হয়ে গেল ন্যায়বিচার?

নায়ারণগঞ্জে সাত খুনের মামলায় সাজাপ্রাপ্ত র্যাবের সাবেক কর্মকর্তা আরিফ (মাঝে)
নায়ারণগঞ্জে সাত খুনের মামলায় সাজাপ্রাপ্ত র্যাবের সাবেক কর্মকর্তা আরিফ (মাঝে)

আমি ফেসবুকে ছোট্ট একটি প্রশ্ন করেছিলাম। সেটি নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের মামলায় সাজাপ্রাপ্ত মেজর আরিফের ছবি নিয়ে। ছবিতে রায় ঘোষণার দিন আরিফের প্রাণবন্ত ও উচ্ছ্বসিত অভিব্যক্তি দেখে আমি অবাক হয়েছি। আরও অবাক হয়েছি তাঁর চুলের স্থানে স্থানে হাইলাইট করা দেখে। এটা হাইলাইট না হয়ে মেহেদির রংও হতে পারে। আমার প্রশ্ন ছিল: ‘আড়াই বছর ধরে জেলে থেকে সাত খুনের একজন আসামি চুল হাইলাইট করার সাহস ও সুযোগ পেল কীভাবে?’
আমি জানি না, এই প্রশ্ন রাষ্ট্রের কর্ণধারদের মনে আসেনি কেন, কেন এর কোনো তদন্ত হয়নি? কেনই বা এ নিয়ে সোচ্চার হয়নি মানবাধিকার সংগঠনগুলো। তবে আমার ফেসবুক পাতার ফলোয়াররা শেয়ার করার মাধ্যমে এই প্রশ্ন বহু মানুষের কাছে ছড়িয়ে দিয়েছেন! আমার মতো সামান্য মানুষের ফেসবুক অভিজ্ঞতায় এটি একটি অসাধারণ ঘটনা।
এই লেখায় আমার মূল উদ্বেগ অবশ্য মেজর আরিফের হাইলাইট করা চুল নয়। উদ্বেগ এই বিচার নিয়ে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের ব্যক্তিদের অতি আশাবাদ আর বিভিন্ন উচ্ছ্বাস নিয়ে। এই উচ্ছ্বাসের তোড়ে আমরা ভুলে গেছি এটি একটি বিচারিক আদালতের বিচারমাত্র। এটিও গুম আর খুনের অজস্র অভিযোগের মধ্যে মাত্র একটি ঘটনার বিচারমাত্র।
নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের মামলার বিচার তাই বলে তুচ্ছ কোনো বিষয় নয়। এটি কিছুটা হলেও আশাবাদী হওয়ার মতোই ঘটনা। তবে যেভাবে এটিকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখা হচ্ছে, তা ভবিষ্যতের জন্য বিভ্রান্তিকর হতে পারে। এমনকি তা আড়াল করে ফেলতে পারে বহু যৌক্তিক প্রশ্ন ও উদ্বেগ।

২.

নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের মামলার রায় হয়েছে একটি বিচারিক আদালতে। তাই এটি কোনো চূড়ান্ত রায় নয়, এই রায়ের বলে কারও ফাঁসিও হয়ে যাবে না। বিচারিক আদালতের এই রায় হাইকোর্টে আপিলযোগ্য। বিচারিক আদালতের ফাঁসির রায় হাইকোর্টে বহাল থাকলে বা এটি কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড করা হলে আবারও সুপ্রিম কোর্টের আপিলেট ডিভিশনে এর বিরুদ্ধে আপিল করা যাবে।

এ দেশে ফাঁসির রায় পাওয়া ব্যক্তির উচ্চ আদালতে গিয়ে শাস্তি কমে যাওয়ার এমনকি তার পুরোপুরি মুক্তি পাওয়ার বহু ঘটনা রয়েছে। আবার পুরো বিচারকাজ শেষ হওয়ার পরওপ্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক কুখ্যাত খুনিরসাজা কমানোর কিছু নজিরও এ দেশে রয়েছে।

কাজেই নারায়ণগঞ্জের ঘটনায় এখনই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলার কোনো অবকাশ নেই। এ ঘটনায় পরিপূর্ণ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হলে অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসকে সর্বোচ্চ আন্তরিকতা দিয়ে আপিল আদালতে কাজ করতে হবে, সেখানেও সরকারকে এই মামলার রায় প্রভাবিত করার সব প্রচেষ্টা থেকে দূরে থাকতে হবে এবং গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজকে তার নজরদারি ভূমিকা অব্যাহত রাখতে হবে। সাত খুনের জন্য দোষী ব্যক্তিদের দণ্ড কার্যকরের পরেই কেবল ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার কথাটি বলা সংগত হবে।

