একটি গ্রেপ্তারের গল্প

ডোনাল্ড ট্রাম্প
ডোনাল্ড ট্রাম্প

আমাকে একবার পুলিশ আটক করেছিল। করেছিল রীতিমতো হ্যান্ডকাফ পরিয়ে। তবে তা বাংলাদেশের পুলিশ নয়। বাংলাদেশে এরশাদের আমলে আমার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা হয়েছে, বিএনপির আমলে রাষ্ট্রদ্রোহের, আওয়ামী লীগের আমলে অভিযোগ উঠেছে রাষ্ট্রদ্রোহ ও আদালত অবমাননার। কিন্তু পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার ভোগান্তি হয়নি সৌভাগ্যক্রমে।

আমাকে ধরেছিল আমেরিকার পুলিশ। সে–ও নিউইয়র্কের বিখ্যাত পুলিশ। এ ঘটনা আমি মজা করে বহু মানুষকে বলেছি। কিন্তু আমার সেই মজার ঘটনাই এখন চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগামী মাসে আমার আমেরিকা যাওয়ার কথা। এই আমেরিকা আমার
বহুদিনের চেনা আমেরিকা নয়। এই আমেরিকা মানে ট্রাম্পের আমেরিকা। ভীতি আর বিভ্রান্তিময় এক আমেরিকা।

ভিসা আছে পাঁচ বছরের। তবু মনে হয় এই আমেরিকায় ঢোকা যাবে তো? ঢোকার পরই বা কেমন হবে আমার ভ্রমণ? কী হবে আমার অভিজ্ঞতা?

আমি নিষিদ্ধ সাত দেশের মানুষদের মধ্যে কেউ নই। আমেরিকায় এর আগে পাঁচবার ভ্রমণও করেছি। এবার যাব সেখানে আন্তর্জাতিক আইনবিষয়ক এক সেমিনারে। তবু কেন আমার দুর্ভাবনা? আমারই যদি এমন হয়, তাহলে সেখানে যাঁরা আছেন, তাঁদের অবস্থা কী? বিশেষ করে, যাঁরা অনিবন্ধিত অবস্থায় আছেন বহু বছর ধরে?

আমার নিজের আশঙ্কার কথা আগে বলি। তারও আগে গ্রেপ্তারের ঘটনা।

২.

১৬ বছর আগের ঘটনা এটা। থাকি তখন আমেরিকার নিউজার্সিতে। বাসে করে নিউইয়র্কের পোর্ট অথরিটি স্টেশনে নেমেছি। নেমেই ছুটছি নিচে সাবওয়ে বা পাতালরেল ধরার জন্য। জ্যাকসন হাইটসে যাব। বহু বছর পর দেখা হবে এক পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে।

তার সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা ছিল সকালে। আমি অলরেডি লেট। সাবওয়ের প্রবেশপথ পেরিয়ে টানেলের দিকে ছুটছি ট্রেন ধরার জন্য। হঠাৎ শুনি কান্নাজড়িত আর্তনাদ। ঘুরে দেখি বোরকা পরা বয়স্ক এক মহিলা। গলার আওয়াজ শুনেই বুঝি আমার দেশেরই, সম্ভবত সিলেটের কেউ। তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে বিশাল লম্বা এক পুলিশ।

আমি ফিরে এসে তাঁর দিকে এগিয়ে যাই। মাত্র কয়েক দিন আগে লন্ডন থেকে পিএইচডি করে এসেছি। আমেরিকার পেস ইউনিভার্সিটিতে রিসার্চের কাজ করছি নামকরা এক প্রফেসরের সঙ্গে। অতি স্মার্টনেসের কারণেই হয়তো পুলিশের সামনে গিয়ে সোজা জিজ্ঞেস করি: ব্যাপার কী?

স্বদেশি মহিলার কান্নার আওয়াজ উঁচুতে উঠেছে। সাদা চামড়ার কম বয়সী পুলিশ আমাকে ঠান্ডা গলায় বলে: তুমি কে?

আমি থতমত খেয়ে বলি: উনি আমার দেশের মানুষ। হয়তো ইংরেজি জানেন না!

তোমাকে সে হেল্প করতে বলেছে?

হেল্প করলে অসুবিধা কী?

পুলিশ আমাকে কথা শেষ করতে দেয় না। আমাকেই সে চ্যালেঞ্জ করে এবার। তুমি টিকিট করেছ? আমি সঙ্গে সঙ্গে টিকিট বের
করে দেখাই তাকে। সারা দিন নিউইয়র্কে ট্রেন ভ্রমণ করার কার্ড। সে তা হাতে নেয়। বলে, কিন্তু আমি দেখেছি তুমি এটা পাঞ্চ না করে ঢুকেছ। কেন?

অবাক হয়ে বলি: ঢোকার পথ তো খুলে রাখা। আমি তাহলে সেখানে কার্ড পাঞ্চ করব কেন?

কার্ড পাঞ্চ করতে হয়। তুমি করোনি কেন?

