সপ্তম বছরে সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলন

রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ সুন্দরবন বিনাশী সব প্রকল্প বাতিলের পক্ষে জনসমর্থন প্রবল
রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ সুন্দরবন বিনাশী সব প্রকল্প বাতিলের পক্ষে জনসমর্থন প্রবল

মহাপ্রাণ সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলন ষষ্ঠ বছর পার করে সপ্তম বছরে পা দিল। ২০১৬ সালে এই আন্দোলন অনেক বিস্তৃত হয়েছে, নতুন অনেক মাত্রা এতে যুক্ত হয়েছে। শুধু দেশে নয়, আন্তর্জাতিকভাবেও সুন্দরবন গভীর উদ্বেগ ও দৃঢ় সংহতি সৃষ্টি করেছে। রামপাল প্রকল্পের পক্ষে প্রচারণার নানা কৌশল, বিজ্ঞাপনী সংস্থা, কনসালট্যান্টসহ ব্যয়বহুল তৎপরতার বিপরীতে তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সংগঠিত আন্দোলন এবং তার সঙ্গে সংহতি জানিয়ে জনগণের বিভিন্ন অংশ থেকে স্বতঃস্ফূর্ত সক্রিয়তা অভূতপূর্ব এক জোয়ার তৈরি করেছে।
রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ সুন্দরবন বিনাশী সব প্রকল্প বাতিলের পক্ষে জনসমর্থন প্রবল। এ বিষয়ে ২০১৬ সালে বিভিন্ন সংবাদপত্রে জনমত জরিপ ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে একাধিক জরিপে ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ এই প্রকল্প বাতিলের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। বাংলাদেশ, ভারত ও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের বহু বিশেষজ্ঞের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি, অনেকের গবেষণা বিশ্লেষণ অধ্যয়ন করেছি। রামপাল প্রকল্পের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে ব্যক্তিস্বার্থে যুক্ত মুষ্টিমেয় কিছু ব্যক্তি বা ‘বিশেষজ্ঞ’ ছাড়া অন্যরা সুন্দরবনকে নিয়ে এই সর্বনাশা আয়োজনের প্রবল বিরোধী। সব বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত একই উপসংহারে এসেছে। একই কারণে ইউনেসকো গত বছর সুন্দরবনের জন্য নিশ্চিত ঝুঁকিপূর্ণ বলে আখ্যায়িত করে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বাতিলের আহ্বান জানিয়েছে।
গত বছরের প্রথম দিকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে জাতীয় কমিটির উদ্যোগে সুন্দরবনমুখী জনযাত্রা (লংমার্চ) অনুষ্ঠিত হয়। এটি সুন্দরবন রক্ষায় জাতীয় কমিটির তৃতীয় লংমার্চ। তার আগের বছর সিপিবি বাসদ ও গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা আরও দুটো জনযাত্রা করেছে। সুন্দরবন জনযাত্রায় এবার দেশের বিভিন্ন অঞ্চল, পেশা ও বয়সের মানুষের পাশাপাশি অংশ নেন ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের কয়েকজন বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী, লেখক, শিক্ষক, সাংবাদিক, শিল্পী ও তথ্যচিত্র নির্মাতা।
বছরের মাঝামাঝি কলকাতায় রামপাল প্রকল্প বাতিলের দাবিতে দুটো সমাবেশ হয়। ২২ জুন ‘সায়েন্স ফর অল’সহ তরুণদের বেশ কয়েকটি সংগঠনের উদ্যোগে এবং ২৩ জুন কয়েকটি পরিবেশবাদী সংগঠনের যৌথ উদ্যোগে আলোচনা সভা ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। তরুণ শিক্ষার্থী, নাট্যকর্মী, বিজ্ঞান আন্দোলন কর্মী, রাজনৈতিক কর্মী ছাড়াও শিক্ষক, বিজ্ঞানী, পরিবেশবিদেরা এতে অংশ নেন। এক সমাবেশে বিজ্ঞানী সৌম্য দত্ত বলেন, ‘ভারতের কোম্পানি এনটিপিসি এই সর্বনাশা প্রকল্প হাতে নিয়েছে, ভারতীয় আরেক কোম্পানি এই কেন্দ্র নির্মাণ করতে যাচ্ছে, ভারতীয় এক্সিম ব্যাংক এই বিষাক্ত প্রকল্পে অর্থ জোগান দিচ্ছে, ভারতীয় কোম্পানি কয়লা জোগান দিতে যাচ্ছে। অতএব ভারতের নাগরিক হিসেবে আমাদের দায়িত্ব বিশ্বসম্পদ সুন্দরবনের ধ্বংস ঠেকাতে সোচ্চার হওয়া, সক্রিয় হওয়া। এই প্রকল্প বাতিল না হলে আরও বিপজ্জনক প্রকল্প দুই দেশকে মহাবিপদের দিকে নিয়ে যাবে।’
