ট্রাম্পের বাণিজ্যনীতি ও বাংলাদেশের বাজারসুবিধা

ডোনাল্ড ট্রাম্প কথা রাখতে একটু দেরি করেছেন। দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম দিনই কলমের এক খোঁচায় বহুল আলোচিত ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিপিপি) চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নাম প্রত্যাহার করে নেননি। করেছেন তিন দিন পরে, গত সোমবার। টিপিপি বর্জনের মধ্য দিয়েই ট্রাম্পের বাণিজ্যনীতির পথচলা শুরু হলো।

যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, মেক্সিকো, পেরু, চিলি, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, ব্রুনাই ও জাপান—এই ১২টি দেশ মিলে কয়েক বছর ধরে আলাপ-আলোচনা করে টিপিপি চুক্তিতে উপনীত হয়েছিল, যা বিশ্বের সর্ববৃহৎ আঞ্চলিক বাণিজ্য চুক্তি হয়ে ওঠে। গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে এটি আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে সদস্য দেশগুলোর এই চুক্তি জাতীয়ভাবে অনুসমর্থন করার কথা। টিপিপির সদস্য দেশগুলোয় এখন ৮০ কোটি মানুষের বসবাস। এই দেশগুলো একত্রে বিশ্বের ৪০ শতাংশ বাণিজ্য সম্পন্ন করে। টিপিপির আওতায় দেশগুলো পরস্পরকে পণ্যসেবায় বিস্তৃত বাজারসুবিধা ও বিনিয়োগে বাড়তি ছাড় দিয়ে পরস্পরের অর্থনৈতিক লেনদেন অনেক দূর বাড়িয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল। এটা টিপিপির বাইরের দেশগুলোকে নানাভাবে চাপে ফেলত।

ট্রাম্প তাহলে টিপিপি থেকে সরে এসে কী বার্তা দিলেন? মোটা দাগে বললে, প্রথমত, আমেরিকা বাণিজ্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে এখন থেকে দ্বিপক্ষীয় বোঝাপড়াকে অধিকতর গুরুত্ব দেবে। দ্বিতীয়ত, বহুপক্ষীয় বাণিজ্যব্যবস্থা ও এর নিয়মনীতি অনুসরণে আগের চেয়ে অনেক কম সচেষ্ট থাকবে। লক্ষণীয় যে এগুলো খুব নতুন সিদ্ধান্ত বা বৈপ্লবিক পরিবর্তন নয়। গত কয়েক দশকে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যনীতিতে বহুপক্ষীয় বাণিজ্য সম্পর্কের তুলনায় দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ওপর গুরুত্ব বেশি ছিল। ছিল বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) গৃহীত নিয়মনীতি অনুসরণে অনীহা। বরং ডব্লিউটিওর মাধ্যমে নিজস্ব বিভিন্ন নিয়মনীতি বৈশ্বিকভাবে চাপিয়ে দেওয়ার একটা প্রয়াস আড়াল থেকে বরাবরই লক্ষ করা গেছে।

কিন্তু ট্রাম্পের হাতে এসে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যনীতি অধিকতর আগ্রাসী ও আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠতে যাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই তার বাণিজ্য অংশীদার দেশগুলোকেও এখন এই পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মেলাতে নিজস্ব বাণিজ্য কৌশলে কমবেশি পরিবর্তন আনতে হবে। বস্তুত, ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ার অল্প দিনের মাথায় ঘোষণা করেন যে দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম দিনই তিনি টিপিপি চুক্তি বাতিল করে দেবেন। এ ঘোষণার পরপরই বাংলাদেশের বাণিজ্য কৌশল নিয়ে নতুন চিন্তার প্রয়াস দেখা গেছে। দেশের ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) বাণিজ্য উপদেষ্টা একটি অভ্যন্তরীণ পত্রে অভিমত দেন যে বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের উচিত হবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (বিএফটিএ) করার দিকে অগ্রসর হওয়া। তিনি আরও বলেন যে জিএসপি (অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্যসুবিধা) পুনরুদ্ধারের পেছনে সময় ব্যয় না করে
কিংবা ডব্লিউটিওর আওতায় বহুপক্ষীয়ভাবে যুক্তরাষ্ট্রে শুল্কমুক্ত বাজারসুবিধা পাওয়ার জন্য শ্রম না দিয়ে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করার বিষয়ে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো উচিত। এ ধরনের চিন্তা যৌক্তিক কারণেই কিছুটা বিশ্লেষণের দাবি রাখে।

