অনুসন্ধান কমিটিকে সতর্ক হতে হবে

বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে অনুসন্ধান কমিটির মতবিনিময়
বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে অনুসন্ধান কমিটির মতবিনিময়

নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে বিতর্ক এড়ানোর জন্য অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটি ইতিমধ্যে তার কার্যক্রম শুরু করেছে। এর মধ্যে কমিটি দুটো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রথমত, এটি রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলোচনায় অংশ নেওয়া দলগুলোর কাছ থেকে কমিশনার হিসেবে তাদের পছন্দনীয় ব্যক্তিদের নাম নিয়েছে। দ্বিতীয়ত, এটি প্রথম পর্যায়ে ১২ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে পরামর্শ করেছে এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে আরও পাঁচজনের সঙ্গে আলোচনার ব্যবস্থা করেছে।
ধারণা করা হচ্ছে, এ দুটো পদক্ষেপের ভিত্তিতে কমিশন আগামী কয়েক দিনের মধ্যে রাষ্ট্রপতির কাছে ১০ জনের নাম প্রস্তাব করবে। এই ১০ জনের মধ্য থেকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশনার কারা হবেন, তা ঠিক করবেন। আমাদের সংবিধান অনুসারে রাষ্ট্রপতি এ কাজটি করবেন প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে। অর্থাৎ, অনুসন্ধান কমিটির পাঠানো নাম থেকে প্রধানমন্ত্রীই আসলে ঠিক করবেন কজন নির্বাচন কমিশনার হবেন এবং তাঁরা কে কে?
অনুসন্ধান কমিটির কাজটি এ জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে বিভিন্ন কমিশন (দুর্নীতি দমন, তথ্য ও মানবাধিকার) গঠনের জন্য সংশ্লিষ্ট আইনগুলোতে অনুসন্ধান কমিটি তৈরির বিধান রয়েছে। কিন্তু এসব আইন ত্রুটিপূর্ণ। ভারত ও পাকিস্তানে বিভিন্ন সার্চ কমিটিতে বিরোধী দলের মতামত প্রতিফলিত হওয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের আইনগুলোতে অনুসন্ধান কমিটিতে প্রধানত পদাধিকারবলে ক্ষমতাসীন সরকারের আস্থাভাজন ব্যক্তিদের থাকার সুযোগ রয়েছে, অতীতে অনুসন্ধান বা সার্চ কমিটিগুলো সেভাবেই গঠিত হয়েছিল।
অনুসন্ধান কমিটিগুলোর মনোনয়নে বাংলাদেশে গঠিত বিভিন্ন কমিশনেও তাই সরকারপন্থী ব্যক্তিরা প্রাধান্য পেয়েছেন। ফলে দুর্নীতি দমন কমিশনকে দেখা গেছে প্রধানত বিরোধী দলের নেতাদের দুর্নীতি খুঁজে বেড়াতে, মানবাধিকার কমিশনকে দেখা গেছে কোনো কোনো ক্ষেত্রে উল্টো সরকারের মানবাধিকারবিরোধী কার্যক্রমকে সমর্থন করতে, তথ্য কমিশনকেও দেখা গেছে একপর্যায়ে নির্জীব প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে।
নির্বাচন কমিশনার কারা হবেন, এটি ঠিক করার জন্য অনুসন্ধান কমিটির বিধান বাংলাদেশের কোনো আইনে নেই। সংবিধান মোতাবেক বরং নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য একটি আইন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে, সে রকম একটি আইন আসলেই করা হলে তাতে সার্চ কমিটির বিধান রাখার সুযোগ রয়েছে। এমন কোনো আইন এখনো করা হয়নি, এবারের অনুসন্ধান কমিটি করা হয়েছে স্রেফ একটি সরকারি প্রজ্ঞাপনের বলে।
এবারে অনুসন্ধান কমিটির সদস্যদের নিয়ে কিছু বিতর্ক রয়েছে। এতে অন্য অনুসন্ধান কমিটিগুলোর মতো পদাধিকারবলে সরকারের প্রিয় ব্যক্তিরাই প্রধানত অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। এই কমিটির প্রধান করা হয়েছে এমন একজন বিচারপতিকে, যিনি আগের বিতর্কিত রকিব কমিশন গঠন করার জন্য বাছাই কমিটির প্রধান ছিলেন। তবে বর্তমান সার্চ কমিটিতে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম থাকাতে অনেকের আশা রয়েছে যে কমিটির কাজ আগের চেয়ে অধিকতর গ্রহণযোগ্য হবে। এ পর্যন্ত গৃহীত কমিটির কার্যক্রম দেখলে তার কিছু আলামত পাই। আবার কিছু ক্ষেত্রে কমিটির কার্যক্রম দেখলে শঙ্কিত হওয়ার মতো বিষয়ও লক্ষ করা যায়।