২৮ জুলাই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি খোলা চিঠি দেওয়া হয়। চিঠিতে বলা হয়: ‘...আমরা সুই থেকে রকেট—সবই তৈরি করতে পারব কিন্তু এ রকম অসাধারণ জীববৈচিত্র্যে ভরা বিশ্বঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃত সুন্দরবন আরেকটি তৈরি করতে পারব না। এই সুন্দরবন আমাদের বিপুল সম্পদ জোগান দেয়। এই সুন্দরবন লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান করে, জীববৈচিত্র্যের অসাধারণ আধার হিসেবে আমাদের সবার প্রাণ সমৃদ্ধ করে। এই বন প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রাকৃতিক বর্ম হিসেবে উপকূলীয় অঞ্চলের কয়েক কোটি মানুষের প্রধান অবলম্বন। এই বন জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশের টিকে থাকার প্রধান শক্তি। সে জন্যই আমরা বারবার বলি, বিদ্যুৎ উৎপাদনের বহু বিকল্প আছে কিন্তু সুন্দরবনের কোনো বিকল্প নেই। আজ প্রয়োজন শুধু এর রক্ষা নয়, এর বিকাশে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণ করা...।’ (বিস্তারিত: http://ncbd.org/? p= 1606) উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রীকে খোলা চিঠি প্রদানের ওই কর্মসূচিতে পুলিশি নির্যাতন ও আটকের ঘটনা ঘটে।
২০ আগস্ট দেশের সব শহীদ মিনারে দিনব্যাপী অবস্থানসহ সারা বছর সরকারি নানা বাধা, হামলা, হুমকি সত্ত্বেও জাতীয় কমিটির কর্মসূচি অব্যাহত ছিল। সুন্দরবন রক্ষা কমিটি, সর্বপ্রাণসহ বিভিন্ন সংগঠন সারা বছর সক্রিয় ছিল। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো জাতীয় কমিটির বাইরেও ব্যক্তি, সংগঠন, গ্রুপ থেকে অসংখ্য প্রতিবাদী উদ্যোগ দেখা গেছে গত বছর। ঢাকায় সুন্দরবন রক্ষার দাবিতে সাইকেল শোভাযাত্রার উদ্যোগ নিয়েছিল তরুণেরা ৩০ সেপ্টেম্বর। তাদের দেখামাত্র আক্রমণ, পথ থেকে সাইকেল আরোহীদের পুলিশের আটক করা এবং শহীদ মিনারে সন্ত্রাসী দিয়ে ঘিরে ফেলা—এসব বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে যখন সাইকেল মিছিল বের হয়েছে তখন পুলিশ হামলা করেছে জলকামান দিয়ে। তাতে কি তরুণেরা ভয় পেয়ে থেমে গেল? না। এরপরের তিন মাসে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে রামপাল প্রকল্প বাতিলের দাবিতে অন্তত ৫০টি সাইকেল শোভাযাত্রা হয়েছে।
১৮ অক্টোবর ভারতের প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে খোলা চিঠি দেওয়ার জন্য ঢাকায় সমাবেশ ও মিছিল হয়। পুলিশি হামলা উপেক্ষা করে এই চিঠি ভারতীয় হাইকমিশনে পৌঁছানো হয়। এতে বলা হয়, ‘দেশি-বিদেশি স্বাধীন বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ থেকে আমরা নিশ্চিত যে এই কেন্দ্র সুন্দরবনের অস্তিত্বের জন্য ভয়াবহ বিপর্যয় সৃষ্টি করবে। এই কেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর থেকে বিভিন্ন বনগ্রাসী প্রকল্প নিয়ে সুন্দরবনের ভেতরে ও চারধারে হাজির হয়েছে প্রভাবশালী গোষ্ঠী। এর সম্মিলিত প্রভাবে সুন্দরবনের বিনাশ অনিবার্য হয়ে উঠবে।...বিধিনিষেধ ও পরিবেশ সচেতনতার কারণে আপনার সরকারের পরিবেশ মন্ত্রণালয় ও গ্রিন ট্রাইব্যুনাল গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎ ও খনি প্রকল্প স্থগিত বা বাতিল করেছে। বাংলাদেশে ভারতীয় কোম্পানি যে ভারতের আইন ও বিধিমালা ভঙ্গ করেই এই বিদ্যুৎকেন্দ্র করছে সে বিষয়েও আমরা এই চিঠির মাধ্যমে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।...’ (বিস্তারিত: http://ncbd.org/? p= 1662)