যুক্তরাষ্ট্র এখন বাংলাদেশের ১ নম্বর বাণিজ্য অংশীদার এবং বাংলাদেশের রপ্তানির, বিশেষত তৈরি পোশাকের শীর্ষ বাজার। গত অর্থবছররে (২০১৫-১৬) দুই দেশের মধ্যকার মোট বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৭২২ কোটি ডলার, যার মধ্যে ৬২২ কোটি ডলার ছিল বাংলাদেশের রপ্তানি এবং ১০০ কোটি ডলার ছিল সেই দেশ থেকে আমদানি। আবার গত অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্র এ দেশে প্রায় ৪৫ কোটি ডলার বিনিয়োগ করে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের ১ নম্বর উৎস হয়ে উঠেছে। দুই দেশের মধ্যকার বাণিজ্য তথা অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করার জন্য স্বাক্ষরিত হয়েছে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা রূপরেখা চুক্তি (টিকফা)।

তবে বাণিজ্য সম্পর্কে কিছুটা টানাপোড়েন চলছে তিন বছর ধরে। এমনিতেই যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে শুল্কমুক্ত বাজারসুবিধা দেয়নি বহু দেনদরবার করার পরও। অথচ দেশটির সিংহভাগ আমদানি শুল্কমুক্ত এবং বার্ষিক আমদানি শুল্ক সেখানকার মোট রাজস্ব আয়ের মাত্র ১ শতাংশ জোগান দেয়। তারপরও বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাকসহ বেশির ভাগ পণ্যই শুল্কমুক্ত সুবিধার আওতার বাইরে রয়ে গেছে। একসময় জিএসপির আওতায় প্লাস্টিকসহ কিছু পণ্য সুবিধা পেত। কিন্তু ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ট্র্যাজেডিতে ১ হাজার ১০০-এর বেশি পোশাকশ্রমিকের মৃত্যু হওয়ায় বিশ্বজুড়ে নিন্দা-সমালোচনার ঝড় ওঠে। এরই জের ধরে ওবামা প্রশাসন বাংলাদেশের জিএসপি–সুবিধা স্থগিত করে, সেটা আজও বহাল আছে। সামগ্রিকভাবে সব দেশের জিএসপি–সুবিধাই তখন স্থগিত করা হয়েছিল, যা পরবর্তী সময়ে নতুনভাবে চালু করা হয়। তবে বাংলাদেশের জিএসপি পুনরায় চালুর জন্য শ্রম অধিকার প্রতিষ্ঠা ও কারখানার কর্মপরিবেশ উন্নত করার ১৫ দফা শর্তারোপ করা হয়, যার প্রায় সবগুলোই কমবেশি বাস্তবায়িত হয়েছে। তবু জিএসপি–সুবিধা পুনর্বহাল করা হয়নি।

নতুন বাস্তবতায় জিএসপি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চালানোর চেয়ে বিএফটিএর চেষ্টা করা কতটা যৌক্তিক হবে, তা ভেবে দেখা দরকার। শুল্কমুক্ত বাজারসুবিধা বিএফটিএ নিশ্চিত করবে বটে, কিন্তু তার মূল্য বহন করার ক্ষমতা বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব কি না, তা যাচাই করতে হবে।

