কালের আয়নায় শওকত ওসমান

শওকত ওসমান
শওকত ওসমান

‘কাল মারা গেছে শওকত ওসমান
(ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন) রোববার তেইশে অঘ্রান ইমশাল। ইং...
ডাংগুলির ভাষায় ফিরে গেছে প্যাভিলিয়নে ক্লান্ত ব্যাট কাঁধে
সমস্ত জীবন যা ঘুরিয়েছে অবাধে লেটকাটে পাকা—এবার সত্যি আউট।
মরহুমের বয়স নিয়ে ঝুটমুট গবেষণা। কেউ বলে ত্রিশ, কেউ বাহাত্তর,
কেউ যোগ করে আরও ছিল, ছিল ক্ষুর লেজ অপি—শতাধিক
বয়সের ফল মানতে বাধ্য, বার্ধক্যেও ভীষণ চঞ্চল।
(নিজস্ব সংবাদদাতা প্রেরিত)
মৃত্যুর ২৩ বছর আগে, ১৯৭৫ সালে আগাম শোকস্ত্রোত্র লিখে রেখেছিলেন শওকত ওসমান। বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান লেখক। নিজেকে নিয়ে এ রকম পরিহাস করা শওকত ওসমানের পক্ষেই সম্ভব। লেখক হিসেবে তিনি ছিলেন বিচিত্রমুখী। তিনি উপন্যাস লিখেছেন, ছোটগল্প লিখেছেন, প্রবন্ধ লিখেছেন, এমনকি কবিতাও।
শওকত ওসমানের জন্ম ১৯১৭ সালের ২ জানুয়ারি। বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার সবলসিংহপুর গ্রামে। নিজের গ্রামেই তাঁর প্রাথমিক পাঠ গ্রহণ। ১৯২৯ সালে জুনিয়র মাদ্রাসার শিক্ষা শেষ করে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন। ১৯৩৩ সালে সেখান থেকে ফাজিল পাস করার পর ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হন সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে। অর্থনীতিতে অনার্সসহ স্নাতক ডিগ্রি নিলেও তিনি মাস্টার্স করেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে। লেখাপড়া শেষে তিনি কিছুদিন কলকাতা মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনে চাকরি করেন। পরে পেশা পরিবর্তন করে অধ্যাপনায় ফিরে আসেন। প্রথমে কলকাতায় ইনস্টিটিউট অব কমার্সে যোগ দেন। পরে চট্টগ্রাম সরকারি কমার্স কলেজে। ১৯৫৮ সালে বদলি হয়ে ঢাকা কলেজে এবং ১৯৭২ সালে এ কলেজ থেকেই অবসর নেন। কর্মজীবনের শুরুতে তিনি কিছুদিন কলকাতার একটি স্কুলেও শিক্ষকতা করেছেন। সেখানেই প্রখ্যাত অভিনেতা উত্তমকুমারকে ছাত্র হিসেবে পেয়েছিলেন তিনি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় এবং পঁচাত্তরের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর তিনি ভারতে নির্বাসিত জীবন কাটান। এই যে বারবার পেশা পরিবর্তন, কর্মস্থল পরিবর্তন শওকত ওসমানকে তাঁর সাহিত্যসাধনা থেকে বিরত রাখতে পারেনি। তিনি যেখানে যে অবস্থায়ই থাকুন না কেন প্রায় প্রত্যহ কিছু না কিছু লিখতেন। সতীর্থ ও অনুজদের পরামর্শ দিতেন, দিনে আধঘণ্টার জন্য হলেও লেখার টেবিলে বসতেন। তিনি বেঁচেছিলেন ৮২ বছর। লেখালেখির বয়স ৬০ বছরেরও বেশি। গ্রন্থসংখ্যাও ৮০-র কাছাকাছি।
সাহিত্য তাঁর বড় কীর্তি। কিন্তু তার চেয়েও কম কীর্তিমান ছিল না তাঁর জীবন। যে দেশে তুখোড় বিপ্লবীও পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সে প্রবলভাবে ধর্মচর্চায় আত্মনিয়োগ করেন, সেই দেশে শওকত ওসমান ইহলৌকিকতাকে আমৃত্যু আরাধ্য হিসেবে নিয়েছিলেন। তিনি নিজের সমাজ ও পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। সচেতন ছিলেন তাঁর সম্ভাবনা ও সীমাবদ্ধতা সম্পর্কেও। এ কারণেই শওকত ওসমান যে সমাজের বাসিন্দা, সেই সমাজের সঙ্গেই থেকেছেন। তিনি চেয়েছিলেন বাঙালি মুসলমান সমাজ কুসংস্কার, কূপমণ্ডূকতা থেকে বেরিয়ে আসুক। জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোয় আলোকিত হোক। তিনি ধর্মান্ধতা প্রচণ্ডভাবে অপছন্দ করতেন।
শওকত ওসমান প্রায়ই আক্ষেপ করে বলতেন, ‘আমেরিকানরা যখন রকেটে চড়ে চন্দ্রপৃষ্ঠে পা দিয়েছে, তখনো আমাদের দেশের গরিব রিকশাচালক ভারবাহী পশুর ন্যায় অন্য মানুষকে কাঁধে বয়ে বেড়াচ্ছে। তারপরেও আমাদের চৈতন্যোদয় হলো না।’ ইতালির প্রখ্যাত মার্ক্সবাদী আস্তানিও গ্রাসামির কথা ধার করে বলতেন, ‘পুরাতন মৃত্যুর পথে নতুন প্রচণ্ড প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে জন্মলাভের জন্য কঠিন লড়াইয়ে লিপ্ত। এই ক্রান্তিকালে দেশে নানা কিসিমের রোগ বিকারগ্রস্ত আলামতের প্রাদুর্ভাব ঘটে।’