২.
সার্চ কমিটি প্রথমে ১২ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে ডেকেছিল পরামর্শের জন্য। এর মধ্যে হাইকোর্টের একজন শ্রদ্ধেয় সাবেক বিচারক ছিলেন, ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন সম্মানিত সাবেক উপাচার্য, একজন বিশিষ্ট মানবাধিকার নেত্রী এবং ২০০৮ সালের নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনাকারী তিনজন নির্বাচন কমিশনার। এ ছাড়া পরামর্শের জন্য ডাকা ১২ জনের মধ্যে ছিলেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ও আবুল কাসেম ফজলুল হকের মতো বিবেকবান বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিকেরাও।
সার্চ কমিটির সঙ্গে আলাপকালে এই বিশিষ্ট ব্যক্তিরা কমিশনকে একবাক্যে সাহসী, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এবং যোগ্য কমিশনার নিয়োগের পরামর্শ দিয়েছেন। এই ১২ জনের একজন বদিউল আলম মজুমদার কমিটিকে নামের প্রাথমিক তালিকা জনগণের কাছে প্রকাশ করে একটি গণশুনানির ব্যবস্থা করতে বলেছেন এবং রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো নামের চূড়ান্ত তালিকা জনগণের কাছে প্রকাশ করতে বলেছেন। কমিটির সদস্যরা কমিটির স্বচ্ছতা ও গ্রহণযোগ্যতার স্বার্থে আরও কিছু ভালো সুপারিশ দিয়েছেন।
পরামর্শের জন্য এই ১২ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে বাছাই করার মধ্যে বাছাই কমিটির আন্তরিকতা, নিরপেক্ষতা ও প্রজ্ঞার ছাপ ছিল।
কিন্তু এরপরই কমিটি পরামর্শের জন্য আরও পাঁচজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে আহ্বান জানিয়েছে, যা নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন তোলার অবকাশ রয়েছে। প্রথমত, ১২ জনের সঙ্গে আলোচনার পর কেন আবার নতুন করে পাঁচজনকে ডাকা হলো, তার কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা সেখানে নেই। প্রথম আলোর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আইনজীবী, গণমাধ্যম ও সামরিক বাহিনীর প্রতিনিধি এবং নির্বাচন কমিশনার হয়ে কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে এমন ব্যক্তিদের সঙ্গে পরামর্শের প্রয়োজন অনুসন্ধান কমিটি অনুভব করেছে বলে নতুন করে পাঁচজনকে ডাকা হয়েছে। অথচ কমিটি প্রথম যে ১২ জনের সঙ্গে কথা বলেছে, তার মধ্যে আইনজীবী, সাবেক নির্বাচন কমিশনার এবং সামরিক কর্মকর্তারা ছিলেন, ছিলেন না কেবল গণমাধ্যমের প্রতিনিধিরা।
দ্বিতীয়ত, কমিশন পরের যে পাঁচজনকে ডেকেছে, তাঁদের মধ্যে অন্তত দুজন বর্তমান সরকারের বিভিন্ন অঙ্গ বা সমর্থিত সংগঠনের হয়ে নির্বাচন করেছেন। অবশ্য শেষ মুহূর্তে একজনকে বাদ দিয়ে বিতর্ক কিছুটা প্রশমনের চেষ্টা করা হয়েছে।
পরামর্শের জন্য গ্রহণযোগ্য ১২ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে বাছাই করার পর সার্চ কমিটি সম্পর্কে যে প্রাথমিক আশাবাদ তৈরি হয়েছিল, এখন তা কিছুটা হলেও হোঁচট খেয়েছে।