এটা ঠিক যে ডব্লিউটিওর হংকং ঘোষণা অনুসারে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে শুল্কমুক্ত বাজারসুবিধা পাওয়ার দাবিদার। এ ঘোষণায় উন্নত দেশগুলোয় ৯৭ শতাংশ পর্যন্ত পণ্যে বাজারসুবিধা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের যুক্তি হচ্ছে, দোহা পর্বের আলোচনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত এটি বাস্তবায়ন বাধ্যতামূলক নয়। আবার বালি, ঘোষণায় ৯৭ শতাংশ থেকে বাজারসুবিধার পরিধি বাড়ানোর কথা বলা হলেও তা কোনো কাজে আসেনি। ফলে বহুপক্ষীয় বাণিজ্যব্যবস্থার আওতায় বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে শুল্কমুক্ত বাজারসুবিধা পাওয়া সুদূরপরাহত হয়ে পড়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশি পণ্যকে গড়ে ১৫ দশমিক ৫ শতাংশ শুল্ক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতে হয়।

এ অবস্থায় ট্রাম্প যখন দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্পর্ককে অধিকতর গুরুত্ব দিচ্ছেন, তখন বিএফটিএ করার প্রস্তাবটি আসছে। কিন্তু বাংলাদেশ আজ পর্যন্ত একটিও বিএফটিএ করেনি বা করতে পারেনি। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মাত্র ২০টি দেশের বিএফটিএ রয়েছে। কেননা, যুক্তরাষ্ট্রের মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি কাঠামো বেশ বিস্তৃত ও কঠিন। এতে শুধু পণ্য ও সেবা খাতই নয়, আছে বিনিয়োগ সুরক্ষার বিষয়। আরও আছে মেধাস্বত্ব, পরিবেশ ও শ্রমমান। এগুলো পরস্পর বিভিন্নভাবে সম্পৃক্ত করে গোটা কাঠামোটি তৈরি। তার মানে, কোনো দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করলে একদিকে সে স্থায়ীভাবে পণ্য ও সেবা খাতের পূর্ণ বাজারসুবিধা পাবে, অন্যদিকে তাকে মেধাস্বত্ব, পরিবেশ ও শ্রমমানে কঠিন কঠিন শর্ত পূরণ করতে হবে।

মেধাস্বত্বে যুক্তরাষ্ট্র ডব্লিউটিওর ট্রিপস (ট্রেড রিলেটেড অ্যাসপেকটস অব ইনটেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস) চুক্তির বাইরে গিয়ে বাড়তি শর্তারোপ করে থাকে, যা পরিপালন অনেক উন্নত দেশের পক্ষেও কঠিন। যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগকারীদের জন্য নানা ধরনের ছাড় দিতে হয়, বিরোধ নিষ্পত্তি বিনিয়োগকৃত দেশের আইনে করা যায় না। এমতাবস্থায় বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিএফটিএ করতে কতখানি সক্ষম বা প্রস্তুত, তা নিয়ে যথেষ্ট ভাবনার অবকাশ আছে।

টিপিপি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরে যাওয়া সাময়িকভাবে বাংলাদেশের জন্য স্বস্তিকর এ জন্য যে ভিয়েতনাম আর যুক্তরাষ্ট্রে বাজারসুবিধা পাচ্ছে না। তাতে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতও ভিয়েতনামের তৈরি পোশাকের সঙ্গে বাড়তি প্রতিযোগিতায় পড়বে না। কিন্তু টিপিপির জন্য কাজ করতে গিয়ে ভিয়েতনাম যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিএফটিএ করার ক্ষেত্রে বহুদূর এগিয়ে গেছে। আর ট্রাম্পের বাণিজ্যনীতির সুবিধা নিতে দেশটি এদিকে অগ্রসর হতেই পারে।

ফলে ট্রাম্পের বাণিজ্যনীতিতে বাংলাদেশ এক ভিন্ন ও জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে চলেছে। জিএসপি পুনরুদ্ধারের জন্য নতুন প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা না করাটাও সঠিক কাজ হবে না। এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার কাজটিও কঠিনতর হয়ে উঠবে।

আসজাদুল কিবরিয়া: লেখক ও সাংবাদিক।