দ্বিতীয়ত, নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের মামলার বিচার দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠারও কোনো বড় প্রমাণ নয়। নারায়ণগঞ্জের বিচার সম্ভব হয়েছে তিনটি কারণে। প্রথম কারণটি কার্যত দৈবাৎ। খুন হয়ে যাওয়া সাত ব্যক্তির লাশ চিরতরে গুম করার ব্যবস্থা অপরাধীরা গ্রহণ করেছিল। এগুলো নিতান্ত দৈবক্রমে ভেসে না উঠলে দেশের বহু গুমের ঘটনার মতো এগুলোও হয়তো আইনের আওতার বাইরেই থেকে যেত। এই বিচার হওয়ার দ্বিতীয় অনুঘটক গণমাধ্যম। বিভিন্নভাবে ঘটনাটি অতিস্পর্শকাতর হওয়ার কারণে গণমাধ্যমে এটি নজিরবিহীনভাবে প্রচারিত হয়। সবশেষে হাইকোর্ট থেকেও অনেকটা নজিরবিহীনভাবে র‍্যাবের কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তার করার আদেশ আসার পরই এই বিচারের পথ সুগম হয়। অন্যান্য বহু বিচারবহির্ভূত, বিশেষ করে গুমের ঘটনায় এসব অনুঘটক এভাবে কাজ করেনি বলে সেগুলোর বিচার দূরের কথা, মামলা পর্যন্ত করা যায়নি অনেক ক্ষেত্রে।

আমরা তাই বলতে পারি, র‍্যাব-পুলিশের বিরুদ্ধে গুম ও হত্যাকাণ্ডের অভিযোগের ক্ষেত্রে অধিকাংশ ঘটনায় বরং আইনের শাসনের কোনো প্রমাণ নেই। নারায়ণগঞ্জের রায় এই সাধারণ চিত্রের একটি ব্যতিক্রম মাত্র। নারায়ণগঞ্জের রায় আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে, অনেক গুমের ঘটনায় র‍্যাব আর পুলিশের সম্পৃক্ততার যে অভিযোগ রয়েছে, তা নিবিড়ভাবে তদন্ত করে দেখা উচিত। এসব ঘটনারও বিচার না হলে, অন্তত সব গুমের ঘটনার তদন্তের জন্য একটি উঁচু পর্যায়ের বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন না করা হলে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় নারায়ণগঞ্জের রায় বড় কোনো ভূমিকা রাখছে বলা যাবে না।

৩.

সাত খুনের বিচার তবু কিছু খুনিকে কনডেম সেলে পাঠিয়েছে, বিচারপ্রার্থীদের কিছুটা স্বস্তি দিয়েছে। অনেকে এমন আশাবাদও ব্যক্ত করেছেন যে এই বিচারের রায় বাহিনীগুলোর বেপরোয়া সদস্যদের অপরাধপ্রবণতা কমাতে নিরোধক হিসেবেও কাজ করবে। হয়তো তা সত্যি হতে পারে। কিন্তু আমার মতে, সত্যি সত্যি আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে অপরাধ থেকে দূরে রাখতে হলে আমাদের কিছু অপ্রিয় প্রশ্ন বিচার-বিবেচনা করে দেখতে হবে।

আমাদের বুঝতে হবে, কোন রাষ্ট্রব্যবস্থায় র‍্যাবের প্রায় পুরো একটি ইউনিট স্রেফ টাকার লোভে মানুষ খুন করে লাশ লোপাট করতে পারে। কোন রাষ্ট্রব্যবস্থায় র‍্যাবের ইউনিটপ্রধান ও একজন কর্নেল নূর হোসেনের মতো একজন আপাদমস্তক দুর্বৃত্তের আজ্ঞাবহে পরিণত হতে পারে?