আমি তো লন্ডনে ছিলাম অনেক বছর। খোলা থাকলে কার্ড পাঞ্চ তো না করলেও হয়।

এটা লন্ডন নয়, নিউইয়র্ক। তোমার কোনো আইডেনটিটি কার্ড আছে? পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স?

পাসপোর্ট তো বাসায়!

বাসায় কেন?

আমি অবাক হই। পাসপোর্ট কি সঙ্গে নিয়ে ঘুরব নাকি!

পুলিশ অফিসার হাসে। সে আমাকে বলে, আমি তোমাকে গ্রেপ্তার করছি।

মানে! আমিও হাসি। তবে সেটা অবিশ্বাসের। আমাকে গ্রেপ্তার করবে কেন?

কারণ, তুমি দুটো অপরাধ করেছ। তুমি কার্ড পাঞ্চ না করে ঢুকেছ। সেটা প্রথম অপরাধ। আর তোমার আইডেনটিটি চাওয়া হয়েছে। সেটা দেখাতে পারোনি। এটা দ্বিতীয় অপরাধ।

আমি তোমাকে গ্রেপ্তার করছি—এটা আবারও বলে সে হ্যান্ডকাফ এগিয়ে দেয়।

ব্যাটা বলে কী! আমি অবাক হয়ে তাকে ওপর-নিচ দেখি। সে কী এক ইশারা করে। বোরকাধারী মহিলা স্টেশন থেকে বের হওয়ার পথ ধরে।

আমি তাকে বলি: আমার সঙ্গে তো টিকিট আছে। আজকের দিনেরই টিকিট। এই টিকিট তো আমি চাইলেও অন্য দিন ব্যবহার করতে পারব না। তাহলে এটা পাঞ্চ না করলে অসুবিধা কী?

পুলিশ অফিসার রাগত গলায় বলেন: তুমি আমাকে হ্যান্ডকাফ পরাতে দেবে?

তুমি কি সিরিয়াস?

আমাকে বাধ্য কোরো না!

আমি দুহাত বাড়িয়ে দিই। সে দুহাত পেছনে নিয়ে হ্যান্ডকাফ পরায়। বলে: ফলো মি!

আশপাশের মানুষ আড়চোখে দেখছেন। আমি ‘এই গাধার কাণ্ড দেখো’ টাইপের একটা অভিব্যক্তি করে তাঁদের দিকে তাকাই।

পুলিশ পোর্ট অথরিটির ভেতরের তাদের অফিসে নিয়ে যায়। সেখানে আমাকে একটা ফোন করার সুযোগ দেওয়া হয়। তারপর আমাকে অনেক দূর হাঁটিয়ে পুলিশ ভ্যানে তুলে সে প্রশ্ন করে: কী নাম তোমার?

মাত্র কিছুদিন আগে পিএইচডি করেছি! আমি নামের আগে ডক্টর শব্দটা জোর দিয়ে উচ্চারণ করি। সে বলে: তুমি কিসের ডক্টর? চোখের না কানের? আমি তার অজ্ঞানতা নিয়ে কিছু উপহাস করি।

হাজতে ঢুকিয়ে আমার বারোটা বাজিয়ে দেয় সে। এক ভয়ালদর্শন কালো আসামির কক্ষে ঠেলে দেয়, মাঝে বের করে করে
আমার সব আঙুলের ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেয়, দাগি অপরাধীদের মতো করে চেহারার ছবি (মাগশট) নেয়। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে আমি তার কর্মকাণ্ড দেখি।

বিকেলের দিকে আমাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। ছাড়ার সময় সেই পুলিশ দুটো জিনিস হাতে ধরিয়ে দেয়। একটি ট্রাফিক নিয়ম ভঙ্গের কাগজ। একটি মাগশটের ছবি। সে ব্যঙ্গাত্মক হেসে বলে: তোমার জন্য সুভেনির!

২০০১ সালে নাইন-ইলেভেনের আগে দেশে ফিরে আসি আমি। এরপর তিনবার আমি পাঁচ বছর মেয়াদি ভিসা পেয়েছি। প্রতিবারই ভিসা অফিসার জানতে চান ঘটনাটা। আমি প্রতিবার তা বর্ণনা করি। প্রতিবারই অবাক হয়ে ভাবি এত ছোট একটা জিনিসও রয়ে গেছে তাদের রেকর্ডে। যদি আমার এতগুলো দেশের ভিসা না থাকত, যদি আমি নামী সব সংগঠনের আমন্ত্রণ না পেতাম, তাহলে কে জানে ভিসা পেতেও হয়তো ভোগান্তি হতো আমার।

৩.

