বাংলাদেশ আরও ভালো অবস্থানে নয় কেন?

কার্টুন: তুলি
কার্টুন: তুলি

২৫ জানুয়ারি ২০১৭ বার্লিনভিত্তিক আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) কর্তৃক প্রকাশিত দুর্নীতির ধারণাসূচক ২০১৬ অনুযায়ী ০-১০০ স্কেলে বাংলাদেশ ২৬ স্কোর পেয়েছে, যা ২০১৪ ও ২০১৫-এর তুলনায় ১ পয়েন্ট বেশি। ১৭৬টি দেশের মধ্যে নিম্নক্রম অনুযায়ী বাংলাদেশ ১৫তম স্থান পেয়েছে, যা ২০১৫ এর তুলনায় দুই ধাপ ওপরে। উচ্চক্রম অনুযায়ী এবার আমাদের অবস্থান ১৪৫তম, যা ২০১৫-এর তুলনায় ছয় ধাপ নিচে। বাংলাদেশ এখনো এই সূচকের বৈশ্বিক গড় ৪৩-এর তুলনায় অনেক কম, অর্থাৎ দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে মধ্যম মাত্রায় সাফল্য অর্জন থেকে বাংলাদেশ এখনো অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে। তদুপরি, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে এবারও বাংলাদেশের অবস্থান বিব্রতকরভাবে আফগানিস্তানের পর দ্বিতীয় সর্বনিম্ন।
দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে ভুটান, ৬৫ স্কোর পেয়ে উচ্চক্রম অনুযায়ী ২৭তম, এরপর ভারত ৪০ স্কোর পেয়ে ৭৯তম, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ ৩৬ পেয়ে যৌথভাবে ৯৫তম, পাকিস্তান ৩২ পেয়ে ১১৬তম, নেপাল ২৯ পেয়ে ১৩১তম এবং আফগানিস্তান ১৫ পেয়ে ১৬৯তম। বৈশ্বিক তালিকায় সর্বনিম্ন স্কোর পেয়েছে সোমালিয়া ১০ পয়েন্ট। বাংলাদেশের তুলনায় কম স্কোর পাওয়া অন্যান্য দেশের মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ সুদান (১১), উত্তর কোরিয়া (১২), সিরিয়া (১৩) এবং লিবিয়া ও ইয়েমেন (১৪)। ভুটান ছাড়া দক্ষিণ এশীয় সব দেশেরই স্কোর সূচকের গড় ৪৩-এর নিচে, অর্থাৎ এ অঞ্চলে দুর্নীতির ব্যাপকতা বিশেষভাবে উদ্বেগজনক।
১৯৯৫ সাল থেকে প্রণীত দুর্নীতির ধারণাসূচক বা সিপিআই (করাপশন পারসেপশন ইনডেক্স) সরকারি খাতে, বিশেষ করে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দুর্নীতির ব্যাপকতা সম্পর্কে ধারণার তথ্যের বিশ্লেষণ করে বিভিন্ন দেশের তুলনামূলক চিত্র প্রদান করে থাকে। সূচকে ১৩টি আন্তর্জাতিক সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত জরিপের তথ্যের বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এতে এমন জরিপের তথ্যই ব্যবহৃত হয়, যার মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা সম্ভব। টিআইবি বা অন্য কোনো দেশের টিআই চ্যাপ্টারের গবেষণা বা জরিপলব্ধ কোনো তথ্য এ সূচকে বিবেচিত হয় না। অন্যদিকে সূচকে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য কোনো দেশ সম্পর্কে কমপক্ষে তিনটি আন্তর্জাতিক জরিপ থাকতে হয়। ফলে প্রায় প্রতিবছরই জরিপে অন্তর্ভুক্ত দেশের সংখ্যার হেরফের হয়। একই কারণে প্রতিবেশী মালদ্বীপ গত কয়েক বছরে সূচকের বাইরে থাকার পর এবার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
সূচকটি টিআইয়ের বার্লিনভিত্তিক সচিবালয়ের গবেষণা বিভাগ কর্তৃক প্রণীত হয়। সিপিআইয়ের পদ্ধতি নির্ধারণ করেন কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ এবং লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস অ্যান্ড পলিটিক্যাল সায়েন্সের ডিপার্টমেন্ট অব গভর্নমেন্টের বিশেষজ্ঞরা। জার্মান ইনস্টিটিউট অব ইকোনমিক রিসার্চ সূচকের স্কোর পর্যালোচনা ও তথ্যের যথার্থতা যাচাই করে থাকে।
যে ৭টি সূত্র থেকে বাংলাদেশের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে তারা হলো—ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম এক্সিকিউটিভ ওপিনিয়ন সার্ভে, ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের কান্ট্রি রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট, বার্টলসম্যান ফাউন্ডেশন ট্রান্সফরমেশন ইনডেক্স, গ্লোবাল ইনসাইট কান্ট্রি রিস্ক রেটিংস, পলিটিক্যাল রিস্ক সার্ভিসেস ইন্টারন্যাশনাল কান্ট্রির রিস্ক গাইড, বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি পলিসি অ্যান্ড ইনস্টিটিউশনাল অ্যাসেসমেন্ট ও ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্টের রুল অব ল ইনডেক্স। তথ্য সংগ্রহের মেয়াদ জানুয়ারি ২০১৫ থেকে সেপ্টেম্বর ২০১৬ পর্যন্ত।

