পাঠ্যপুস্তকে শিক্ষাক্রম অনুসরণ করতে হবে : মাহবুবুল হক

মাহবুবুল হক
মাহবুবুল হক
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মাহবুবুল হক বর্তমানে কুমিল্লা কমিউনিকেটিভ কম্পিউটিং ফর নেক্সট জেনারেশন (সিসিএন) বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের চলতি দায়িত্বে আছেন। তিনি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞ। প্রায় তিন দশক ধরে তিনি পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন ও সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করছেন। : সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বিশ্বজিৎ চৌধুরী

প্রথম আলো : এ বছর পাঠ্যবই প্রকাশ ও বিতরণের পর কিছু বিষয় নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। বেশ কিছু ভুল নিয়েও আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। এর কারণ কী?

মাহবুবুল হক : আমার ধারণা, শিক্ষাক্রম অনুসরণ না করে পাঠ্যবইয়ে পরিবর্তন ও পরিমার্জন করার ফলেই এ সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।

প্রথম আলো : ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে বলবেন?

মাহবুবুল হক : দেখুন, ২০১০ সালের শিক্ষানীতির আলোকে পাঠ্যবই তৈরির জন্য একটি শিক্ষাক্রম (কারিকুলাম) তৈরি করা হয়েছিল। বয়সভেদে কোন স্তরের শিক্ষার্থীকে কী শেখানো হবে, কোন বিষয়গুলো তার জন্য উপযুক্ত বা তার ধারণক্ষমতা কতটুকু—এসব দিক বিবেচনা করে লেখক, গবেষক, শিক্ষাবিদ ও মনস্তত্ত্ববিদেরা মিলে একটি শিক্ষাক্রম তৈরি করেন। এই শিক্ষাক্রম সামনে রেখে পাঠ্যপুস্তক রচনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। এর একটি পরীক্ষামূলক সংস্করণ তৈরি করা হয়। শ্রেণিশিক্ষক, অভিভাবক, লেখক, সাংবাদিকসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের ব্যক্তিরা তা পড়ে দেখে মতামত দেন। পরামর্শ ও সুপারিশ দেন। এসব মতামত ও সুপারিশ যাচাই-বাছাই ও পরিমার্জন করে পাঠ্যবইয়ের চূড়ান্ত সংস্করণ করা হয়। ২০১২ ও ’১৩ সালে এভাবেই কাজটি হয়েছে। কিন্তু এ বছর তার ব্যত্যয় ঘটেছে।

প্রথম আলো : কী রকম?

মাহবুবুল হক : এ বছর অনেক বইয়ের পরিমার্জন করা হয়েছে। অনেক লেখা পরিবর্তন করা হয়েছে, পাঠ পরিবর্তন করা হয়েছে। কিন্তু তা কী প্রক্রিয়ায় করা হয়েছে, তা আমাদের জানা নেই।

প্রথম আলো : যেহেতু পাঠ্যপুস্তক তৈরির প্রক্রিয়ার সঙ্গে আপনারা জড়িত ছিলেন, এর পরিবর্তন বা পরিমার্জন করা হলে তা কি আপনাদের জ্ঞাতসারে হওয়াই উচিত ছিল না?

মাহবুবুল হক : ২০১৩ সালে প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত বাংলাবিষয়ক যে বইগুলো হয়েছে, সেগুলোর শিক্ষাক্রম কমিটির আমি আহ্বায়ক ছিলাম। এ রকম প্রতিটা বিষয়ের জন্য পৃথক আহ্বায়ক ছিলেন। একটা রূপরেখা তৈরি করা হয়েছিল। বইগুলো তৈরি হওয়ার পর সম্পাদকদের হাতে গেছে। তাঁরা সম্পাদনা করেছেন। পরিমার্জন করে তা চূড়ান্ত করা হয়েছে। কিন্তু এবার (২০১৬) পরিমার্জনের ব্যাপারটি আমরা জানি না। আমার ধারণা, অন্য লেখক-সম্পাদকেরাও তা জানেন না। কথা হচ্ছে, যেখানে একটি নিয়ম আছে, শিক্ষাক্রম আছে, সেখানে যথেচ্ছ পরিবর্তন তো চলবে না। লেখক-সম্পাদক-বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা না করে এ রকম পরিবর্তন-পরিমার্জন করা সংগত হয়নি।

প্রথম আলো : শিশুদের বর্ণপরিচয়ের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে অ-তে ‘অজ’ লেখা হয়েছে। অজ শব্দের অর্থ কি শিশুরা বুঝবে? একইভাবে ও-তে লেখা হয়েছে ‘ওড়না’ এবং ছবিতে একটি কন্যাশিশুর গায়ে ওড়না দিয়ে লেখা হয়েছে, ‘ওড়না চাই।’ এটা কি অসংগত বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মনে হয় না?