পুলিশের গ্রেপ্তারের ঘটনা নতুন করে আমার মনে ফিরে এসেছে ট্রাম্পের কারণে। ট্রাম্প সত্যি তাঁর ঘনিষ্ঠ মিত্রদের সঙ্গে ট্রান্স-প্যাসিফিক চুক্তি বাতিল করে দিয়েছেন। মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল তোলা হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি জলবায়ু চুক্তি আর বিশ্বায়নবিরোধীদের নিজের উপদেষ্টা বানিয়েছেন এবং আরও যা ভয়াবহ, সত্যি তিনি তাঁর তীব্র মুসলিম-বিদ্বেষ নীতি প্রয়োগ করতে সাতটি মুসলিম দেশ থেকে বৈধ ভিসাধারীদেরও আমেরিকায় প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন।

অন্য কিছুর চেয়ে ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তই সবচেয়ে বেশি সমালোচনার ঝড় তুলেছে। এই সিদ্ধান্তের পর আমেরিকার ভিসা নিয়ে প্লেনে ওঠার পরও এয়ারপোর্টে এসে ফেরত যেতে হয়েছে সাতটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রের মানুষকে। প্লেনে উঠতে গিয়ে ফিরে যেতে হয়েছে বৈধ ভিসাধারী মানুষকে।

এই নিষেধাজ্ঞা মার্কিন আদালত আপাতত আটকে দেওয়ার পর ট্রাম্প নতুন নিষেধাজ্ঞা জারি করার কথা জানিয়েছেন। আগামী দু-তিন দিনের মধ্যেই নাকি তা করা হবে। আর এরই মধ্যে নিষেধাজ্ঞা বাতিল হওয়ায় ক্ষুব্ধ ট্রাম্প প্রশাসনের পুলিশ (ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট) আটক করেছে কয়েক শত অনিবন্ধিত অভিবাসী মানুষকে। আটক করে নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর ঘটনাও ঘটছে।

আমেরিকায় বছর পাঁচেক আগে একবার বোস্টন এয়ারপোর্টে আমাকে কিছুক্ষণ বসিয়ে রাখা হয়। আমি ভাবলাম, পুলিশের গ্রেপ্তারের ঘটনার রেকর্ডের জন্য কি? তারা অবশ্য কিছু বলেনি। একটু পর পাথুরে মুখে আমাকে পাসপোর্ট ফেরত দিয়ে বোস্টনে ঢুকতে দেওয়া হয়।

আবার আমেরিকায় যাওয়ার দিন এগিয়ে আসছে। আমার হঠাৎ একদিন মনে হলো এবারও যদি আটকে রাখে আমাকে এয়ারপোর্টে! ১৬ বছর আগের ঘটনা তুলে যদি নাস্তানাবুদ করে আমাকে!

একটু পরই আমি বিস্মিত হয়ে ভাবি, এত সামান্যতে এমন চিন্তা হলো আমার! তাহলে কী অবস্থায় আছেন আমেরিকার নানা হুমকিতে থাকা মুসলিম, হিসপানিক, এমনকি কালো মানুষেরা। কী ভয়াবহ আশঙ্কায় আছেন লাখ লাখ অনিবন্ধিত অভিবাসী, যাঁদের ট্রাম্পের মতো প্রেসিডেন্টরা উচ্চারণ করেন অবৈধ হিসেবে? এর মধ্যে বহু বাংলাদেশিও আছেন। আমাদের সরকার কি ভাবতে শুরু করেছে তাঁদের কথা? আমাদের দূতাবাস কি সতর্ক আছে নিজ দেশের মানুষের স্বার্থরক্ষার উপায় খোঁজার বিষয়ে?

আরেকটা কথা। বহু বছর ধরে জঙ্গিবাদের আশঙ্কার কথা ঢাকঢোল পিটিয়ে বলে আসছি আমরা নিজেরাই। এটা কীভাবে পাশ্চাত্যের শক্তিরা সুযোগ বুঝে ব্যবহার করে, তা আমরা গত বছর অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট টিমের সফর বাতিল হওয়ার সময় দেখেছি। এই ঢাকঢোল পেটানো অব্যাহত রাখলে ট্রাম্পের আমেরিকা হঠাৎ কী সিদ্ধান্ত নিতে পারে বাংলাদেশ সম্পর্কে? জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের কি রণকৌশল হওয়া উচিত তাহলে আমাদের? কথা কম, কাজ বেশি? সত্যিকারের গণতন্ত্রায়ণ এবং জাতীয় ইস্যুতে ঐক্য?

ট্রাম্প-যুগের পৃথিবীর ভয়াবহতা আমাদের উপলব্ধি করতে হবে জাতীয়ভাবে। যে ট্রাম্প অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রীকে ধমকাতে পারেন, ইরান আর মেক্সিকোকে চোখ রাঙাতে পারেন, কুখ্যাত বর্ণবাদী ও সাম্প্রদায়িক স্টিভ ব্যাননকে হোয়াইট হাউসের চিফ স্ট্র্যাটেজিস্ট বানাতে পারেন, তিনি হঠাৎ এমন সিদ্ধান্তও নিতে পারেন, যা ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে বাংলাদেশকে।

নিজেরই এই সামান্য আমেরিকা যাওয়া নিয়ে এত কিছু মাথায় এল আমার। দেশের ১৬ কোটি মানুষের স্বার্থরক্ষার দায়িত্ব সরকারের। খুব জানতে ইচ্ছে করে তারা কী ভাবছে ট্রাম্প-যুগ আর বাংলাদেশের ওপর এর সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে? সেখানকার বাংলাদেশিদের অসহায়ত্ব নিয়ে?

আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।