আইনজীবীরা কি আইনের ঊর্ধ্বে?

মানব পাচার আইনে গ্রেপ্তার হওয়া এক আইনজীবী ও তাঁর জামিন নামঞ্জুর হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম আদালত ভবনে
যা তুলকালাম কাণ্ড হয়ে গেল, তা যুগপৎ অনাকাঙ্ক্ষিত ও বিস্ময়কর। দুই ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে আদালতের ভেতরে ও বাইরে বিক্ষুব্ধ আইনজীবীরা মুহুর্মুহু স্লোগান দিয়েছেন, নথি তছনছ করেছেন, এমনকি বিচারকের খাসকামরার জানালার কাচ ভাঙচুর করেছেন। এ সময় দায়িত্ব পালনরত সাংবাদিকদের সঙ্গেও দুর্ব্যবহার করেন তাঁরা। ক্যামেরা কেড়ে নেওয়া হয় একজন সাংবাদিকের কাছ থেকে। পরে অবশ্য প্রেসক্লাব ও সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতাদের হস্তক্ষেপে এ আচরণের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন আইনজীবী নেতারা।

ঘটনা এমনই নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে উঠেছিল যে একপর্যায়ে দাঙ্গা পুলিশ তলব করতে হয়েছে। যদিও শেষ পর্যন্ত পুলিশ কোনো অ্যাকশনে যায়নি। অবশেষে মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে বিশেষ আবেদন করে দুই আসামির জামিন চাইলে পাঁচ মিনিটের শুনানি শেষে তাঁদের জামিন হয় এবং আইনজীবীরা আনন্দ মিছিল বের করে তাঁদের বিজয় (?) অর্জিত হয়েছে বলে দাবি করেন।

পুরো প্রক্রিয়াটি বিবেচনা করলে খুব স্বাভাবিকভাবেই এ প্রশ্ন উঠতে পারে, আইনজীবীরা কি আইনের ঊর্ধ্বে?

নগরের কেন্দ্রস্থলে মনোরম প্রকৃতিশোভিত এক পাহাড়ের ওপর ব্রিটিশ আমলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল চট্টগ্রাম আদালত ভবন। প্রতিদিন বিচারপ্রার্থী হাজারো লোকের ভিড়ে মুখরিত হয়ে ওঠে এই এলাকা। বিচারক, শত শত নবীন-প্রবীণ আইনজীবী এবং মামলা-মোকদ্দমাসংশ্লিষ্ট কাজে সম্পৃক্ত বহু মানুষ আদালত ভবন ও এর প্রাঙ্গণে ভিড় করেন পেশাগত দায়িত্ব পালন ও আয়–উপার্জনের জন্য।

নানা রকম অভাব-অভিযোগ সত্ত্বেও কিছু প্রতিষ্ঠিত প্রথা, রীতি ও শৃঙ্খলার মধ্যেই পরিচালিত হয় এই কর্মযজ্ঞ। কোনো বিচারই সব পক্ষকে সন্তুষ্ট করতে পারে না। ফলে ‘কাছারীর পাহাড়’ নামে পরিচিত আদালত প্রাঙ্গণের পরিবেশ প্রতিদিন অজস্র মানুষের দীর্ঘশ্বাসে ভারী হয়ে ওঠে। আবার দীর্ঘসূত্রতার কারণে ক্লান্ত-বিরক্ত ভুক্তভোগীর সংখ্যাও তো কম নয়। তবু মানুষ এই ব্যবস্থার ওপর আস্থা রাখতে চায়। আইনের প্রথা ও শৃঙ্খলাকে সম্মান করে। কিন্তু যাঁরা শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ লাভ করে আইন পেশায় কর্মরত, তাঁরাই যদি এই প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলাকে অমান্য করেন, সমাজে তাঁদের ভাবমূর্তি সংকটের মুখে পড়তে বাধ্য। এবং কোনো সন্দেহ নেই তাঁদের এ ধরনের আচরণ দেশের বিচারব্যবস্থার প্রতি অশ্রদ্ধা প্রকাশেরই নামান্তর।

পাঠকের সুবিধার্থে ঘটনার প্রেক্ষাপটটি সংক্ষেপে বলে রাখি। ১৮ জানুয়ারি রাতে বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে সৌদি আরবে ওমরাহ পালন করতে যাওয়ার সময় চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের অভিবাসন পুলিশের হাতে আটক হন ফজলুল কাদের ও রেজিয়া আক্তার নামের দুজন যাত্রী। পুলিশ রেজিয়াকে মিয়ানমারের অধিবাসী ও রোহিঙ্গা বলে শনাক্ত করে। দালালদের সহযোগিতায় ওমরাহর
নামে সৌদি আরব যাচ্ছিলেন তিনি। ফজলুল কাদের ও রেজিয়ার নামে মানব পাচার আইনে মামলা করা হয়। এদিকে এ দুজনকে বিমানবন্দরের ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে বাইরে এক আইনজীবী ও তাঁর স্ত্রী অপেক্ষায় ছিলেন বলে পুলিশের অভিযোগ। তাঁরাই দালালের মাধ্যমে এ দুজনকে সৌদি আরবে পাঠাচ্ছিলেন। ধৃত ব্যক্তিরা এ কথা স্বীকার করেছেন এবং তাঁদের মুঠোফোনের কললিস্টেও এই দুজনের নাম পাওয়া গেছে বলে পুলিশের দাবি। র‍্যাব আইনজীবী ও তাঁর স্ত্রীকে গ্রেপ্তার করে ওই রাতেই পতেঙ্গা থানা-পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে।