মাহবুবুল হক : দেখুন, আজকাল মানুষ অনেক সচেতন হয়েছে। পত্রপত্রিকা বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমও অনেক সোচ্চার। আলোচনা-সমালোচনা হওয়া ভালো। কিন্তু সেটা গঠনমূলক হওয়া চাই। একসময় অ-তে ‘অজগর’ লেখা হতো। তখন অনেকেই বলেছেন, অজগর একটি ভয়ংকর প্রাণী, শিশু বয়সে এই প্রাণীর সঙ্গে পরিচিত হলে ভীতিকর মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব পড়তে পারে বলে তাঁরা মত প্রকাশ করেছেন। এসব ভেবেই অজগর শব্দটি দেওয়া হয়েছে। অজ সহজ শব্দ। শব্দের পাশেই ছাগলের ছবি দেওয়া আছে। ফলে শিশু নিজেই বা তার শিক্ষকের মাধ্যমে সহজে বুঝতে পারবে যে অজ শব্দের অর্থ ছাগল। ওড়না শব্দ নিয়ে আপত্তির দিকটিও আমার কাছে খুব একটা যুক্তিসংগত মনে হচ্ছে না। ও দিয়ে ওস্তাদ, ওগর, ওঙ্কার, ওজন, ওজর প্রভৃতি যে শব্দগুলো আছে, সেগুলোর চেয়ে ওড়না অনেক পরিচিত।

প্রথম আলো : এখানে লিঙ্গবৈষম্যের কথাটা উঠছে...

মাহবুবুল হক : আবারও বলব, বিষয়টাকে অহেতুক এতটা জটিল করে না ভাবলেই ভালো হয়। আগে শুধু ওড়নার ছবি ছিল, তখন এটাকে এক টুকরো কাপড় মনে হতো। এবার একটি মেয়ের গায়ে ওড়না জড়ানো ছবি দেওয়া হয়েছে। এটা তো দৃষ্টিকটু কিছু নয়।

প্রথম আলো : পাঠ্যবইয়ে বিষয়ের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ ছবি ছাপানোর কথা আপনি বলেছেন, কিন্তু একটি বইয়ে ছাগলকে যে আমগাছে তুলে দেওয়া হলো—এ সম্পর্কে কী বলবেন?

মাহবুবুল হক : হা হা হা। এটা শিল্পীর উদ্ভট কল্পনা। এ রকম ছবি শিশুদের বইয়ে দেওয়া মোটেই ঠিক হয়নি।

প্রথম আলো : কুসুমকুমারী দাশের বিখ্যাত কবিতা ‘আদর্শ ছেলে’র কয়েকটি পঙ্‌ক্তিকে ইচ্ছেমতো পরিবর্তন করা হয়েছে। একটি পঙ্‌ক্তিতে ‘হইতে হবে’র স্থলে করা হয়েছে ‘হতেই হবে’। এ ছাড়া অন্যত্র মুক্তিযুদ্ধ শব্দটির বানান ভেঙে ‘মুকতিযুদধ’ ও ‘বঙ্গবন্ধু’ বানানটি ‘ঙগ’ দিয়ে লেখা হয়েছে।

মাহবুবুল হক : একটি মৌলিক কবিতার পঙ্‌ক্তি এভাবে ইচ্ছেমতো পরিবর্তন করা যায় না। ‘হইতে’ শব্দটি ব্যবহারে যদি শিক্ষার্থীদের মধ্যে সাধু ও চলিতের মিশ্রণ নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে বলে মনে হয়, সে ক্ষেত্রে সম্পাদক তা পরিবর্তন করতে পারেন। তবে অবশ্যই মূল কবিতার নিচে ফুটনোট দিয়ে ‘পরিমার্জিত’ কথাটি লিখতে হবে। একইভাবে যুক্ত বর্ণ সম্পর্কে ধারণা নেই এমন শিক্ষার্থীর জন্য বানান ভেঙে লেখা যেতে পারে। তবে এ কথা আবারও বলছি, এসব ক্ষেত্রে লেখক, সম্পাদক বা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে তা করতে হবে।