প্রচলিত অর্থে তিনি ভালো শিক্ষক ছিলেন না, ছাত্রদের কখনো পাঠ্যবইয়ের সবক দেননি। কিংবা তাঁর ভাষা ও বাচনভঙ্গিতে যে অভিনবত্ব ছিল, তা-ও নয়। কিন্তু শওকত ওসমান তাঁর ছাত্রদের মধ্যে জ্ঞানপিপাসা ও জ্ঞানজিজ্ঞাসা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। শ্রেণিকক্ষে এসে পাঠ্যবই টেবিলে রেখে বিশ্বসাহিত্য সম্পর্কে বলতেন। শেক্সপিয়ার, বায়রন, মিলটন, তলস্তয়, গোর্কি, রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের বড়ত্ব ব্যাখ্যা করতেন। তিনি বলতেন, ‘এখন তোমাদের যৌবনকাল, এখনই বিদ্রোহ করার বয়স। এখনই সবকিছু ভেঙে ফেলার ও জয় করার সময়। এ সময়কে পাঠ্যবইয়ের গণ্ডিতে বন্দী রেখো না।’
শওকত ওসমান ক্লাসে পাঠ্যবই পড়ান না বলে একবার ছাত্ররা নালিশ করতে গেলেন সেই সময়ের জাঁদরেল অধ্যক্ষ জালালউদ্দিন আহমদের কাছে। অভিযোগ শুনে তিনি বললেন, শওকত ওসমানকে এই কলেজে রাখা হয়েছে পড়ানোর জন্য নয়। পড়ানোর জন্য অন্য শিক্ষকেরা আছেন। শওকত ওসমান এই কলেজে আছেন—এটাই আমাদের গৌরবের। অথচ এই অধ্যক্ষের সঙ্গে শওকত ওসমানের মত ও পথের কোনো মিল ছিল না। তিনি মুসলিম লীগের সমর্থক ছিলেন। এভাবে মত-পথনির্বিশেষে শওকত ওসমান তাঁর লেখনী, তাঁর বন্ধুতা দিয়ে মানুষের মন জয় করতে পেরেছিলেন। তিতাস গ্যাস ১৯৬৬ সালে ঢাকা শহরে গ্যাস সরবরাহ উদ্বোধন করেছিল তাঁর বাড়ি থেকে।
শওকত ওসমানের গল্প ‘আব্বাস’ প্রথম প্রকাশ পায় স্কুল ম্যাগাজিনে। এক প্রাণ-কাড়ানিয়া গল্প আব্বাস। এতে লেখক শহরে কাজের সন্ধানে যাওয়া গ্রামের একটি অসহায় বালকের বেদনাহত চিত্র তুলে ধরেছেন অনবদ্য ভাষায়। সেই যে শুরু বিরামহীন পথচলা। শওকত ওসমান লিখে চললেন: ওটেন সাহেবের বাংলো, তস্কর ও লস্কর, আমলার মামলা, পিজরাপোল, বনী আদম, জুনু আপা ও অন্যান্য গল্প; জননী, ক্রীতদাসের হাসি, প্রস্তরফলক, সমাগম, চৌরসন্ধি, রাজা উপাখ্যান, জাহান্নাম হইতে বিদায়, দুই সৈনিক, নেকড়ে অরণ্য, ভাবভাষা ভাবনা, পঞ্চসঙ্গী, জন্ম যদি তব বঙ্গে, ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী, নষ্টভান অষ্টভান, মুসলিম মানসের রূপান্তর, পূর্ণ স্বাধীনতা, চূর্ণ স্বাধীনতা ইত্যাদি।
শওকত ওসমান বলতেন, লেখকের ভূমিকা নান্দনিকতার ক্ষেত্রে। কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের লেখকদের মূল অবদান নৈতিকতার জগতে। রূপের কারিগর হয়ে ধূপের ফেরিওয়ালা। শওকত ওসমান ধূপের ফেরিওয়ালা হিসেবে আমাদের আলোকিত করতে চেয়েছেন, তাঁর জন্ম, শৈশব ও বেড়ে ওঠা যে সমাজে, সেই সমাজকে সামনে এগিয়ে নিতে সচেষ্ট হয়েছেন। অনেকে জননীকে শওকত-শ্রেষ্ঠ কীর্তি হিসেবে বিবেচনা করে। কিন্তু আমাদের বিবেচনায় শওকত ওসমানের অতুলনীয় রচনা হলো ক্রীতদাসের হাসি। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র ক্রীতদাস তাতারী যখন উচ্চারণ করেন, ‘শোন, হারুনর রশীদ। দীরহাম দৌলত দিয়ে ক্রীতদাস গোলাম কেনা চলে। বান্দা কেনা সম্ভব। কিন্তু...কিন্তু ক্রীতদাসের হাসি ...না...না...না। কিংবা ক্ষমতা, অর্থ এবং শক্তি বলে মানুষের মুক্ত স্বাধীন চিত্তলোক অধিকার করা যায় না। হাসি মানুষের আত্মারই প্রতিধ্বনি।’ তখন মনে হয় বাংলা ভাষায় এমন করে স্বাধীনতার কথা কেউ বলেননি। অন্তত এ উপন্যাসে। হাবশি গোলাম তাতারীর বুকের ভেতরে গুমরে ওঠা এ কান্না যেন তৎকালীন পূর্ববাংলার শৃঙ্খলিত জনতার বিদ্রোহের পূর্বাভাস।
আমরা স্মরণ করতে পারি, এই উপন্যাস প্রকাশের আট বছরের মধ্যে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। তাঁর জন্মশতবর্ষে গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
[email protected]