পরদিন আইনজীবী দম্পতিকে আদালতে আনা হলে অন্তত ১০০ জন আইনজীবী দাঁড়িয়ে জামিনের আবেদন জানান। কিন্তু আদালত জামিন আবেদন নামঞ্জুর করলে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।

চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি কফিলউদ্দিন এ প্রসঙ্গে বলেছেন, সন্দেহভাজন আসামি হিসেবে পুলিশ আইনজীবী ও তাঁর স্ত্রীকে গ্রেপ্তার করেছে। অপরাধ আমলে না নেওয়া পর্যন্ত আদালত চাইলে জামিন দিতে পারেন। জামিনে গেলে আসামিরা পলাতক হবেন না। কিন্তু আদালত জামিন নামঞ্জুর করে এজলাস থেকে নেমে যান।

‘আদালত চাইলে জামিন দিতে পারেন’ এ কথা বলেছেন আইনজীবী সমিতির সভাপতি, কিন্তু আদালত না চাইলে আইনজীবীরা আদালত প্রাঙ্গণে অরাজকতা করতে পারেন—এমন কথা বলেননি তিনি। বরং আইনজীবীদের এই আচরণকে আবেগের বহিঃপ্রকাশ বলে উল্লেখ করে স্বীকার করেছেন ‘উচিত হয়নি।’ কথা হচ্ছে, জামিন নামঞ্জুর হলে আইনগত আরও পদক্ষেপ গ্রহণের সুযোগ আইনজীবীদের সামনে ছিল কি না?

আমরা জানি, মহানগর হাকিম আদালতে জামিন নামঞ্জুর হলে মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে বিশেষ আবেদন করা যায়। সেখানেও নামঞ্জুর হলে মিস মামলা করে মহানগর দায়রা জজ আদালতে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। সবশেষে উচ্চ আদালতে যাওয়ার সুযোগ তো ছিলই।

তা ছাড়া, কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পথও যে খোলা, তার দৃষ্টান্ত তো হাতের কাছেই আছে। চট্টগ্রামের প্রথম ও দ্বিতীয় নারী ও শিশু নির্যাতন আদালতের দুই বিচারককে প্রত্যাহারের দাবি করেছিল আইনজীবী সমিতি। চূড়ান্ত আন্দোলনে যাওয়ার আলটিমেটাম দিয়ে এই দুই আদালত বর্জনও শুরু করেন আইনজীবীরা। কিন্তু আন্দোলনে যাওয়ার আগেই চট্টগ্রাম আদালত থেকে দুই বিচারককে প্রত্যাহার করা হয়। এত কিছুর পরও নিজেদের কর্মক্ষেত্রকে অসম্মান ও অমর্যাদা করার ধৃষ্টতা দেখালেন কিছু আইনজীবী।

>এ দেশের আইন পেশায় বহু বরেণ্য ও কীর্তিমান ব্যক্তি নিয়োজিত ছিলেন ও আছেন। কিছু উচ্ছৃঙ্খল মানুষের হঠকারিতার জন্য এই পেশাটির প্রতি মানুষের আস্থা ও শ্রদ্ধা প্রশ্নবিদ্ধ হতে দেওয়া যায় না

দেখা যাচ্ছে, মাত্র দুই ঘণ্টা পর মুখ্য মহানগর আদালতে বিশেষ আবেদন করে জামিন পেয়েছেন আইনজীবী ও তাঁর স্ত্রী। তাহলে মাত্র দুই ঘণ্টা সময়ের ধৈর্যের অভাবে আইন ও আদালতের প্রতি অবজ্ঞা দেখানোর এই কলঙ্কজনক নজিরকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে? বিচারপ্রার্থী আমজনতার কাছে আইনজীবীদের এই আচরণ কী বার্তা পৌঁছে দেবে?

এ দেশের আইন পেশায় বহু বরেণ্য ও কীর্তিমান ব্যক্তি নিয়োজিত ছিলেন ও আছেন। কিছু উচ্ছৃঙ্খল মানুষের হঠকারিতার জন্য এই পেশাটির প্রতি মানুষের আস্থা ও শ্রদ্ধা প্রশ্নবিদ্ধ হতে দেওয়া যায় না। চট্টগ্রাম আদালত ভবনে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ঘটনা তদন্তের জন্য কমিটি গঠিত হয়েছে। এদিকে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে আইনজীবীদের নিয়ন্ত্রক ও তদারকি সংস্থা বাংলাদেশ বার কাউন্সিল বরাবর চিঠি পাঠিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট। চিঠিতে ‘ব্যবস্থা’ সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্টকে অবহিত করতেও বলা হয়েছে। সুষ্ঠু তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেই কেবল এ ধরনের অপেশাদারি তৎপরতার পুনরাবৃত্তি রোধ করা সম্ভব।

বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক  সাংবাদিক