প্রথম আলো : হুমায়ুন আজাদসহ বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ লেখকের লেখা এবার বাদ দেওয়া হয়েছে। অনেকের অভিযোগ, হেফাজতে ইসলামসহ কয়েকটি দলের চাপের মুখেই তা করা হয়েছে।

মাহবুবুল হক : দেখুন, শিক্ষার্থীদের জন্য অধিকতর উপযোগী কোনো রচনা অন্তর্ভুক্ত করতে হলে কোনো লেখা বাদ দেওয়া যেতে পারে। সেটাও করতে হবে বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে। কিন্তু শিক্ষাক্রমের সঙ্গে বিরোধপূর্ণ না হলে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে বা কোনো দল ও গোষ্ঠীর চাপে এ রকম বাদ দেওয়া বা নতুন পাঠ সংযোজন করা যুক্তিসংগত নয়।

প্রথম আলো : এনসিটিবির চেয়ারম্যান বলেছেন, প্রতিবছর এ ধরনের কিছু ভুল থাকে। পরে বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে এগুলো সংশোধন করা হয়। এবারও ভুলগুলো দেখে পরবর্তী বছর পাঠ্যপুস্তক ছাপানোর সময় তা ঠিক করে দেওয়া হবে। এই বক্তব্য সম্পর্কে আপনার মত জানতে চাই।

মাহবুবুল হক : পাঠ্যবইয়ের পাঠ ও ছবি শতভাগ নির্ভুল হতে হবে। মুদ্রণপ্রমাদ হলে তা সংশোধন করা যেতে পারে। কিন্তু মূল পাঠে যেন কিছুতেই ভুল না থাকে। মুদ্রণের আগেই চূড়ান্ত পাঠটি মূল লেখক, সম্পাদক ও বিশেষজ্ঞদের দেখানো উচিত। কিন্তু এটি তাঁদের দেখানো হচ্ছে না। এটা দেখছেন এনসিটিবির লোকজন। তাঁদের সেই দক্ষতা, যোগ্যতা আছে  কি না, সেই প্রশ্ন উঠতেই পারে।

প্রথম আলো : ভুল হচ্ছে, বিতর্কিত বিষয় অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে এবং এ নিয়ে বারবার কথা হচ্ছে, এটা কি এভাবে চলতেই থাকবে?

মাহবুবুল হক : মূল কথা হচ্ছে, পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের ব্যাপারে শিক্ষাক্রম অনুসরণ করলে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। এ প্রসঙ্গে আরও একটি কথা বলতে চাই। এনসিটিবির মূল কাজ হলো শিক্ষানীতির আলোকে শিক্ষাক্রম প্রণয়ন ও সেই শিক্ষাক্রম অনুযায়ী পাঠ্যপুস্তক তৈরির কাজটি করা। বইয়ের মুদ্রণ ও বিতরণের কাজটি আগে তাদের ছিল না। এখন মুদ্রণ ও বিতরণের কাজটিও তারাই করছে, ফলে এই বিশাল কর্মযজ্ঞের চাপ সামলানো এনসিটিবির পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছে বলে আমার ধারণা। এতে পাঠ্যপুস্তক নির্ভুল করার কাজটি ব্যাহত হচ্ছে। পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ ও বিতরণের কাজ তদারক পৃথক কোনো সংস্থাকে দেওয়া উচিত বলে মনে করি আমি।

প্রথম আলো : প্রায় ৩৬ কোটি বই মুদ্রণ ও বিতরণের কাজটি একই কেন্দ্র থেকে করা কঠিন। এটাকে বিকেন্দ্রীকরণ করা যায় কি না?

মাহবুবুল হক : আমি তো মনে করি এটা বিকেন্দ্রীকরণ করা সম্ভব। যেমন চূড়ান্ত অনুমোদনের পর বই ছাপানোর জন্য যে ফিল্মটি তৈরি করা হয়, সেটি বিভিন্ন শহরে, অন্তত বিভাগীয় শহরগুলোতে পাঠানো হলে, সেগুলো সেখানেই ছাপা, বাঁধাই ও বিতরণ করা যেতে পারে। এখন তো বিদেশ থেকেও বই ছেপে আনা হচ্ছে। তাহলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রেস থেকে তা করা যাবে না কেন?

প্রথম আলো : আপনাকে ধন্যবাদ।

মাহবুবুল হক : ধন্যবাদ।