায়! প্রাইভেট চ্যানেল একটা ব্যবসা। তাকে আয় করেই চ্যানেল চালাতে হয়। তবে এই ব্যবসা অন্য ব্যবসার মতো নয়। এতে মানুষের রুচি, মনন ও মূল্যবোধের কথা ভাবতে হয়। কারণ, কোটি কোটি মানুষের তথ্য ও বিনোদনের চাহিদা মেটাতে হয়। এই চাহিদা মেটানোর জন্য নিজের মুনাফার কথা ভেবে নিম্নমানের অনুষ্ঠান দেখানো একেবারেই অনুচিত। ভারতীয় অনেক চ্যানেল মানুষের স্থূল কিছু প্রকৃতি যেমন ঈর্ষা, হিংসা, পরকীয়া—এই সব নিয়ে নাটক নির্মাণ করে থাকে, যা আমাদের দেশে জনপ্রিয়ও হয়েছে। এই জনপ্রিয়তা আমাদের জীবনের গভীরে প্রবেশ করে পারিবারিক বন্ধনকে ভেঙে দিচ্ছে। সমাজে একটা পারস্পরিক অবিশ্বাস গড়ে উঠেছে। মিডিয়ার দায়িত্ব কি শুধু অবিশ্বাস বা ঈর্ষার জন্ম দেওয়া, নাকি মানুষের প্রতি বিশ্বাস রাখা, মানবিক মূল্যবোধকে সমুন্নত করা?
ভারতে প্রতিটি চ্যানেলে এখনো বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়, যেখানে টেলিভিশন নম্বর ও ই-মেইল আইডি দিয়ে বলা হয় যেকোনো অনুষ্ঠানের কোনো আপত্তিকর দৃশ্য বা বক্তব্য থাকলে তা ওই নম্বরে জানালে দেশের রেগুলেটরি কমিশন যথাবিহিত ব্যবস্থা নেবে। আমরা জানতে পেরেছি, সে দেশের ১৩টি টেলিভিশন চ্যানেলের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছিল। আমাদের দেশে এ ব্যবস্থা এখনো হয়নি। বিটিভির কথা আবারও বলতে হয়। বিটিভি চলে অনুষ্ঠান বিভাগের নির্দেশনায় আর অধিকাংশ প্রাইভেট টেলিভিশন চ্যানেল চলে বিপণন বিভাগের নির্দেশনায়, যেখানে ব্যবসাটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়।
এফটিপিও কোনো কর্তৃত্ববাদী প্রতিষ্ঠান নয়, এটি মিডিয়া শিল্পে নিয়োজিত বিভিন্ন সংগঠনের একটি সমন্বিত রূপ। যাঁরা এই বিষয়ে লিখেছেন বা কথা বলেছেন, আমি মনে করি তাঁরাও মিডিয়ার ভালো চান। এই মিডিয়ায় নিয়োজিত শিল্পী-কলাকুশলী, নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান মানে প্রযোজক/প্রডাকশন হাউস—এসব গড়ে উঠেছে ১৯৯৪ সালের পর, মানে বেসরকারি খাতে। টেলিভিশন অনুষ্ঠান শুরু থেকে আজ পর্যন্ত এই শিল্প বিশাল আকার ধারণ করেছে। হাজার হাজার পেশাজীবী নিয়োজিত আছেন এখানে। আমরা চাই এই শিল্প বাঁচুক কিন্তু শিল্পমান বাড়ুক।
তবে আমাদের শিল্পী ও কলাকুশলীদের শিল্পমান বাড়াতে হবে, যার জন্য প্রয়োজনীয় চর্চা ও প্রশিক্ষণ দিতে হবে। সেই সুযোগগুলো সৃষ্টির জন্যই এফটিপিও গঠন করা হয়েছে। এসব করা সম্ভব হবে শিল্পটি সুস্বাস্থ্য নিয়ে বেঁচে থাকলে। আশার কথা হচ্ছে, বিলম্বে হলেও সরকার বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করেছে। আশা করছি দ্রুতই সব সমস্যার সমাধান হবে।
মামুনুর রশীদ: নাট্যব্যক্তিত্ব।