বসন্তকে কে ঋতুরাজ বানিয়েছে?

বসন্তকে বিখ্যাত করেছেন আসলে কবিরা। নীরদ সি চৌধুরী বলেছিলেন, বাঙালি আসলে প্রেম করতে জানত না, তাদের প্রেমের জায়গাজুড়ে ছিল শরীর, বাঙালিকে রোমান্টিকতা শিখিয়েছেন বঙ্কিমচন্দ্র। আর আমি বলি, বাঙালি জীবনে বসন্তের কোনো ভূমিকা থাকার কোনো কারণ নেই, বাঙালিকে বসন্ত চিনিয়েছেন দেশ-বিদেশের কবি-সাহিত্যিকেরা। এর মধ্যে সংস্কৃত কবিরা আছেন, বিলেতি কবিরা আছেন এবং আছেন বাঙালি কবিরা।

বিলেতিদের জন্য বসন্তবন্দনা খুবই স্বাভাবিক, শীতকালে চারদিকে সাদা তুষার, ঠান্ডায় জীবন যায় যায়, গাছপালায় কঙ্কালের মতো নিষ্পত্র শাখা, তারপর আসে বসন্ত, প্রাণ ফিরে আসে চরাচরে, গাছে গাছে, পাতায় পাতায়, মানুষের জীবনে।

আর আমাদের দেশে? পাতা ঝরে না, পাতা ঝরে আসলে চৈত্রে, মানে বসন্তে, আর যদিও বসন্তে কিছু বৃক্ষে নব কিশলয় দেখাও দেয়, ধুলোয় তারা থাকে ধূসরিত।

বাংলাদেশে বসন্তে ফুলই বা কই। বাংলাদেশের জাতীয় ফুল শাপলা, তার সঙ্গে বর্ষা কিংবা শরতের সম্পর্ক থাকতে পারে, বসন্তের সম্পর্ক নেই, আর ঢাকা শহরকে সবচেয়ে সুন্দর দেখায় কৃষ্ণচূড়ার কালে, পলাশ কিংবা শিমুলের কালে নয়।

তবুও যে বসন্ত নিয়ে আমরা এত মাতামাতি করি, তার কারণ কবিরা লিখে লিখে এটাকে বিখ্যাত করে গেছেন। বসন্তের দখিনা সমীরণেও এত দূষণ যে একে আর মলয় বলবার উপায় নেই, ও তো নির্মল নয়।

বসন্তের সঙ্গে সম্পর্ক আছে কামের। মহাকবি আলাওল (১৬০৭-১৬৮০) ‘পদ্মাবতী’ কাব্যে লিখেছেন...
মলয়া সমীর হৈলা কামের পদাতি।
মুকুলিত কৈল তবে বৃক্ষ বনস্পতি॥
কুসুমিত কিংশুক সঘন বন লাল।
পুষ্পিত সুরঙ্গ মল্লি লবঙ্গ গুলাল॥
ভ্রমরের ঝঙ্কার কোকিল কলরব।
শুনিতে যুবক মনে জাগে মনোভব॥

পুরাণ মতে
উপদেবতারূপে কামদেবের বৈশিষ্ট্যগুলো নিম্নরূপ: তাঁর সঙ্গীরা হলো একটি কোকিল, একটি পারাবত, ভ্রমরের দল, বসন্ত ঋতু ও মলয় বাতাস। এগুলো সবই বসন্তের প্রতীক। কামদেবের উৎসব হলো হোলি, হোলিকা বা বসন্ত। (উইকিপিডিয়া)

বসন্তবন্দনা রবীন্দ্রনাথ করেছেন, কাজী নজরুল ইসলাম করেছেন, নির্মলেন্দু গুণও করেছেন। আমাকেও করতে হবে! তা না হলে কবির খাতা থেকে নাম কাটা যাবে?

যাক। তবু সাহস করে বলি, কোকিলের কুহু কুহু মোটেও ভালো লাগে না। এর চেয়ে বউ কথা কও সুন্দর লাগে। পলাশ-শিমুলের চেয়ে ভালো লাগে শিউলি কিংবা কামিনি বা কৃষ্ণচূড়া। তবে, হ্যাঁ, আমের মুকুল ভালো লাগে। রবীন্দ্রনাথের—‘ও মা ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে’—এটা আমি মানতে রাজি আছি।

এর বাইরে এই ধুলোবালি, এই গা চরচরে ভাব, এই রুখো প্রকৃতি আমার পছন্দ না।
রবীন্দ্রনাথ যতই গান:
ফাল্গুনে বিকশিত কাঞ্চন ফুল
ডালে ডালে পুঞ্জিত আম্রমুকুল‍—

তাতে আমার মন টানে না। কিন্তু যখন তিনি গান, ‘মধুর বসন্ত এসেছে মধুর মিলন ঘটাতে আমাদের মধুর মিলন রটাতে’—তখন ভালোই লাগে। সেটা বসন্ত মধুর বলে নয়, মিলনটা মধুর বলে।

আমার প্রিয় ঋতু বর্ষা। বাংলার শ্রেষ্ঠ ঋতু বর্ষা। গাছে গাছে বৃষ্টিধোয়া সবুজ নধর পাতা। বেলিফুলের সৌরভ বাতাসে। কৃষ্ণচূড়াও কিছু অবশিষ্ট থাকে। কোকিল না ডাকুক, গ্রামে এখনো বোধ হয় ব্যাঙ ডাকে। আর রাধা অভিসারে যান নীলাম্বরি পরে। বিরহী যক্ষের কথা ফুটে ওঠে মেঘদূতে।

তবুও পয়লা ফাল্গুনের শুভেচ্ছা জানাই। স্বাগত জানাই বসন্তের উৎসবগুলোকে। কারণ, এ উৎসব আমাদের উৎস সন্ধানেরই উৎসব।

বসন্তকে কবিরা বলেছেন ঋতুরাজ। কেন বলেছেন, তাঁরাই ভালো বলতে পারবেন। আমার কাছে বসন্তের চেয়ে শীত ভালো, শরৎ আর হেমন্ত ভালো এবং সবচেয়ে ভালো বর্ষা। বসন্ত কেবল হয়তো গ্রীষ্মের চেয়ে বেশি মার্কস পেতে পারে।

পয়লা ফাল্গুনে একটা বসন্তবিরোধী লেখা লিখলাম। জানি না তা রাজদ্রোহ হয়ে গেল কি না। হলে হবে। গণতন্ত্রের যুগে এত রাজাবাদশা মানতে পারব না।
আপনারা বলবেন, বসন্ত নিয়ে লিখতে গিয়ে আমি ধুলোবালি, রাজতন্ত্র-গণতন্ত্র আনছি কেন? এমন পার্থিব সাংসারিক কথা কি বসন্তের প্রসঙ্গে আসে? আমি বলব, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ বসন্ত প্রসঙ্গে গেরস্থালি কথা বলেছেন। ‘আজ জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে’ গানটিতে তিনি বলেছেন, ‘আমার এ ঘর বহুত যতন করে, ধুতে হবে মুছতে হবে মোরে’।

ঘর ধোয়া ও মোছার কথা কবিগুরু যদি বসন্তের গানে লিখতে পারেন, আমি কেন বসন্তের লেখায় ধুলোবালির কথা পাড়তে পারব না?