জিপিএ-৫, নাকি পরিপূর্ণ মানুষ

ছেলেবেলায় ১৯৮০-এর দশকে পাড়া-মহল্লায় দেখতাম, এক দঙ্গল ডানপিটে ছেলে একত্রে ঘোরাফেরা করত। এরা নানা রকম সামাজিক কার্যক্রমের সঙ্গেও জড়িত ছিল। পাড়ার হেন কাজ নেই, যেখানে তাদের দেখা পাওয়া যেত না। আবার তাদের অনেকেই রাজনৈতিক দলের ক্যাডার হয়ে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়াত। আজকের উত্তরার গ্যাং সংস্কৃতির সঙ্গে ওই আমলের গ্যাং বা দলের পার্থক্য এখানেই যে আজকের এই গ্যাং কিশোরেরা সমাজের ভালো কাজ থেকে দূরে থাকে। সহিংসতা ও মস্তানির দিকে ঝোঁক। যার বলি তাদেরই বন্ধু আদনান কবির।
এই কিশোরেরা এতটাই বেপরোয়া যে, ফেসবুকে ঘোষণা দিয়ে তারা খুন করতে যায়। অভিভাবক, স্কুল কর্তৃপক্ষ—সবাই যেন তাদের কাছে অসহায়। এ অবস্থায় ঢাকা মহানগর পুলিশ ঘোষণা দিয়েছে, উত্তরায় স্কুলের পোশাক পরে কিশোরেরা ঘোরাঘুরি করলে তাদের থানায় নিয়ে যাওয়া হবে। এরপর অভিভাবক ও স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছেই কেবল তাদের হস্তান্তর করা হবে। এই সিদ্ধান্ত কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। আবার এই সুযোগে পুলিশও যে হয়রানি করবে না, তার নিশ্চয়তা কী? কারণ, পুলিশের বিরুদ্ধে তো অভিযোগের শেষ নেই। তখন আবার প্যান্ডোরার বাক্স খুলে যেতে পারে!
এই সমস্যা সমাধানে স্থায়ী পদক্ষেপ নেওয়াই শ্রেয়, যদিও তার সঙ্গে কিছু সাময়িক ব্যবস্থা নেওয়ারও অবকাশ রয়েছে। স্থায়ী পদক্ষেপের প্রসঙ্গে বলা যায়, স্কুলগুলোতে পাঠাতিরিক্ত কার্যক্রম শুরু করা যেতে পারে, যেগুলো একসময় থাকলেও এখন নেই বললেই চলে। ক্লাসের পর ছাত্রছাত্রীদের সাংস্কৃতিক কার্যক্রমসহ নানা রকম সৃজনশীল কাজে যুক্ত করা যায়। তবে সবাই যে এসব করবে তা নয়, তাদের জন্য খেলাধুলার ব্যবস্থা করা যায়। আজকের ঢাকা নগরের অভিভাবকেরা সন্তানের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত থাকেন। এতে স্কুল কর্তৃপক্ষ যদি ছাত্রদের এসব কাজে নিয়োজিত রাখতে পারে, তাহলে তাঁরাও একটু স্বস্তি পাবেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, আমরা যেভাবে জিপি-৫-এর পেছনে ছুটছি, তাতে অভিভাবকদের অনেকেই এই ব্যবস্থায় রাজি হবেন কি না, সন্দেহ! কিন্তু তাঁদেরও ভেবে দেখা উচিত, এই ইঁদুরদৌড় থেকে আমরা কী অর্জন করছি। তবে এখানে সরকারের ভূমিকাই প্রধান। কারণ, সরকার না চাইলে তো স্কুলের পক্ষে এককভাবে এটা করা সম্ভব নয়। এর জন্য অনেক আয়োজনের ব্যাপার আছে। অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগের প্রয়োজনীয়তা আছে।
ভয় দেখিয়ে উত্তরার এই কিশোরদের সাময়িকভাবে হয়তো নিবৃত্ত করা যাবে, কিন্তু ওদের তৎপরতা একেবারে বন্ধ করা যাবে না। সমাজের মানুষের চিন্তা-চেতনায় পরিবর্তন না এলে বা শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার না করলে এই সমস্যার দীর্ঘস্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়। একই সঙ্গে অভিভাবকদের উচিত, সন্তানদের সময় দেওয়া, শুধু টাকা দিলেই তাঁদের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। মানুষের সামাজিকায়ন বা শিক্ষার প্রথম ধাপ হচ্ছে পরিবার। তাই এ ক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এরপর চলে আসে স্কুলের কথা। জিপিএ-৫ পাওয়ার বিদ্যার সঙ্গে যদি শিশু-কিশোরেরা সামাজিকতা, নৈতিকতা, বিবেকের শিক্ষা না পায়, তাহলে হয়তো আরও অনেক আদনানের মৃত্যু আমাদের দেখতে হবে। একই সঙ্গে স্কুলে কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থাও থাকা উচিত, কারণ কিশোর বয়সে মানুষের চিন্তার জগতে বড় পরিবর্তন আসতে শুরু করে, যেটা তাকে এলোমেলো করে দেয়।
কথা হচ্ছে, আদনানের খুনি কিশোরদের মধ্যে অনেকেই হয়তো জিপি-৫ পেত, কিন্তু এই জিপিএ-৫ লইয়া আমরা কী করিব! ফলে আমরা কি জিপিএ-৫
উৎপাদন করব, নাকি পরিপূর্ণ মানুষ তৈরি করব? সিদ্ধান্ত আমাদেরই!