ফেসবুকসহ সামাজিক গণমাধ্যমে প্রতিবাদী তৎপরতা এই বছর সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। সরকার সর্বজনের অর্থ খরচ করে বিজ্ঞাপনী সংস্থা ভাড়া করেছে, প্রচুর অর্থ ব্যয় করে টিভিতে বিজ্ঞাপন প্রচার শুরু করেছে, বিভিন্ন স্থানে নাটক–গানের আসর বসাতে চেষ্টা করেছে। এসব তৎপরতা তরুণসহ বিভিন্ন স্তরের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যম, সৃষ্টিশীলতা এবং অবিরাম সক্রিয়তার কারণে জনসমর্থন পায়নি।
চট্টগ্রামে আট মাসের বাচ্চা পেটে নিয়ে শহীদ মিনারে প্রতিবাদী অবস্থানে বসেছিলেন মিলি নামের এক নারী। তাঁর কথা খুব সহজ: ‘যে দেশে উন্নয়নের নামে সুন্দরবন ধ্বংস করা হয় সে দেশে আমি কোন ভরসায় আমার সন্তান নিয়ে আসব? আমার সন্তানের জন্যই সুন্দরবন বাঁচাতে হবে।’ প্রকল্প বাতিল হয়নি, শিশু জন্ম নিয়েছে। পরে মিলি সেই শিশুকে কোলে নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার মহাসমাবেশে যোগ দিয়েছেন নভেম্বরে। ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে’—অনেক প্রাচীন প্রার্থনা এই জনপদের মায়েদের। আর ২০১৬ সালে বাংলাদেশে পেটে সন্তানের সাত মাস অনুষ্ঠান করলেন আরেক নারী মিথিলা ‘আমার সন্তান যেন থাকে সুবাতাসে, তাই সুন্দরবন ধ্বংস করে বিদ্যুৎ কেন্দ্র চাই না’ এই প্রার্থনা দিয়ে।
এই বছরে সুন্দরবন নিয়ে কত গান–কবিতা লেখা হয়েছে, তথ্যচিত্র কতগুলো হয়েছে, কত তরুণ কত রাত জেগেছেন, কত তরুণ কত বেলা না খেয়ে থেকেছেন, কতজনে পেশাগত সমস্যায় পড়েছেন তার পুরো তালিকা করা সম্ভব নয়। গায়ে-গতরে খেটে প্রাণের টানে নিজের জীবন-জীবিকা ঝুঁকিতে ফেলে অনেক মানুষ সুন্দরবনের তথা দেশের জন্য দাঁড়িয়েছেন। এসবই এক নতুন দিশা আর বিশাল ভরসার জায়গা তৈরি করেছে।
বছরজুড়ে বিশ্বের বহু শহরে সুন্দরবন রক্ষায় রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বাতিলের দাবিতে অনেক সভা-সমাবেশ হয়েছে। বছরের শেষ দিকে ২৬ নভেম্বর দেশের সাতটি প্রান্ত থেকে ঢাকামুখী ‘চলো চলো ঢাকা চলো’ কর্মসূচি শেষে ঢাকায় মহাসমাবেশ ও বিশাল মিছিল হয়। এখানে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। সে অনুযায়ী এই বছরের প্রথমেই ৭ জানুয়ারি সুন্দরবনের জন্য বৈশ্বিক প্রতিবাদে শামিল হবেন বহু দেশের মানুষ। ৩০ ডিসেম্বর এই ডাক দিয়ে বাংলাদেশ, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ভাষায় প্রচারাভিযান শুরু করে সর্বপ্রাণ সাংস্কৃতিক শক্তি।
তাজমহল সপ্তাশ্চর্যের একটি। তার একটু দূষণ হলে আমরা সবাই পীড়িত বোধ করি। কোনো নির্বোধও বলবে না, তাজমহল ধ্বংস করে কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র করা হোক। সেই তাজমহলও মানুষের পক্ষে আরেকটি বানানো সম্ভব। কিন্তু সুন্দরবন আরেকটি কেউ বানাতে পারবে না। সুন্দরবন রক্ষা সর্বজনের দায়, তাই তারা কখনোই এর ধ্বংস মেনে নেবে না। আশার কথা, নতুন বছরে দেশে-বিদেশে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ আরও জোরদার হওয়ার লক্ষণ সর্বত্র।
সর্বজনের রায় বাস্তবায়নে সরকার যত দেরি করছে তত সুন্দরবনের ক্ষতি, দেশের ক্ষতি, মানবসমাজের ক্ষতি হচ্ছে। দেশবাসীর প্রতিবাদ, ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের পরিষ্কার মতামত উপেক্ষা করে অনবায়নযোগ্য বিশাল আশ্রয় সুন্দরবন হত্যার আয়োজন অব্যাহত থাকতে পারে না। আমরা আশা করি, আর ক্ষতি না করে নতুন বছরের শুরুতেই দুই দেশের সরকার যৌথ ঘোষণা দিয়ে এই প্রাণবিধ্বংসী প্রকল্প বাতিল ঘোষণা করবে।
আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]/[email protected]