৩.
অনুসন্ধান কমিটি রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে নির্বাচন কমিশনার পদে পাঁচজন করে নাম নিয়েছে। এটি হয়তো করা হয়েছে সবার মতামত প্রতিফলন করার তাগিদ থেকে। কিন্তু এটি নতুন প্রশ্নের সৃষ্টি করতে পারে। এতগুলো দলের পাঠানো নাম থেকে কমিশন কাদের নাম রেখে কাদেরটা বাদ দেবে এবং তা কিসের ভিত্তিতে?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে অবিশ্বাস ও বিভাজন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে এটি প্রায় অবধারিত যে আওয়ামী লীগ কারও নাম পাঠালে বিএনপি তাকে আওয়ামী লীগের লোক হিসেবে চিহ্নিত করবে। একই কাজ বিএনপির পাঠানো লোকের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ করবে। অনুসন্ধান কমিটি নাম পাঠানোর ক্ষেত্রে তখন কীভাবে ভারসাম্য এবং গ্রহণযোগ্যতা রক্ষা করবে? আবার অনুসন্ধান
কমিটি যদি আওয়ামী লীগ ও বিএনপির তালিকা থেকে দুটি-তিনটি করে নাম দেয়, তাহলে প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক চূড়ান্ত বাছাইয়ে
বিএনপির নামগুলো বাদ পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তখন অনুসন্ধান কমিটি কর্তৃক রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে নাম চাওয়ার কী মূল্য থাকবে?
ভালো হতো, অনুসন্ধান কমিটি নিজেই নির্বাচন কমিশনারদের বাছাই করলে। এখন যেহেতু নাম নেওয়া হয়েই গেছে, অনুসন্ধান কমিটির উচিত হবে রাজনৈতিক দলগুলোর পাঠানো নামগুলোর গোপনীয়তা কঠোরভাবে রক্ষা করা। কমিশনার হিসেবে গোপনীয়ভাবে ১০ জনকে মনোনীত করার পর তাঁদের নাম জনগণকে জানানো। ১০ জনকে ঠিক করার আগে তাঁদের সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে নেওয়ার গুরুদায়িত্বও কমিটিকে পালন করতে হবে।

৪.
আমরা আশা রাখব, অনুসন্ধান কমিটি যেন গ্রহণযোগ্য ১০ জন ব্যক্তির নাম রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাতে পারে। পরামর্শের জন্য ডাকা ব্যক্তিদের মধ্যে যেমন দু-একজন বিতর্কিত ব্যক্তি রয়েছেন, এমন যেন নির্বাচন কমিশনার ঠিক করার ক্ষেত্রে না হয়।
তবে আমাদের এটি মনে রাখতে হবে যে কমিটি গ্রহণযোগ্য ব্যক্তির নাম পাঠালে এবং সরকার সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিলেই সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত হয়ে যাবে না। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন ও কার্যকরভাবে কাজ করতে দেওয়া। নির্বাচনের সময় যদি জনপ্রশাসন এবং পুলিশ-র্যাব-বিজিবির ওপর একচ্ছত্র আধিপত্যের সুযোগ সরকার গ্রহণ করে, তাহলে কমিশনের আসলে বেশি কিছু করার থাকে না। আমরা অতীতে তা দেখেছি।
আমি তবু মনে করি, নির্বাচন কমিশনে যোগ্য, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ও দায়িত্বশীল ব্যক্তি থাকা ভালো। এমন ব্যক্তিরা কমিশনে থাকলে যা ইচ্ছে তা চাপিয়ে দেওয়া সহজ হয় না। চাপিয়ে দিলেও তাঁরা প্রতিবাদ করেন। মানুষ তখন অন্তত বুঝতে পারে কোন কাজটা কমিশনের ইচ্ছেয়, কোনটা সরকারের ইচ্ছেয় হচ্ছে।
অনুসন্ধান কমিটির কাছে আমাদের তাই প্রত্যাশা, এমন ১০ জন ব্যক্তিকে বেছে নেওয়া, যাঁরা যোগ্য, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এবং দায়িত্বশীল, যাঁদের অতীত বক্তব্য ও ভূমিকায় নগ্ন দলপ্রীতি নেই। অনুসন্ধান কমিটিকে নিয়ে এমনি কিছু বিতর্ক রয়েছে। তারা ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করতে পারলে সেই বিতর্ক দূর হবে। আগামী নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নিয়ে জমে থাকা কালো মেঘ তাতে কিছুটা হলেও ফিকে হয়ে আসবে।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।