এসব প্রশ্নের সহজ উত্তর রয়েছে। আমি মনে করি, কোনো প্রশিক্ষিত বাহিনীর কিছু সদস্য ভয়াবহ অপরাধে জড়িয়ে পড়তে পারেন সেই রাষ্ট্রব্যবস্থায়, যেখানে এ ধরনের বাহিনীকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্মূল করার কাজে ব্যবহার করা হয় এবং এ কারণে সব ধরনের জবাবদিহির ঊর্ধ্বে রাখা হয়। এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে এসব বাহিনীর মধ্যে শৃঙ্খলাবোধ, চেইন অব কমান্ড, এমনকি মানবিকতা বিনষ্ট হয়। বাহিনীর কিছু ব্যক্তি তখন ব্যক্তিস্বার্থে খুনের মতো ভয়াবহ অপরাধেও মেতে ওঠেন।

বাংলাদেশেও কি তাই হচ্ছে? বাহিনীগুলোতে অভ্যন্তরীণ জবাবদিহির অভাব, রাষ্ট্রের বিচার বিভাগের ওপর খবরদারি, অকার্যকর সংসদ, সংসদীয় কমিটি, মানবাধিকার কমিশন ও তথ্য কমিশন, অনুন্নত গণতন্ত্র, একদলীয় আধিপত্য এবং রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের পরিবেশ থাকলে একটি দেশে তা-ই হওয়ার কথা।

৪.

র‍্যাব বা সরকারের অন্য কোনো বাহিনীর ঢালাও সমালোচনা এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। আমরা জানি র‍্যাব বা পুলিশ গোয়েন্দা না থাকলে দেশে অপরাধ আরও বহু গুণ বৃদ্ধি পেত। র‍্যাব দেশে মাদক ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, জঙ্গিবাদ মোকাবিলা এবং দুর্ধর্ষ অপরাধী গ্রেপ্তারে বহু সাফল্য অর্জন করেছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে কোনো সাফল্যই র‍্যাবের কাউকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বা গুম করার অধিকার প্রদান করে না। টাকার বিনিময়ে খুন করে বা অন্য কোনো ব্যক্তিস্বার্থে র‍্যাবের (এবং এর বহু সদস্যের) অর্জনকে কালিমাময় করার অধিকার র‍্যাবের একজন ব্যক্তিরও নেই।

র‍্যাবের মহাপরিচালক নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনা প্রসঙ্গে বলেছেন, এ ঘটনার দায় র‍্যাবের নয়, যাঁরা অপরাধ করেছেন তাঁদের। র‍্যাবের কোনো সদস্য ছুটিতে গিয়ে বাড়িতে বসে হত্যাকাণ্ড ঘটালে তিনি এটি বলতে পারতেন। কিন্তু যেখানে র‍্যাবের একটি স্থানীয় ইউনিটের প্রধানের নির্দেশে বাহিনীর সদস্যরা বাহিনীর অফিস, স্থাপনা, অস্ত্র, গাড়ি ও সরঞ্জাম ব্যবহার করে একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড ঘটায়, সেখানে এটি বলা যায় কি?

আমরা বরং চিন্তা করে দেখতে পারি: সাতটি লাশ নদীতে ভেসে না উঠলে নারায়ণগঞ্জের র‍্যাবপ্রধানের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ করার কোনো সুযোগ কোথাও ছিল কি? এ ধরনের অভিযোগ র‍্যাবের কোনো কর্তাব্যক্তির বিরুদ্ধে করা হলে অভিযোগকারীর নিরাপত্তা দেওয়ার কোনো ব্যবস্থা আছে কি? যারা র‍্যাবের বিরুদ্ধে গুম ও খুনের অভিযোগ করেছে, নারায়ণগঞ্জ বাদে অন্য কোথাও তার কোনো বিচার কি সম্পন্ন হয়েছে?

৫.

নারায়ণগঞ্জের বিচার র‍্যাব এবং অন্যান্য বাহিনীর মধ্যে অভ্যন্তরীণ জবাবদিহি তৈরির নতুন তাগিদ সৃষ্টি করেছে। এই বাহিনীগুলোর কার্যক্রম তদারকের জন্য জবাবদিহির প্রতিষ্ঠানগুলোকে (সংসদীয় কমিটি, বিচার বিভাগ, মানবাধিকার কমিশন ইত্যাদি) আরও সক্রিয় ও সজাগ থাকার তাগিদ দিয়েছে। দেশে মানুষের ন্যূনতম মানবাধিকার রক্ষার্থে সরকারের সদিচ্ছার গুরুত্ব নতুন করে তুলে ধরেছে।

নারায়ণগঞ্জের বিচারে আত্মতৃপ্তিতে না ভুগে এগুলো আমরা অনুধাবন করলেই তা দেশের জন্য ভালো হবে।

আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।