>আশার কথা, দুর্নীতিবিরোধী আইনি, প্রাতিষ্ঠানিক ও নীতিকাঠামোতে গত প্রায় এক দশকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। তবে এসবের চর্চা ও প্রয়োগের ঘাটতি পূরণে রাজনৈতিক ও সরকারিভাবে ক্ষমতাবান মহলের অকৃত্রিম সদিচ্ছার বিকল্প নেই

যেসব দেশে দুর্নীতির ব্যাপকতা ও গভীরতা সবচেয়ে কম বলে নিরূপিত হয়েছে তার মধ্যে শীর্ষে রয়েছে ৯১ স্কোর পেয়ে পরপর দ্বিতীয়বারের মতো ডেনমার্ক ও যৌথভাবে একই স্কোর পেয়ে নিউজিল্যান্ড। ৮৯ পেয়ে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ফিনল্যান্ড। এরপর সুইডেন (৮৮), সুইজারল্যান্ড (৮৬), নরওয়ে (৮৫), সিঙ্গাপুর (৮৪), নেদারল্যান্ডস (৮৩), কানাডা (৮২) এবং জার্মানি, লুক্সেমবার্গ ও যুক্তরাজ্য (৮১)। এশীয় অঞ্চলে সিঙ্গাপুর ছাড়া তুলনামূলকভাবে উচ্চতর অবস্থানে রয়েছে হংকং (৭৭), জাপান (৭২), সংযুক্ত আরব আমিরাত (৬৬) ও কাতার (৬১)।
কোনো দেশই শতভাগ স্কোর পায়নি। বিশ্বের সর্বোচ্চ উন্নত দেশসমূহের অনেকেই, যেমন অস্ট্রেলিয়া, আইসল্যান্ড, বেলজিয়াম, জাপান, অস্ট্রিয়া, আয়ারল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, স্পেন, ইতালি প্রভৃতি দেশ ৮০ শতাংশের কম স্কোর পেয়েছে। রাশিয়া মাত্র ২৯ স্কোর পেয়ে ১৩১তম ও চীন ৪০ পেয়ে ৭৯তম স্থানে রয়েছে। ১৭৬টি দেশের মধ্যে ১২৪টি, অর্থাৎ শতকরা ৭০ ভাগ দেশ ৫০-এর কম স্কোর পেয়েছে। ১০৯টি দেশ সূচকের গড় স্কোর ৪৩-এর চেয়ে কম পেয়েছে। ৩০টি দেশের স্কোর ২০১৫-এর তুলনায় অপরিবর্তিত রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় নেপাল, পাকিস্তান ও ভারতের স্কোর ২ পয়েন্ট বেড়েছে; শ্রীলঙ্কার ১ পয়েন্ট কমেছে ও আফগানিস্তানের স্কোর ৪ পয়েন্ট বেড়েছে। ২০১৫-এর তুলনায় ২০১৬-এর বৈশ্বিক সার্বিক পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। ২০১৫ সালে ৬৫টি দেশের স্কোর বেড়েছিল, ২০১৬-এ বেড়েছে ৬৩টি দেশের ক্ষেত্রে। অন্যদিকে ২০১৫ সালে ৪৯টির তুলনায় ২০১৬-এ ৭১টি দেশের (প্রায় ৪০ শতাংশ) স্কোরে অবনতি হয়েছে। উন্নয়নশীল অনেক দেশের পাশাপাশি যেসব উন্নত দেশে অবনতি হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে নেদারল্যান্ডস, যার ৪ পয়েন্ট কমেছে। এ ছাড়া জাপান (৩) ও যুক্তরাষ্ট্র (২) এমনকি শীর্ষস্থান অধিকারী ডেনমার্কেরও ১ পয়েন্ট কমেছে। সবচেয়ে বেশি কমেছে কাতার (১০), কুয়েত (৮) ও বাহরাইনের (৮)। ২০১৫-এর তুলনায় ৯ পয়েন্ট বেশি পেয়ে সবচেয়ে বেশি উন্নতি করেছে সুরিনাম, ৮ পয়েন্ট বেশি পেয়ে বেলারুশ ও ৭ পয়েন্ট বেশি পেয়ে পূর্ব তিমুর।
সার্বিক বিবেচনায় এটি পরিষ্কার যে দুর্নীতি একটি বৈশ্বিক সমস্যা, যদিও আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের ক্ষেত্রে দুর্নীতির চ্যালেঞ্জ অনেক বেশি উদ্বেগের কারণ। স্মরণ করা যেতে পারে, ২০০১ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত পরপর পাঁচবার বাংলাদেশ সর্বনিম্ন স্থানে ছিল। সোমালিয়া এ বছরসহ পরপর ১০ বার সর্বনিম্নে অবস্থান পাওয়ার ফলে আমাদের সেই গ্লানির কিছুটা লাঘব হতে পারে। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ ২০০৬ সালে ৩য়, ২০০৭ ৭ম, ২০০৮ ১০ম, ২০০৯ ১৩তম, ২০১০ ১২তম, ২০১১ ও ২০১২ ১৩তম, ২০১৩ ১৬তম, ২০১৪ ১৪তম, ২০১৫ ১৩তম এবং ২০১৬ সালে ১৫তম স্থান পাওয়ায় কিছুটা স্বস্তি যৌক্তিক বটে। তবে অনবস্থিত ও মন্থর এই চলনে গতির সঞ্চার করে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে কমপক্ষে মধ্যম পর্যায়ের সাফল্য অর্জনের সম্ভাবনা সুদূর পরাহতই থেকে যাচ্ছে।
যেসব কারণে দ্রুততর অগ্রগতি হচ্ছে না, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে দুর্নীতিবিরোধী রাজনৈতিক ঘোষণা বাস্তবায়নে রাজনৈতিক সদিচ্ছারই ঘাটতি। যারা দুর্নীতিতে লিপ্ত, বিশেষ করে উচ্চপর্যায়ের দুর্নীতির ক্ষেত্রে কিছু বিরল ব্যতিক্রম ছাড়া জবাবদিহি নিশ্চিতের দৃষ্টান্তের অভাব প্রকট। একদিকে ব্যক্তির অবস্থান ও পরিচয়ের প্রাধান্য ও অন্যদিকে অস্বীকৃতির মানসিকতা দুর্নীতির সুরক্ষা ও বিচারহীনতার সংস্কৃতির বিকাশ ঘটাচ্ছে। এবারের সূচকে ব্যবহৃত তথ্যের মেয়াদে (জানুয়ারি ২০১৫-সেপ্টেম্বর ২০১৬) দুর্নীতি দমন কমিশনের সক্রিয়তা, দৃঢ়তা ও কার্যকরতার ঘাটতি ছিল আলোচিত। এ ছাড়া জবাবদিহির সার্বিক প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোও দুর্বলতর হয়েছে। বিশেষ করে রাজনৈতিক অঙ্গনে একচ্ছত্র আধিপত্যে গণতান্ত্রিক জবাবদিহির মৌলিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দলীয়করণ প্রকটতর হয়েছে। সরকারি ক্রয়সহ রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যবহারে স্বার্থের দ্বন্দ্ব স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ভূমি-বনাঞ্চল-নদী-জলাশয় দখল, সরকারি খাতে নিয়োগে দলীয়করণ এবং ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতে অনিয়মের নিয়ন্ত্রণহীন বিকাশ ঘটেছে। সেবা খাতে দুর্নীতি ও হয়রানি জীবনযাত্রার অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। সরকারের দায়িত্বশীল অবস্থান থেকে প্রকাশ্যে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, ক্ষমতায় থাকলে সম্পদ বৃদ্ধিই স্বাভাবিক। অবৈধ অর্থের পাচারের বৈশ্বিক তালিকায় বাংলাদেশ বিব্রতকরভাবে প্রথম সারিতে রয়েছে। কালোটাকা অর্জনকে পুরস্কৃত করা অব্যাহত রয়েছে।
আশার কথা, দুর্নীতিবিরোধী আইনি, প্রাতিষ্ঠানিক ও নীতিকাঠামোতে গত প্রায় এক দশকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। তবে এসবের চর্চা ও প্রয়োগের ঘাটতি পূরণে রাজনৈতিক ও সরকারিভাবে ক্ষমতাবান মহলের অকৃত্রিম সদিচ্ছার বিকল্প নেই। দুর্নীতি যে বাস্তবেই শাস্তিযোগ্য অপরাধ, সব ধরনের ভয় বা করুণার ঊর্ধ্বে থেকে তার দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। সম্প্রতি দুদক লক্ষণীয়ভাবে সক্রিয় হয়েছে। কার্যকর দুদকের পাশাপাশি অন্যান্য জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে জাতীয় সংসদের কার্যকরতা নিশ্চিত করতে হবে; আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থায় পেশাদারি উৎকর্ষ বৃদ্ধি করতে হবে। সর্বোপরি দুর্নীতির বিরুদ্ধে সাধারণ জনগণ, গণমাধ্যম ও বেসরকারি সংগঠনের সোচ্চার ভূমিকা অপরিহার্য, যার পরিবেশ নিশ্চিত করার দায়িত্বও সরকারের। দুর্নীতিবিরোধী চেতনা ও সমালোচনা সহ্য করার সৎ সাহস একসূত্রে গাঁথা। সমালোচনা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করা শুধু জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক চর্চার জন্য ক্ষতিকারক নয়, দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ ও বিচারহীনতার সংস্কৃতির অন্যতম অনুঘটকও। অন্যদিকে, মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিতের মাধ্যমে জনগণ যত বেশি সোচ্চার হওয়ার সুযোগ পাবে, তত বেশি সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতি প্রতিরোধে অগ্রগতি হবে।

ইফতেখারুজ্জামান: নির্বাহী পরিচালক, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।